গাজায় বিতরণ করা বিতর্কিত সংস্থা জিএইচএফের ত্রাণের বাক্সে কী আছে
চার কৌটা টুনা মাছ, কয়েক প্যাকেট স্প্যাগেটি ও এক লিটার তেল।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মধ্যাহ্নের প্রচণ্ড গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর কপালে যেসব খাদ্যসামগ্রী জুটেছে, এটি তারই একটি নমুনা।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল পরিচালিত বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) দাবি করেছে, তারা গত মঙ্গলবার থেকে অসহায় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ১৪ হাজার বাক্স খাবার বিতরণ করেছে। ত্রাণ সংস্থাগুলোর মতে, চলমান গণ-অনাহার মোকাবিলায় এই সংখ্যা একেবারেই যৎসামান্য।
গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট একটি সংগঠন। গাজা উপত্যকায় ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নিতে সংগঠনটিকে ইসরায়েল অনুমোদন দিয়েছে।
নতুন এই ত্রাণব্যবস্থা খাদ্য বিতরণ–ব্যবস্থাকে মাত্র কয়েকটি কেন্দ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। এসব কেন্দ্র আবার পাহারা দেন বেসরকারি মার্কিন নিরাপত্তা কর্মীরা। এ ব্যবস্থা জাতিসংঘ নেতৃত্বাধীন ত্রাণ সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বিতরণ কার্যক্রম কেড়ে নিতে চায়।
জাতিসংঘ ও অন্যান্য প্রধান মানবিক সংস্থা বারবার এই নতুন ত্রাণব্যবস্থার সমালোচনা করেছে এবং বলেছে, এটি গাজার ২১ লাখ মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারবে না। উল্টো সেখানকার মানুষের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে ইসরায়েলকে খাদ্যনিয়ন্ত্রণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দেবে।
ত্রাণের একটি বাক্স পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করার সময় কমপক্ষে তিনজন ফিলিস্তিনি নিহত হন। আহত হন আরও অনেক ক্ষুধার্ত পুরুষ, নারী ও শিশু।
সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলেছে, ত্রাণ সংগ্রহ করতে আসা মানুষের সঙ্গে ইসরায়েলি সেনাদের সংঘর্ষ বেধে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
তবে এসব সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে ইসরায়েল উল্টো হামাসের বিরুদ্ধে ত্রাণ চুরির অভিযোগ তুলেছে। দেশটি বলেছে, হামাস যাতে ত্রাণ সরিয়ে নিতে না পারে, সে জন্য গাজায় খাদ্য প্রবেশে অবরোধ আরোপ করেছে তারা।
কিন্তু ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক সিন্ডি ম্যাককেইন এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, অধিকাংশ লুট হওয়া ত্রাণ অসহায় ফিলিস্তিনিরাই নিচ্ছে।
সিন্ডি মার্কিন সম্প্রচার নেটওয়ার্ক সিবিসিকে চলতি সপ্তাহের শুরুতে বলেন, মানুষ মরিয়া হয়ে আছে। তারা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) ট্রাক আসতে দেখলেই ছুটে যায়। এর সঙ্গে হামাস বা কোনো ধরনের সংঘটিত অপরাধের কোনো সম্পর্ক নেই।
ইসরায়েল যে চারটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র চালুর ঘোষণা দিয়েছিল, তার মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র দুটি চালু হয়েছে। দুটিই দক্ষিণাঞ্চলের বিধ্বস্ত রাফায়। সেখান এখন খুব অল্প ফিলিস্তিনি বসবাস করেন।
কেবল প্রাণে বাঁচার জন্য ফিলিস্তিনিদের এসব এলাকায় যেতে হচ্ছে। গত মঙ্গলবার খান ইউনিস শহরের বাইরের তাঁবু থেকে হাজার হাজার মানুষ ইসরায়েলি সামরিক সীমা অতিক্রম করে বিতরণ কেন্দ্রে যান।
