ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দেখে একই সঙ্গে কেন ক্ষোভ ও উল্লাস ফিলিস্তিনিদের

যুদ্ধবিরতির সংবাদ শোনার পর গাজার ফিলিস্তিনিদের উল্লাস। মধ্য গাজার দেইর আল–বালাহ এলাকায়ছবি: এএফপি

দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে ইয়াহিয়া সিনওয়ারের (হামাসের সামরিক শাখার নিহত প্রধান) একসময়ের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের কাছে মানুষের ভিড়ে সকাল ৮টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন ৩২ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি আবু ইউসুফ। তাঁর কাঁধে বসে আছে চার বছরের সন্তান। হামাসের কাছ থেকে মুক্তি পেতে যাওয়া দুই ইসরায়েলি জিম্মিকে একনজর দেখতেই এমন অপেক্ষা তাঁর।

আবু ইউসুফের চারপাশে তাঁর মতোই অপেক্ষায় আরও হাজারও মানুষ। তাঁদের অনেকের সঙ্গে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সবুজ পতাকা ও আরেক সশস্ত্র সংগঠন প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদের কালো রঙের ব্যানার। কারও সঙ্গে ইসরায়েলের হামলায় নিহত লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহর ছবি। আরও আছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের নেতা আবদেল মালিক আল–হুথি ও ইসলামিক জিহাদের প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা ফাথি শাকাকির ছবিও।

আবু ইউসুফ বলেন, ‘দশকের পর দশক ইসরায়েলি কারাগারে থাকা বহু ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলি এই জিম্মিদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা দেখতে পেরে আমি গর্বিত।’

ইসরায়েলের সঙ্গে ১৫ মাস ধরে চলা হামাসের যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টায় ১৯ জানুয়ারি কার্যকর হয়েছে ঐতিহাসিক যুদ্ধবিরতি। এরই শর্ত হিসেবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে জিম্মি করা ব্যক্তিদের ধাপে ধাপে মুক্তি দিচ্ছে হামাস। বিনিময়ে ইসরায়েলের কর্তৃপক্ষ সেদেশের কারাগার থেকে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দিচ্ছে।

৪২ দিন মেয়াদের যুদ্ধবিরতিকালে হামাস ৩৩ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে। আর ইসরায়েল মুক্তি দেবে ১ হাজার ৬৫০ জনের মতো ফিলিস্তিনি বন্দীকে।

দশকের পর দশক ইসরায়েলি কারাগারে থাকা বহু ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলি জিম্মিদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা দেখতে পেরে আমি গর্বিত।
—আবু ইউসুফ, গাজার বাসিন্দা

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর গতকাল বৃহস্পতিবার তৃতীয় দফায় বন্দিবিনিময় শুরু হয়। হামাসের তরফে ২০ বছর বয়সী ইসরায়েলি সেনা আগাম বার্জারকে উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবির থেকে মুক্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ বিনিময়। এরপর খান ইউনিস থেকে মুক্তি দেওয়া হয় ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক আরবেল ইয়াহুদ, গ্যাদি মোসেস ও পাঁচ থাই নাগরিককে। জিম্মি হস্তান্তর অনুষ্ঠানের তদারকিতে ছিল ইসলামিক জিহাদের সশস্ত্র শাখা আল–কুদস ব্রিগেড।

একই দিন আরও পরের দিকে ইসরায়েল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ৩২ জনসহ মোট ১১০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয়। তাঁদের মধ্যে ৩০ জন শিশু–কিশোর।

আবু ইউসুফ বলছিলেন, জিম্মি হস্তান্তর অনুষ্ঠানের স্থানে সকাল সকাল আসতে তিনি তাঁর গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটারের বেশি হেঁটে এসেছেন। আর জিম্মিমুক্তির সাক্ষী হতে চার ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে।

আবু ইউসুফ বলেন, ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে জিম্মিদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা দেখে তাঁর মনে হচ্ছে ১৫ মাসের যুদ্ধ তিনি যা হারিয়েছেন, তা বৃথা যায়নি। তাঁর কথায়, ‘ইসরায়েলি হামলায় আমার দোতলা বাড়িটা গুঁড়িয়ে গেছে ও কয়েক স্বজন নিহত হয়েছেন। বন্দিবিনিময়ের দৃশ্য আমার এ ব্যথা কমাতে সহায়তা করেছে।’

আমরা এখানে এসেছি প্রতিটা দেশকে ধন্যবাদ জানাতে, যারাই আমাদের সমর্থন দিয়েছে; বিশেষ করে ইরান, (লেবাননের) হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনকে। তবে আমাদের ফিলিস্তিনবাসীর দৃঢ়তাই আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে আমাদের।
—ইয়াসমিন, জিম্মি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে আসা ফিলিস্তিনি তরুণী

যখন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও কালো রঙের বালাক্লাভা (মুখবন্ধনী) পরিহিত যোদ্ধাদের বহনকারী সাঁজোয়া পিকআপ ট্রাকগুলো আসছিল, তখন আবু ইউসুফ গর্বের সঙ্গে তাঁদের দিকে ইশারা করেন।

এই ফিলিস্তিনি বলছিলেন, ‘প্রতিরোধ যোদ্ধারা এখনো আছেন, তাঁরা দিব্যি বেঁচে আছেন ও হামলা চালানোর সক্ষমতা আছে। এ বন্দিবিনিময় এটাই মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, দখলদারেরা (ইসরায়েল) আমাদের গুঁড়িয়ে দিতে পারেনি।’

