বাশার আল-আসাদের জায়গায় কে আসছেন, তা নিয়ে উদ্বেগে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ‘ঐতিহাসিক পতন’ যে গতি ও মাত্রায় হয়েছে, তা হোয়াইট হাউসকে হতবাক করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাশারের পতনের কৃতিত্বে ভাগ বসাচ্ছেন বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
বাশারের পতনের পর বাইডেন এক বিবৃতিতে সিরিয়ার শাসনব্যবস্থায় অসাধারণ এই পরিবর্তনকে যুক্তরাষ্ট্র গৃহীত কৌশলের ফলাফল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ওয়াশিংটনের কৌশল ওই অঞ্চলে রাশিয়া ও ইরানের ভূমিকাকে দুর্বল ও আসাদের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কখনো অনুমান করতে পারেনি গত বছরের অক্টোবরে হামাসের হামলার পর ইসরায়েলকে এবং ২০২২ সালে রাশিয়ার সর্বাত্মক হামলা শুরুর পর থেকে ইউক্রেনকে তারা যে সামরিক সহায়তা দিয়েছে, তা সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের অর্ধশতাব্দীর শাসনের অবসান ঘটাতে অবদান রাখবে।
বাইডেনের ভাষ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রকে এখন বাশার আল-আসাদ–পরবর্তী সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করতে হবে। তবে তাঁর পতনকে একটি ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’ হিসেবে দেখলেও একই সঙ্গে এটাকে ‘ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার’ সময় বলেও মনে করছেন তিনি।
সিরিয়ায় এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে ওয়াশিংটন। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ভাবনার বিষয়, সিরিয়া এখন কে বা কারা শাসন করবে? বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পরই বাইডেন তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন। হোয়াইট হাউসে এ বৈঠক হয় রোববার সকালে।
সিরিয়ায় বাশার যুগের অবসান, ইরানের দুর্বল হয়ে পড়া ও রাশিয়ার অপমানিত হওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ততো মাথাব্যথা নেই। তাদের বরং চিন্তা ও ভয় বাশারের পতনে সিরিয়ায় তৈরি হওয়া শূন্যতা নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের শঙ্কা, এই শূন্যস্থান এমন একটি পক্ষ পূরণ করতে যাচ্ছে, যাদের তারা ততটা পছন্দ করে না এবং চায়ও না এমন পক্ষ দেশটির ক্ষমতায় আসীন হোক। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠা এই পক্ষ হলো ইসলামপন্থী বিদ্রোহীরা। এই বিদ্রোহীদের মধ্যে এমন একটি গোষ্ঠী রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যাদের সন্ত্রাসী তকমা দিয়েছে। সিরিয়ার জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশকে নিয়ে এসব গোষ্ঠী মাথা ঘামায় না। এটা হলে দেশটিতে আবারও বিশৃঙ্খলা এবং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে ওয়াশিংটনের আশঙ্কা।
বাশারের পতন উদ্যাপনে রাজধানী দামেস্কে ফাঁকা গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটলেও যুক্তরাষ্ট্র যে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন সিরিয়ার অধিকাংশ মানুষ তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নন। একজন নৃশংস স্বৈরাচারীর পতনকে অল্প সময়ের জন্য বাহবা দিলেও (সিরিয়ার রাজনৈতিক শূন্যতা) কীভাবে পূরণ করা হবে, সেটা নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ব্যতিব্যস্ত থাকবে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন এরই মধ্যে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে অবস্থানকারী আমেরিকার সেনারা সেখানেই থাকবেন। আইএসকে মোকাবিলায় অল্পসংখ্যক মার্কিন সেনা এখনো সেখানে রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক মার্কিন সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ড্যানিয়েল শাপিরো সিরিয়ায় বেসামরিক নাগরিক, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলতে সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলা ও দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির বিষয়ে আমরা অবগত। এই পরিস্থিতি আবার আইএসকে সক্রিয় হওয়ার ও বিদেশে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করার সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। আইএস যাতে তৎপর হতে না পারে, এ জন্য আমরা সব অংশীজনের সঙ্গে কাজ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’
ফোরাত নদীর পূর্বে এবং ইরাক ও জর্ডান সীমান্তের কাছে আল-তানফ সামরিক ঘাঁটিতে আরব ও কুর্দি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম সরবরাহ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন এসব বিদ্রোহীদের তুলনামূলক মধ্যমপন্থী মনে করে। তবে সিরিয়ায় মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি দামেস্ক কীভাবে নেবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এ মুহূর্তে আলোচনার মাধ্যমে সিরিয়ায় একটা স্থিতিশীল পরিবেশ কীভাবে ফেরানো যায়, তা নিয়ে কাজ করবে। ওয়াশিংটন চেষ্টা করবে যাতে পরিস্থিতি মোটাদাগে তাদের পছন্দের গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকে।
২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর প্রথম দিকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দেশটির মধ্যমপন্থী বিদ্রোহীদের সীমিত সহায়তা দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক পর্যায়ে চরমপন্থীদের আধিপত্য তৈরি হওয়া এবং বাশারের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে রাশিয়ার অংশ্রহণের পর সেই সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় ওয়াশিংটন।
এর পর থেকে বাশার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সংকট নিষ্পত্তির লক্ষ্যে জাতিসংঘের প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিতে শুরু করে ওয়াশিংটন। এ কারণে এখন মনে হচ্ছে, বিদ্রোহী ও বাশার আল-আসাদ সরকারের অবশিষ্টাংশের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এখন আহ্বান জানাবে।
দুই সপ্তাহের কম সময়ে যে ঝটিকা বিদ্রোহী অভিযানে বাশার সরকারের পতন ঘটল, তার নেতৃত্বে ছিল হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। সশস্ত্র এই গোষ্ঠী একাধিবার নিজেদের একটি নতুন ভাবমূর্তি তৈরির ইঙ্গিত দিয়েছে। এইচটিএস প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা কোনো প্রতিশোধপরায়ণ হবে না। পাশাপাশি এক সময়ের মিত্র আল-কায়েদার সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখবে না। কিন্তু এসব সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সহজে এইচটিএসের এসব কথা বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। কারণ, একসময় সশস্ত্র এই গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসীর তকমা দিয়েছিল তারা।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এমন কেউ কেউ ওয়াশিংটনের এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে সরলীকরণ ও ঊন্নাসিক বলে মনে করেন। দামেস্কে যে ক্ষমতার পালাবদলের প্রক্রিয়া চলছে, তাতে যুক্ত হতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা।
মার্কিন সামরিক বাহিনী ও সিরিয়ায় দেশটির অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সিরিয়ান ইমারজেন্সি টাস্কফোর্স। প্রতিষ্ঠানটির মোয়াজ মোস্তফা নামের একজন সিরিয়ায় দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাপ্রবাহকে ‘অনির্বচনীয় ভালো’ বলে মনে করেন। তাঁর মতে, সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শুধু কোনো একটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ সীমিত করা ঠিক হবে না।
মোয়াজ মোস্তফা বিবিসিকে বলেন, ‘(সিরিয়ায়) ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অনেকগুলো গোষ্ঠী রয়েছে। কিছু গোষ্ঠী ধর্ম নিরপেক্ষ, কিছু রক্ষণশীল, কিন্তু তাঁরা সবাই একটি বিষয়ে একমত। সেটি হলো সিরিয়াকে আল-কায়েদা, আইএস, ইরান ও রাশিয়ার কবল থেকে মুক্ত করা।’