একপর্যায়ে রাফার এক কেন্দ্রে ফিলিস্তিনিরা ভিড় জমালে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ইসরায়েল তিন মাস ধরে ত্রাণের গাড়ি ঢুকতে না দেওয়ায় গাজার বাসিন্দাদের ওপর বিপর্যয় নেমে এসেছে। যেন তারই বহিঃপ্রকাশ এই বিশৃঙ্খলা।
সে সময় ত্রাণের একটি বাক্স পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করতে গিয়ে কমপক্ষে তিনজন ফিলিস্তিনি নিহত হন। আহত হন অনেক ক্ষুধার্ত পুরুষ, নারী ও শিশু।
ত্রাণ সংস্থাগুলো এসব কেন্দ্রের অবস্থান নিয়ে সমালোচনা করেছে। তারা বলেছে, সব কেন্দ্র এক জায়গায় বসিয়ে ফাউন্ডেশন মানবিক নীতিমালা লঙ্ঘন করছে। ফলে গাজার অন্যান্য এলাকার মানুষের এখানে এসে ত্রাণ সংগ্রহ করা অনেক কঠিন হবে।
চলতি বছরের শুরুতে সুইজারল্যান্ডে নিবন্ধিত এই গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের নেতৃত্ব নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, একদল বেসরকারি মার্কিন নিরাপত্তা কর্মী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও মানবিক সাহায্য কর্মকর্তারা এটি পরিচালনা করেন।
জিএইচএফের মতে, তাদের বিতরণ করা প্রতিটি খাবারের বাক্স প্রায় ছয়জন মানুষের জন্য সাড়ে তিন দিন চলার উপযোগী করে বানানো হয়েছে।
তবে কয়েকজন ফিলিস্তিনি মিডল ইস্ট আইকে বলেন, তাঁরা যে ত্রাণের বাক্স পেয়েছেন, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
প্রতিটি বাক্সে ভিন্ন ভিন্ন জিনিস ছিল। বেশির ভাগ বাক্সে যেসব খাদ্যসামগ্রী ছিল, তা হলো এক লিটার তেল, দুই কেজি চাল, চার কেজি আটা, এক কেজি শিম, চার কৌটা টুনা মাছ, এক কৌটা আঙুর পাতায় মোড়ানো খাবার, এক বোতল খুবানির (অ্যাপ্রিকট) জেলি, এক বাক্স বিস্কুট, ছয় প্যাকেট স্প্যাগেটি ও এক বাক্স টি-ব্যাগ।
মিডল ইস্ট আইয়ের সঙ্গে কথা বলা কোনো ফিলিস্তিনি বোতলজাত পানি, রান্নার জ্বালানি, ওষুধ, কম্বল, সাবান, কাপড় কাচার গুঁড়া সাবান বা নারীদের স্যানিটারি প্যাড পাননি।
এ ছাড়া কেউই শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় দুধ, খাবার, ডায়াপার ও বেঁচে থাকার জন্য জরুরি জিনিসপত্র পাননি বলে জানান।
বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আবদুল্লাহ সুলেমান আল-সাদুদিও এমন একটি ত্রাণের বাক্স সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। গত বুধবার তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু আমাদের সন্তানদের খাওয়াতে চাই। আমরা এখন কী করব? আমাদের প্রতি একটু দয়া করুন। এটা অন্যায়।’
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) প্রধান খুবই সামান্য এই খাদ্যসামগ্রী দেওয়ার নিন্দা জানিয়েছেন এবং ইসরায়েলের বিতরণব্যবস্থাকে ‘নৃশংসতা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা’ বলে অভিহিত করেছেন। গত বুধবার তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল প্রস্তাবিত ত্রাণ বিতরণ মডেলটি মৌলিক মানবিক নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’
চলতি বছরের শুরুতে সুইজারল্যান্ডে নিবন্ধিত এই গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের নেতৃত্ব নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, একদল বেসরকারি মার্কিন নিরাপত্তা কর্মী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও মানবিক সাহায্য কর্মকর্তারা এটি পরিচালনা করেন।
এই সংগঠনের দুর্ভিক্ষকবলিত এলাকায় খাদ্য বিতরণের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কে বা কারা এতে অর্থায়ন করছে, সেটিও স্পষ্ট নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয়েই এই ফাউন্ডেশনকে অর্থ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছে।