‘এই পররাষ্ট্র দপ্তর সেই পররাষ্ট্র দপ্তর নয়, যাকে আমি চিনি’

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যুরো অব পলিটিক্যাল-মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক ছিলেন জশ পল। এ বিভাগ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র স্থানান্তরের বিষয়টি দেখভাল করে থাকে। ইসরায়েলে অস্ত্র পাঠানোর বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের অন্ধ নীতির প্রতিবাদে তিনি চাকরি ছাড়েন। ২৩ অক্টোবর তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে একটি নিবন্ধ লেখেন, যাতে তিনি কেন চাকরি ছেড়েছেন, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলায় এক বছর বয়সী শিশু আমাল আল-বাইউক নিহত হয়। দাফনের আগে বাবার কোলে শিশুর মরদেহ। ২৫ অক্টোবর
ছবি: এএফপি

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যুরো অব পলিটিক্যাল-মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সে আমি কংগ্রেসনাল অ্যান্ড পাবলিক অ্যাফেয়ার্স-বিষয়ক পরিচালক হিসেবে এক দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করেছি। বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র হস্তান্তর ও নিরাপত্তা সহায়তার বিষয়টি দেখভাল করে থাকে এই বিভাগ। এ বিভাগে দায়িত্ব পালনকালে কোথায় কী অস্ত্র পাঠানো হচ্ছে, তা নিয়ে বহুবার আমাকে জটিল ও নৈতিকভাবে নানা চ্যালেঞ্জিং বিতর্কের মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু এই প্রথম চলতি মাসে আমি এই জটিল ও নৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হইনি, দেখিনি কোনো বিতর্ক।

এ কারণে গত সপ্তাহে আমি পদত্যাগ করেছি। অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতার মূল ভিত্তি ছিল ‘শান্তির জন্য নিরাপত্তা’। ধারণা এমন ছিল, ইসরায়েল যাতে নিরাপদ অনুভব করতে পারে, সে জন্য প্রতিবছর শত শত কোটি ডলারের মার্কিন সহায়তার অস্ত্র দেশটিকে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় থাকবে। (পররাষ্ট্র দপ্তরের মার্কিন নিরাপত্তা সমন্বয়কের এটি একটি মৌলিক কাজ। রামাল্লায় এক বছর অবস্থান করে আমি এ কাজ করেছিলাম।)

কিন্তু অতীতের রেকর্ড বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েল শান্তি ফেরাতে পারেনি। বরং তারা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড দখল করে বসতি স্থাপন সম্প্রসারণ করছে। এতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। অন্যদিকে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলে বোমবর্ষণ মানসিক অসুস্থতা ও হতাতহের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে। এসব কিছু ইসরায়েলের নিরাপত্তায় কোনো অবদান রাখছে না।

৭ অক্টোবর হামাস যখন ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে বেসামরিক মানুষজনকে হত্যা করে, তখন আমি খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। এর কারণ ছিল, ওই ঘটনার ভয়াবহতা এবং পরে কী হতে যাচ্ছে, সেটা ভেবে। ইসরায়েলের নিজের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। কিন্তু গত ১৫ বছরের আধা ডজন সংঘাতের রেকর্ড ঘেঁটে দেখলে দেখা যায়, ইসরায়েলের এই আত্মরক্ষার প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।

আমি যথেষ্ট নিশ্চিত ছিলাম, নানা ধরনের অস্ত্রসহ গোলাবারুদের জন্য অবিলম্বে ইসরায়েলের অনুরোধ আসবে। এমন অস্ত্রের জন্যও অনুরোধ আসবে, যা এ সংঘাতে ব্যবহারের যোগ্য নয়। বড় ধরনের অস্ত্রের চালান দেওয়ার ইসরায়েলি অনুরোধের ব্যাপারে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে এবং এ জন্য আমি খোলামনে আলোচনার আহ্বান জানাই। কিন্তু আমার আলোচনার আহ্বানে কোনো সাড়া এল না। পরিষ্কার নির্দেশনা এল, আমাদের যত দ্রুত সম্ভব ইসরায়েলের অনুরোধ রক্ষা করতে হবে।

