সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারত থেকে কেন ফিলিস্তিনবিরোধী ভুয়া তথ্য বেশি ছড়ানো হচ্ছে

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত স্বজনের মরদেহ নিতে হাসপাতালে এসেছেন দুই নারী, ১৬ অক্টোবর
ছবি: এএফপি

ইসরায়েলের সঙ্গে গাজার সংঘাত শুরুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফিলিস্তিনবিরোধী ও ইসলামবিদ্বেষী নানা ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। বিশেষ করে ইলন মাস্কের খুদে বার্তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’–এ (সাবেক টুইটার) এ ধরনের ভুয়া তথ্য বেশি ছড়ানো হচ্ছে।

কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালানোর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আর এসব অ্যাকাউন্ট যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁদের বেশির ভাগই উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।

এসব ভুয়া তথ্যের মধ্যে একটি হচ্ছে এমন, হামাস এক শিশুকে অপহরণ করেছে। আরেকটি হচ্ছে, ট্রাকের পেছনে এক ইসরায়েলি তরুণকে শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। নীলরঙা ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট থেকে এসব ভুয়া খবর ভাইরাল করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এক্স–এ আরেকটটি বার্তা অসংখ্য মানুষ শেয়ার করেছেন, যাতে দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চালাচ্ছে হামাস।

ইসলামবিদ্বেষী ভুয়া তথ্য বেশি

ভারতের অন্যতম ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ‘বুম’ অসংখ্য ভারতীয় ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট খুঁজে পেয়েছে, যেসব অ্যাকাউন্টের ব্যবহারকারীরা ভুয়া তথ্য প্রচারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বুম বলছে, এসব ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত ভুয়া তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে ফিলিস্তিনকে লক্ষ্য করে নেতিবাচক বা ইসরায়েলকে সমর্থন করে ভুয়া তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।

যোগাযোগমাধ্যম এক্স–এর এসব অ্যাকাউন্ট থেকে এমনভাবে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে ফিলিস্তিনিদের মৌলিকভাবে নৃশংস হিসেবে চিত্রায়িত করা হচ্ছে।

যেমন একটি এক্স অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে, যাতে দাবি করা হয়েছে, ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা তরুণীদের যৌনদাসী বানাতে অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন। আদতে ওই ভিডিও জেরুজালেমের একটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের, যারা শিক্ষা সফরে বা অন্য কোথাও আনন্দভ্রমণে যাচ্ছে। নিম্নমানের এবং অস্পষ্ট ওই ভিডিও ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মেয়েরা বেশ খোশমেজাজে একে অন্যের সঙ্গে আলাপ করছে এবং ফোনেও কথা বলছে।

এই ভিডিও আপলোড করার পর এটি হাজার হাজার ব্যক্তি শেয়ার করেছেন। এটি দেখেছেন প্রায় ৬০ লাখ ব্যবহারকারী। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে এসব ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে বা যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ভারতের নাগরিক।

এমনকি এই ভিডিও ‘অ্যানগ্রি স্যাফ্রন’ বা ‘ওএসআইএনটি’ নামক টেলিগ্রাম চ্যানেলেও শেয়ার করা হয়েছে। এসব চ্যানেলও ভারত থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে, যাতে দাবি করা হয়েছে, হামাস একটি ইহুদি শিশুকে অপহরণ করেছে। কেবল একটি পোস্টে এই ভিডিও ১০ লাখের বেশি ব্যবহারকারী দেখেছেন। এমন ভুয়া ১০টি ভিডিওর মধ্যে ৭টিই ভারতভিত্তিক অ্যাকাউন্ট থেকে ছড়ানো হয়েছে। এসব ব্যবহারকারীর অনেকে তাঁদের প্রোফাইল ছবি হিসেবে ভারতের পতাকা দিয়ে রেখেছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স–এ এই ৭টি ভিডিও ৩০ লাখের বেশি ব্যবহারকারী দেখেছেন। এই ভিডিও গত সেপ্টেম্বরে ধারণ করা হয়েছিল। গাজায় আদৌ এ ধরনের কোনো অপহরণের ঘটনা ঘটেনি।

ইসলামবিদ্বেষ, ভারত ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম

এসব ভুয়া ভিডিও আপলোড বা শেয়ার করা ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন সময় এক্স–এ মুসলিমবিরোধী নানা মন্তব্য পোস্ট করেছেন।

‘মি. সিনহা’—এই নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও প্রচার করেছে, যাতে দেখা যায়, হামাস একটি শিশুর শিরশ্চেদ করেছে। ওই পোস্টে ‘#IslamIsTheProblem’ (ইসলামইজদ্যপ্রবলেম) এমন হ্যাসট্যাগ দেওয়া হয়েছে।

আরেকটি অ্যাকাউন্টে আরেকটি ভুয়া ভিডিও দেওয়া হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, ‘একটি মুসলিম মেয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণের পরবর্তী সময়ে সুখী জীবন যাপন করেন। আর হিন্দু মেয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তাঁর জীবন বাক্সবন্দী বা ফ্রিজবন্দী হয়ে যায়।’ একই অ্যাকাউন্টে ফিলিস্তিনিদের যৌনদাসী বানাতে মেয়েদের অপহরণের সেই ভুয়া ভিডিওটিও দেওয়া হয়েছে।

অন্যান্য এক্স অ্যাকাউন্টে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আরও স্পষ্ট ও তীব্রভাবে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনাসদস্যের নামে বানানো আরেকটি অ্যাকাউন্টে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলকে অবশ্যই ফিলিস্তিনকে এই গ্রহ থেকে মুছে দিতে হবে।’

এটি আর কোনো গোপন বিষয় নয় যে ভারতে ইসলামভীতি সমস্যা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইসলামবিদ্বেষ ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক ইসলামিক কাউন্সিল অব ভিক্টোরিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামবিদ্বেষী বেশির ভাগ টুইট ভারত থেকে করা হচ্ছে বলে শনাক্ত হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ সামনে চলে এসেছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটি বেশি দেখা যাচ্ছে। অনলাইনে এসব ঘৃণ্য বক্তব্য ‘বিজেপির আইটি সেল’ থেকে প্রচার করা হচ্ছে। এই সেল থেকে আগেও ঘৃণ্য বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে।

স্বাতী চতুর্বেদি তাঁর ‘আই অ্যাম আ ট্রল’ বইয়ে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজেপির বাহিনী নিয়ে আলোচনা করেছেন। চতুর্বেদির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, এমন একজন হচ্ছেন সধভি খোসলা। তিনি বলেন, বিজেপির একটি স্বেচ্ছাসেবী নেটওয়ার্ক আছে, যারা তাদের মিডিয়া সেলের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে থাকে। ওই সেলের অনুমোদিত দুটি সংগঠন আছে, যারা বিজেপির সমালোচকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রল করে থাকে।

খোসলা বলেন, অব্যাহতভাবে ‘ইসলামবিদ্বেষ, ঘৃণামূলক বক্তব্য ও দৈন্য’ দেখে তিনি বিজেপির ‘আইটি সেল’ ত্যাগ করেছেন। তাঁকেও তাদের এসব বক্তব্য প্রচার করতে হতো।

নিখুঁত ঝড়: মাস্ক, বিজেপি এবং #গাজাআন্ডারঅ্যাটাক

বিজেপির আইটি সেলের ইসলামভীতি সমস্যা থাকতে পারে, তাদের ভুয়া তথ্য প্রচারের সমস্যাও থাকতে পারে। বিশেষ করে এখন গাজা সংঘাত ঘিরে ভুয়া তথ্য প্রচার করছে তারা।

ভারতের অলাভজনক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান অল্টনিউজের সহপ্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা এক্স–এ এক বার্তায় বলেন, ‘ভুয়া তথ্য প্রচারের নায়কেরা এখন ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তায় এসব ভুয়া তথ্য প্রচার করছে। আশা করি, বিশ্ব এখন উপলব্ধি করবে, উগ্রপন্থীরা কীভাবে ভারতকে বিশ্বের ভুয়া তথ্যের রাজধানী বানিয়ে ফেলেছে।’

ইলন মাস্কের এক্স অধিগ্রহণ এবং এই প্ল্যাটফর্মে মিথ্যা তথ্য প্রচার প্রতিরোধে তাঁর সিদ্ধান্ত অন্যান্য বৃহৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করবে, এমনটাই আশা করা হয়েছিল। মেটা ও ইউটিবের মতো প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান প্রতিশ্রুতি পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে। তারা ভুয়া তথ্য নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হলে তাদের প্ল্যাটফর্মে ঘৃণামূলক বক্তব্য, ভুয়া তথ্য ও অন্যান্য ক্ষতিকর তথ্য প্রচার কমে আসতে পারে।

ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর ঝাঁকে ঝাঁকে ভুয়া তথ্য প্রচার করা শুরু হয়। এ নিয়ে গত সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইলন মাস্ককে সতর্ক করেছে।

পশ্চিমাদের ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন, বৃহৎ প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের ভুয়া তথ্য নিয়ন্ত্রণে অনীহা এবং ভারত থেকে উগ্রপন্থীদের ইসলামবিদ্বেষী ভুয়া তথ্য প্রচার গাজা সংকটকে ফিলিস্তিন ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করেছে।