স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ অধিকার

ইসরায়েলের দখল করা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড নিয়ে আজ বুধবার তৃতীয় দিনের শুনানিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের বিচারকেরা। দ্য হেগ, নেদারল্যান্ডস, ২১ ফেব্রুয়ারিছবি: রয়টার্স

বিদেশি নিপীড়ন প্রতিরোধে শক্তি প্রয়োগ এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ফিলিস্তিনি জনগণের পূর্ণ অধিকার বলে উল্লেখ করেছে চীন। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁদের ন্যায়সংগত চাওয়ার প্রতি অব্যাহতভাবে সমর্থন জানিয়ে যাওয়ার কথাও জানিয়েছে দেশটি।

ইসরায়েলের দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গতকাল চতুর্থ দিনের মতো শুনানি হয়েছে। এতে চীনের প্রতিনিধি এসব কথা বলেন। এই দিন চীনসহ ১২টি দেশের প্রতিনিধিরা তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

শুনানিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন উপদেষ্টা মা সিনমিন বলেন, চীন ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য অধিকার পুনরুদ্ধারে তাঁদের ন্যায়সংগত চাওয়াকে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে আসছে।

সিনমিন বলেন, ‘চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং একাধিক অনুষ্ঠানে জোর দিয়ে বলেছেন, একটি সমন্বিত যুদ্ধবিরতি এবং আলোচনার মাধ্যমে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ভিত্তিতে ফিলিস্তিন প্রশ্নের দ্রুত মীমাংসার আহ্বান জানায় চীন।’

চীনের প্রতিনিধি আরও বলেন, আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ে বিদেশি নিপীড়ন প্রতিরোধে শক্তি প্রয়োগ এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ফিলিস্তিনি জনগণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আহ্বানে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নির্দেশনা ও মতামত দিতে এ শুনানি চলছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে শুরু হওয়া এ শুনানি ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। এতে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশসহ অর্ধশতাধিক দেশ ও তিনটি সংস্থা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছে। এর সঙ্গে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার অভিযোগে আইসিজেতে করা দক্ষিণ আফ্রিকার মামলার যোগসূত্র নেই।

যুক্তরাষ্ট্রে বিপরীত অবস্থানে চীন

আগের দিন আইসিজের শুনানিতে অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ফিলিস্তিনের দখল করা ভূখণ্ড ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ইসরায়েলের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। বেশির ভাগ দেশের প্রতিনিধিরা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের দখলদারত্ব অবসানের দাবি জানালেও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আদালতে যুক্তি তুলে ধরে।

এ ছাড়া আদালতের যেকোনো ধরনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সংঘাত সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বিঘ্নিত হবে বলেও যুক্তি তুলে ধরেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আইন উপদেষ্টা রিচার্ড ভিসেক।

তবে চীনের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের একেবারেই বিপরীত। দেশটি বলছে, আদালতের মতামত ভবিষ্যতে এই সমস্যার সমাধানে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এতে বর্তমান বা ভবিষ্যৎ আলোচনা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হবে না।

আল-জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেছেন, আইসিজেতে চীনের দেওয়া বক্তব্যে দখলদারত্বের শিকার হিসেবে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের অধিকারের বিষয়টি বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা সচরাচর এ ধরনের কথা শুনি না।

‘আত্মরক্ষার সীমা ছাড়িয়েছে ইসরায়েল’

শুনানিতে অংশ নিয়ে জাপান দুই রাষ্ট্র সমাধানের ওপর জোর দিয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা তোমোহিরো মিকানাগি বলেছেন, তাঁর দেশ দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে বিশ্বাস করে, যেখানে ইসরায়েল এবং ভবিষ্যৎ স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র শান্তি ও মর্যাদার সঙ্গে পাশাপাশি থাকবে। এটি উভয়ের জন্য একমাত্র কার্যকর পথ।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হামলার নিন্দা জানিয়ে গতকাল শুনানিতে বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন আয়ারল্যান্ডের প্রতিনিধি অ্যাটর্নি জেনারেল রোসা ফ্যানিং। এরপর তিনি আদালতকে স্মরণ করিয়ে দেন, আত্মরক্ষায় বল প্রয়োগ যে প্রয়োজন এবং মাত্রার চেয়ে বেশি হবে না তা ঠিক করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক আইন।

রোসা বলেন, হামাসের হামলার সামরিক জবাব দিতে গিয়ে ইসরায়েল সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করে আয়ারল্যান্ড। তাঁর দেশ বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে আসছে।

শুনানিতে ইরাকের প্রতিনিধি শিয়া আল-বারাক গাজায় চলমান ‘হত্যাযজ্ঞ’ বন্ধে আইসিজের প্রতি আহ্বান জানান। এ ক্ষেত্রে গাজায় গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড থামাতে দক্ষিণ আফ্রিকার করা মামলায় আইসিজের দেওয়া অন্তর্বর্তী আদেশ নজরে আনেন তিনি।

ইরাকের প্রতিনিধি তাঁর বক্তব্যে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বিমান ও রকেট হামলাসহ ইসরায়েলের নৃশংস কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এসব কর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধের আওতায় পড়ে। এটি যুদ্ধের আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন। ইসরায়েলকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।

শুনানিতে অন্যান্য প্রসঙ্গের সঙ্গে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারত্বের পরিস্থিতি তুলে ধরেন ইরানের প্রতিনিধি রাজা নাজাফি। এর মধ্যে রয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে চলা ইসরায়েলি দখলদারত্ব, দখলকৃত ভূখণ্ডের জনসংখ্যার ভারসাম্য পাল্টে দেওয়া, পবিত্র শহর জেরুজালেমের বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদায় পরিবর্তন আনা এবং বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ।

জর্ডানের প্রতিনিধি আইমান সাফাদি গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং সেখানে গণহত্যা সংক্রান্ত আইসিজেতে করা মামলার প্রসঙ্গ দিয়ে শুনানিতে বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন। তিনি বলেন, কোনো দেশকেই আইনের ঊর্ধ্বে থাকার সুযোগ দেওয়া যাবে না।

এ দিন আইসিজের শুনানিতে অংশ নেওয়া অন্য দেশগুলো হলো মালয়েশিয়া, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, লুক্সেমবার্গ ও মরিশাস।