একই সঙ্গে যে কংগ্রেস মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড বিবেচনায় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের কাছে অস্ত্র বিক্রি আটকে দিয়েছিল, সেই কংগ্রেস যত দ্রুত সম্ভব ইসরায়েলের দাবি পূরণে এখন আমাদের ওপর চাপ দিচ্ছে।

সাধারণ একটি ধারণা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র কোনো বেসামরিক নাগরিককে হত্যায় ব্যবহার হবে না। আমার চাকরিকালে গত চার মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমলে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক হয়নি। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল আমি ইরাকে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় কাজে সহায়তা করেছিলাম। অথচ তখনো বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে মার্কিন অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে।

চলতি বছরের শুরুর দিকে এ ধরনের ঘটনা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে বাইডেন প্রশাসন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাইডেন প্রশাসন নতুন একটি প্রচলিত অস্ত্র স্থানান্তর নীতি প্রণয়ন করে, যাতে বলা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহারের ‘আশঙ্কা’ থাকলে অস্ত্র স্থানান্তর করা যাবে না।

গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসকে সিভিলিয়ান হার্ম ইনসিডেন্ট রেসপন্স গাইডেন্স (সিএইচআইআরজি) সম্পর্কে জানায়। মার্কিন অস্ত্রের ব্যবহারে যাতে কোনো বেসামরিক নাগরিকের ক্ষতি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল।

কিন্তু এ ঝুঁকি তো রয়েই গেল। ইসরায়েলকে সরবরাহ করা মার্কিন অস্ত্র, বিশেষ করে আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য গোলাবারুদ বেসামরিক নাগরিকের ক্ষতি করবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে। কিন্তু পররাষ্ট্র দপ্তর এ ঝুঁকি নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্কে না যাওয়ার ব্যাপারে একেবারে অনঢ় ছিল। এমনকি তারা মুলতবি থাকা সিএইচআইআরজি প্রকাশের প্রক্রিয়াও আটকে দেয়।

অন্তত আমার অভিজ্ঞতা বলে, মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখা আমাদের নীতিগত একটি বিষয়। কিন্তু সেটিকে পাশ কাটিয়ে যা হয়েছে, তা নজিরবিহীন।

মানবাধিকারসংশ্লিষ্ট বিষয় এবং আমাদের অংশীদারদের অনুরোধ—দুটি বিষয়কে মানসম্মত ও স্বাস্থ্যকর উপায়ে আলাপ-আলোচনা করে অস্ত্র স্থানান্তরের প্রক্রিয়া ঠিক করার কথা। এ ধরনের পরিস্থিতি যখন আসে, তখন মার্কিন প্রশাসন, বিশেষ করে পররাষ্ট্র দপ্তর ও ব্যুরোর অনেক ভালো কর্মকর্তা মার্কিন আইন, নীতি মেনে এবং বিবেকের তাড়না থেকে খোলামেলা আলোচনা বিতর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসেন। আমি বিশ্বাস করি, এ ধরনের প্রক্রিয়া মার্কিন জনগণকে গৌরবান্বিত করে।

অস্ত্রবাণিজ্যের নীতিবাক্যই হচ্ছে—‘প্রথমত, কোনো ক্ষতি নয়।’ অন্তত যতটা সম্ভব কম ক্ষতির ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ইউক্রেনে ক্লাস্টার অস্ত্র পাঠানোর বিষয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল। ওই বিতর্কের মাধ্যমে আমরা দেখিয়েছিলাম, চরম সংকটের মধ্যেও আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব।

যখন ইসরায়েলের বিষয় আসে, তখন বিতর্ক ও আলোচনায় আমাদের অনীহা দেখা যায়। এটি কিন্তু ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতির প্রমাণ নয়। বরং ইসরায়েলের প্রতি আমাদের এই নীতি অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে। এমনকি এই নীতি আমাদের মূল্যবোধ থেকে সরে যাওয়ার এবং গাজার লাখ লাখ মানুষের দুর্দশাকে উপেক্ষা করার প্রমাণ দেয়।

এই পররাষ্ট্র দপ্তর সেই পররাষ্ট্র দপ্তর নয়, যাকে আমি চিনি। এ কারণে আমাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে।