যুদ্ধবিরতির পরেই আবার হামলা, গাজায় নিহত ১৮৪

সাময়িক যুদ্ধবিরতি শেষে ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। হামলায় আহত শিশুদের উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। গতকাল দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায়ছবি: রয়টার্স

সাময়িক যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গাজায় আজ শনিবার দ্বিতীয় দিনের মতো সহিংসতা চলছে। গতকাল শুক্রবার ভোরে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে খান ইউনিসের পূর্বাঞ্চলে একের পর এক বোমা হামলা হয়েছে।

রয়টার্সের খবরে জানা যায়, ইসরায়েল বলেছে, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত গাজার ২০০টিরও বেশি সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত লক্ষ্যবস্তুতে তারা স্থল, বিমান ও নৌ হামলা চালিয়েছে।

গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ইসরায়েলি হামলায় ১৮৪ জন নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। এসব হামলায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫৮৯ জন। ২০টিরও বেশি ঘরবাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক কর্মকর্তা মার্টিন গ্রিফিথস বলেছেন, গাজাবাসীকে নিরাপদে সরে যেতে বলা হয়েছে।

এদিকে ইসরায়েলি হামলার জবাবে হামাস ও ইসলামিক জিহাদসহ গাজার স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলো ইসরায়েলের সীমান্তবর্তী এলাকা লক্ষ্য করে রকেট ও মর্টার হামলা চালিয়েছে। এ সময় ইসরায়েলের পাঁচ সেনা আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

গাজায় গত ২৪ নভেম্বর শুরু হওয়া চার দিনের যুদ্ধবিরতি দুই দফা বাড়িয়ে সাত দিন করা হয়। মেয়াদ বাড়াতে আন্তর্জাতিক চাপ ও হামাসের পক্ষ থেকে নতুন করে প্রস্তাব দেওয়া হলেও রাজি হয়নি ইসরায়েল।

ইসরায়েল সেনাবাহিনী গতকাল দাবি করেছে, ‘হামাস যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করেছে। পাশাপাশি তারা ইসরায়েলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। পরে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে আবারও হামলা শুরু করেছে।’

তবে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে হামলা শুরুর জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হামাস। সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ নেতা খলিল আল-হায়া আল-জাজিরাকে বলেন, জিম্মি মুক্তি নিয়ে সমঝোতায় তিনটি প্রস্তাব দিয়েছিল হামাস। তবে ইসরায়েল এতে রাজি হয়নি।

হামাসের এই নেতা আরও বলেন, ইসরায়েলের পক্ষ থেকেও জিম্মি নারী সেনাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে একটি তালিকা দেওয়া হয়। তাতে রাজি হয়নি হামাস। অন্যদিকে বয়োজ্যেষ্ঠ বন্দী বিনিময়ে ইসরায়েল রাজি হয়নি। এ ছাড়া জীবিত জিম্মি ব্যক্তিদের মুক্তির পাশাপাশি মৃত জিম্মি ব্যক্তিদের মরদেহ ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব দেয় হামাস। বিপরীতে ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শাতিলের মুক্তির বিনিময়ে কারামুক্ত হওয়া ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যাঁদের আবার আটক করা হয়েছে, তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। ইসরায়েল এতে রাজি হয়নি।

দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ার মধ্যে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা শুরু হলো। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানকালেই আবার শুরু হলো নতুন এ লড়াই। আগের দিন, গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের যুদ্ধকালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নেন ব্লিঙ্কেন। দৃশ্যত ওই বৈঠকে গাজায় নতুন করে হামলার বিষয়ে ইসরায়েলকে তিনি ওয়াশিংটনের ‘সবুজসংকেত’ দেন বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।

দক্ষিণ গাজায়ও হামলা

যুদ্ধবিরতি শেষে উত্তর গাজার পাশাপাশি দক্ষিণ গাজায়ও হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। এ ছাড়া দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহর ছেড়ে বাসিন্দাদের আরও দক্ষিণে রাফাহ এলাকায় সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রচারপত্র ফেলেছে ইসরায়েল বিমানবাহিনী। যদিও রাফাহ এলাকায় ইসরায়েলি হামলায় ছয় ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

গাজা নগরীতে অবস্থানরত এএফপির একজন সাংবাদিক বলেন, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান থেকে এখানে বেশ কয়েকটি হামলা চালানো হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি ড্রোনের শব্দ পাওয়া গেছে।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। ইসরায়েলের ভাষ্যমতে, এ হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। এ ছাড়া দুই শতাধিক ব্যক্তিকে ইসরায়েল থেকে ধরে গাজায় নিয়ে জিম্মি করে হামাস। জবাবে ওই দিন থেকেই গাজাকে অবরুদ্ধ করে নির্বিচার বোমা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। পরে গাজায় স্থল অভিযানও শুরু করে তারা।

গাজার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, অবরুদ্ধ এ উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত ১৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের ৭০ ভাগই নারী ও শিশু। এ ছাড়া গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার ১৭ লাখই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

গাজায় ইসরায়েলের টানা ৪৭ দিনের হামলার পর ২৪ নভেম্বর প্রথম দফায় চার দিনের যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এ যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করে কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্র। এরপর দুই দফায় মোট তিন দিন বাড়ানো হয় যুদ্ধবিরতির মেয়াদ।

সর্বসাকল্যে সাত দিনের যুদ্ধবিরতি চলাকালে হামাস ১০৫ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৮০ জন ইসরায়েলি নাগরিক ও অন্যরা বিদেশি। বিনিময়ে ২৪০ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল। এ ছাড়া যুদ্ধবিরতির আওতায় ত্রাণবাহী গাড়িগুলোকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ঢুকতে দিয়েছে।

যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর আহ্বান

গাজায় আবারও যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে, এমন আশা ব্যক্ত করে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘গাজায় আবারও সামরিক অভিযান শুরু হওয়ায় আমি অত্যন্ত মর্মাহত।’

আর ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘আমরা নিশ্চিতভাবে মানবিক যুদ্ধবিরতির মেয়াদ আরেক দফা বাড়ানোর খবরই পছন্দ করব।’ একই সঙ্গে জিম্মি রুশ নাগরিকদের মুক্তির প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

এদিকে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে মধ্যস্থতাকারী দেশগুলো। কাতার বলেছে, যুদ্ধবিরতি বিষয়ে নতুন করে সমঝোতায় পৌঁছাতে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে তারা। তবে লড়াই শুরু হওয়ায় এ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।