‘ফিলিস্তিনিদের দৃঢ়তা’

খান ইউনুসের জনাকীর্ণ ‘ফিফথ স্ট্রিট’–এ গতকাল ওই জিম্মি হস্তান্তর অনুষ্ঠানটি হয়। সিনওয়ারের বাড়িটাও এখানেই দাঁড়িয়ে। জিম্মিমুক্তি ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকতে আসা ফিলিস্তিনিদের অনেকে বিভিন্ন লেখা ও ছবিসংবলিত ব্যানার ওড়াচ্ছিলেন। এ ঘটনাকে সমবেত জনতার অনেকে ‘একটি প্রতীকী বিজয়’ হিসেবে দেখেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার তৃতীয় দফায় বন্দিবিনিময় শুরু হয়। হামাসের তরফে ইসরায়েলি সেনা আগাম বার্জারকে উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবির থেকে মুক্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ বিনিময়। এরপর খান ইউনিস থেকে মুক্তি দেওয়া হয় ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক আরবেল ইয়াহুদ, গ্যাদি মোসেস ও পাঁচ থাই নাগরিককে। জিম্মি হস্তান্তর অনুষ্ঠানের তদারকিতে ছিল ইসলামিক জিহাদের সশস্ত্র শাখা আল-কুদস ব্রিগেড।

ভিড়ের ভেতর দুই নারী হাতে লেখা সাইন দোলাচ্ছিলেন। ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দেওয়ায় এসব সাইনে ইরান, হিজবুল্লাহ ও হুথিদের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপনসূচক বক্তব্য লেখা ছিল। এ দুই নারীর একজন ২৮ বছরের তরুণী ইয়াসমিন। তাঁর সঙ্গে থাকা একটি ব্যানারে লেখা ছিল, ‘আমাদের পাশে যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, আমাদের এ বিজয় তাঁদেরই।’

ইয়াসমিন বলছিলেন, ‘আমরা এখানে এসেছি প্রতিটা দেশকে ধন্যবাদ জানাতে, যারাই আমাদের সমর্থন দিয়েছে; বিশেষ করে ইরান, (লেবাননের) হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনকে। তবে আমাদের ফিলিস্তিনবাসীর দৃঢ়তাই আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে আমাদের।’

অনুষ্ঠানটিতে এসেছিলেন কয়েক ডজন বিক্ষোভকারীও। তাঁরা জিম্মিদের হস্তান্তর করা দেখতে বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন।

গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার পরপরই চার ইসরায়েলি নারী জিম্মিকে মুক্তি দেন হামাসের যোদ্ধারা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এদিন জিম্মিদের হস্তান্তরে দুই ঘণ্টা দেরি হয়। তবে তা জনতার উৎসাহ নিস্তেজ করতে পারেনি। যে যেভাবে পেরেছেন ঘটনাস্থল ও অনুষ্ঠানের দৃশ্য ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। কেউবা দিয়েছেন মুহুর্মুহু বিজয়সূচক স্লোগান।

খান ইউনিসে দুই ইসরায়েলি জিম্মিকে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) হাতে তুলে দেওয়া হয়। এর আগে তাঁদের কড়া পাহরায় নিয়ে আসেন আল–কুদস ব্রিগেডের মুখোশ পড়া যোদ্ধারা। এ সময় ছবি তুলতে তাঁদের সামনে হুড়মুড়িয়ে পড়েন পথচারীরা।

মোহাম্মদ নামে ২২ বছরের এক তরুণ এ সময় চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আরবেল (মুক্তি পাওয়া ইসরায়েলি জিম্মিদের একজন), তুমি আমাদের অনেক ভোগান্তির কারণ হয়েছ।’ এই ফিলিস্তিনি মূলত আরবেল ইয়াহুদের মুক্তি নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক এবং এ নিয়ে মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে অচলাবস্থা ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হতাশা তৈরি হওয়ার ঘটনাকেই ইঙ্গিত করছিলেন।

ইসরায়েল বলেছে, ইয়াহুদকে গত শনিবার মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় তাঁকে মুক্তি না দেওয়ায় ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। পাশাপাশি গাজার দক্ষিণ থেকে উত্তরে ফিলিস্তিনিদের নিজ বাড়িঘরে ফিরতে বাধার সৃষ্টি করে দেশটি। পরে এ নিয়ে দুপক্ষ এক সমঝোতায় পৌঁছায়। এতে বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তাঁদের বিধ্বস্ত বাড়িঘরে ফিরতে সক্ষম হন।

এ ঘটনাই মনে করিয়ে দিয়ে তরুণ ফিলিস্তিনি মোহাম্মদ বলছিলেন, ‘(আরবেল) যাও তোমার বাড়িতে। তোমাকে ছাড়াই আমরা আরও ভালো থাকব।’

উল্লেখ্য, যে যুদ্ধ আর বন্দিবিনিময় নিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এত ক্ষোভ আর উল্লাস, তার জন্য কম মূল্য চোকাতে হয়নি তাঁদের। ১৫ মাসের এ যুদ্ধে পুরো গাজা এক ভুতুড়ে উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলের নারকীয় তাণ্ডবে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৭ হাজার ৩৫ ফিলিস্তিনি, আহত ১ লাখ ১১ হাজার ৯১ জন।