এরদোয়ানের সামনে যত চ্যালেঞ্জ

শাসনকাল পাঁচ বছর বাড়িয়ে নিলেন এরদোয়ান। এবার দায়িত্ব পালন সহজ হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিজয় ঘোষণার পর তাঁর ছবি নিয়ে দলীয় সদর দপ্তরের সামনে সমর্থকদের উল্লাস। গত রোববার ইস্তাম্বুল শহরেছবি: এএফপি

তৃতীয় মেয়াদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এর মধ্য দিয়ে নিজের দুই দশকের শাসনকাল আরও পাঁচ বছরের জন্য বাড়িয়ে নিলেন তিনি। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের আগে কয়েক দফায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একে পার্টির এই নেতা।

তবে এই মেয়াদে দায়িত্ব পালন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জন্য এতটা মসৃণ হবে না। তাঁর সামনে রয়েছে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি টেনে তোলা থেকে শুরু করে মিত্রদের সঙ্গে চলা কূটনৈতিক স্থবিরতা কাটানোর মতো অনেক চ্যালেঞ্জ।

মূল্যস্ফীতি লাগাম টেনে ধরা

তুরস্কের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল অর্থনীতি, বিশেষ করে নাগালের বাইরে চলে যাওয়া মূল্যস্ফীতি। জীবনযাত্রার ব্যয়–সংকটে ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় দেশটির নাগরিকদের। এপ্রিল মাসে তুরস্কের বার্ষিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৪০ শতাংশে যা গত বছর ৮৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকে বলে সরকারিভাবেই বলা হয়।

এরদোয়ানের অর্থোডক্স নীতি নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। সুদের হার কম রাখলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে মনে করেন তিনি।

গত দুই বছরে তুরস্কের মুদ্রা লিরা অর্ধেকের বেশি মান হারিয়েছে। গত শুক্রবার ১ ডলারের বিনিময়ে ২০ লিরা লেনদেন হয়। যদিও ভোটের আগে লিরার মানের পতন ঠেকাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে।

ন্যাটো ইস্যু

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয় সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। কিন্তু ফিনল্যান্ডের যোগদানের বিষয়টি অনুমোদন করলেও সুইডেনের বিষয়টি আটকে দেয় ন্যাটো সদস্য তুরস্ক।

ন্যাটোর সদস্য হতে সব সদস্যদেশের সর্বসম্মত অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। তবে নিষিদ্ধঘোষিত কুর্দি জঙ্গিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীদের হস্তান্তরের শর্তে সুইডেনের সদস্যপদ আটকে দেয় তুরস্ক। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রদের সঙ্গে তিক্ততা তৈরি হয় আঙ্কারার। তারা উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষায় আছে, সুইডেনের ন্যাটো সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা তুলে নেবেন এরদোয়ান।

সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন

এরদোয়ান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উৎখাতে বিরোধীদের সমর্থন দিলে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। সিরিয়ায় দীর্ঘ মেয়াদের এই গৃহযুদ্ধে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী তুরস্কে আশ্রয় নেয়।

তুরস্কে সিরীয় শরণার্থীবিরোধী মনোভাব এখন তুঙ্গে। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে এরদোয়ানের বিরোধী শিবির শরণার্থী প্রত্যাবাসনকে বড় ইস্যু করে। এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছেন এরদোয়ানও।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে আসছেন এরদোয়ান। তবে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় চলা সংলাপ এখন পর্যন্ত দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে আরব প্রতিবেশী নেতাদের সঙ্গে নতুন করে দেখা যাচ্ছে বাশার আল-আসাদকে।

গৃহযুদ্ধের কারণে পালিয়ে আসা ৩০ লাখেরও বেশি সিরীয় শরণার্থীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে চায় তুরস্ক। কমপক্ষে ১০ লাখ শরণার্থীকে স্বেচ্ছায় ফেরত পাঠাতে উত্তর সিরিয়ায় শত শত বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এরদোয়ান সরকার। চলতি মাসে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।

প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও তাঁর স্ত্রী আরমিন এরদোয়ান সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। গতকাল আঙ্কারার প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদে
ছবি: এএফপি

ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পুনর্গঠন

গত ৬ ফেব্রুয়ারির ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল এলাকা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কয়েকটি শহর দৃশ্যত মাটির সঙ্গে মিশে যায়। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন।

বেঁচে যাওয়া হাজারো মানুষ এখনো বাস্তুচ্যুত। ভূমিকম্পের ভয়াবহতার দুর্বিষহ স্মৃতি নিয়ে এখনো অনেক মানুষ তাঁবু কিংবা অস্থায়ী আবাসে অবস্থান করছেন। তাঁদের কেউ কেউ খাদ্য, পানি, বস্ত্র ও ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল।

সরকারিভাবে বলা হয়েছে, এই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার। ব্যাপক পুনর্গঠন প্রচেষ্টা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা

গত রোববার ছিল দ্বিতীয় দফার ভোট গ্রহণ। এবার ৯৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ ভোট গণনা শেষে এরদোয়ান পেয়েছেন ৫২ দশমিক ১৬ শতাংশ ভোট। আর কিলিচদারওলু পেয়েছেন ৪৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট।

এবারের নির্বাচনে ৫২ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পেয়ে আরও পাঁচ বছর দেশ শাসন করবেন এরদোয়ান। কিলিচদারওলুর সঙ্গে ভোটের ব্যবধান ছিল বেশ কম। এর অর্থ হলো, তুরস্কের প্রায় অর্ধেক ভোটার ব্যালটে এরদোয়ানের কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেননি। নির্বাচন এবং ভোটের ফলাফলের এই চিত্র তুরস্কের সমাজে বিদ্যমান বিভাজনের দৃশ্যপট সামনে তুলে ধরেছে।