হুতিদের হামলায় সৌদি যুবরাজের লোহিত সাগর বন্দর পরিকল্পনা কি ভেস্তে যাবে

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানরয়টার্সের ফাইল ছবি

মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব তেলের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বৈচিত্র্যময় অর্থনীতি গড়ে তোলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে লোহিত সাগরের বন্দরগুলোতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলা সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষায় বড় ধাক্কা দিয়েছে।

২০১৪ সালে চালু হওয়া কিং আবদুল্লাহ বন্দরে ২০২৩ সালে ১৮৮টি কনটেইনারবাহী জাহাজ এসেছিল। ২০২৪ সালে তা কমে ৫৯টিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এই জাহাজ আসার পরিমাণ প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মাত্র ৫১টি জাহাজ এসেছে। এমন তথ্য দিয়েছে জাহাজ পর্যবেক্ষণ সংস্থা মেরিন ট্রাফিক।

২০১৪ সালে যখন কিং আবদুল্লাহ বন্দর চালু হয়, তখন এর পেছনে দুটি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, সৌদি সরকার মনে করেছিল, লোহিত সাগরের বাণিজ্য রুটে অবস্থিত বন্দরটি বড় জাহাজ থেকে পণ্য নামিয়ে ছোট জাহাজে তুলে চূড়ান্ত গন্তব্যে পাঠানোর মাধ্যমে ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবসা থেকে আয় এনে দেবে। দ্বিতীয়ত, তারা এটিকে কিং আবদুল্লাহ অর্থনৈতিক অঞ্চলে যাতায়াতের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। এখানে বিদেশি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারখানা চালু করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

বন্দরের দুই কর্মকর্তা বলছেন, কিং আবদুল্লাহ বন্দরের মাধ্যমে ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবসার পরিমাণ অনেক কমে গেছে। কারণ, আন্তর্জাতিক জাহাজ কোম্পানিগুলো হুতিদের হামলার কারণে লোহিত সাগর এড়িয়ে চলছে।

একজন কর্মকর্তা বলেন, কিং আবদুল্লাহ বন্দরের ব্যবসা এতই খারাপ যে মালিকেরা চাইলেও এখন কনটেইনার টার্মিনাল বিক্রি করতে পারবেন না।

সৌদির এ বন্দর একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন, যেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ইমার এবং হুটা মেরিন ওয়ার্কসের সঙ্গে যুক্ত। সৌদির সরকারি বিনিয়োগ তহবিল (পিআইএফ) ২০২১ সালে ইমার ‘দ্য ইকোনমিক সিটি’-এর ২৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়।

মেরিন ট্রাফিকের তথ্যানুযায়ী, সৌদি আরবের জেদ্দা ইসলামিক বন্দরেও জাহাজ চলাচল কমেছে। তবে সেখানে প্রভাব তুলনামূলক কম। ২০২৩ সালে সেখানে ৪০০টি কনটেইনার জাহাজ এসেছিল। ২০২৪ সালে তা প্রায় ১৪ শতাংশ কমে ৩৪৪টিতে নেমে এসেছে।

নির্বাহীরা বলছেন, বন্দরটি মূলত সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে আমদানি পণ্যের প্রধান প্রবেশপথ হওয়ায় সেখানে ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর নির্ভরতা কম। তাই ব্যবসা কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে।

তবে কর্মকর্তারা বলছেন, এশিয়া থেকে আসা কনটেইনারবাহী জাহাজগুলো এখন সৌদি আরবের পূর্ব উপকূলের দাম্মামের কিং আবদুল আজিজ বন্দরে ভিড়ছে। এক কর্মকর্তা বলেন, বিওয়াইবিডি প্রতিষ্ঠানের গাড়িগুলো এখন দাম্মামে যাচ্ছে, লোহিত সাগরের বন্দরে নয়। ওটা এখন নিরাপদ।

হুতিরা গাজার অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা শুরু করে। এ হামলায় সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে মিসরের। কারণ, সুয়েজ খাল থেকে মিসর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। এখন অনেক জাহাজ হুতিদের হামলা এড়াতে আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত ঘুরে যাচ্ছে। ফলে সুয়েজ খাল দিয়ে চলাচল অনেক কমে গেছে।

ক্ষতির মুখে পড়েছে সৌদি আরবও। সৌদির বন্দর ব্যবসায় এই বড় পরিবর্তন প্রমাণ করছে, হুতিদের হামলার প্রভাব রিয়াদের জন্যও অপ্রত্যাশিতভাবে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সৌদি আরবের জেদ্দা ইসলামিক সমুদ্রবন্দর
ফাইল ছবি: এএফপি

যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ভিশন-২০৩০ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য তেলনির্ভরতা কমিয়ে পর্যটন ও শিল্পায়নের মাধ্যমে নতুন অর্থনৈতিক খাত গড়ে তোলা। এর একটি প্রধান অংশ ছিল লোহিত সাগর উপকূলকে ঘিরে বিলাসবহুল হোটেল ও কারখানা নির্মাণের মাধ্যমে অর্থনীতিকে নতুন রূপ দেওয়া।

বিশেষজ্ঞ রবার্ট মোগেলনিকি বলেন, ভিশন-২০৩০ পরিকল্পনায় লোহিত সাগর উপকূল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই খাতের সঙ্গে তেল-গ্যাসের সম্পর্ক নেই। সৌদি আরবের অর্থনৈতিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে লোহিত সাগর উপকূল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তবে বন্দর নির্মাণে সৌদি আরব ইতিমধ্যে বেশ কিছু সমস্যা মোকাবিলা করছে। কারণ, ট্রান্সশিপমেন্ট ব্যবসা থেকে আয়ের লক্ষ্যে আমিরাত ও মিসরের সঙ্গে মিলে তারা অনেক বন্দর নির্মাণ করেছে। কিন্তু বাস্তবে পণ্যের পরিমাণ সেই বিনিয়োগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, সৌদির মেগা প্রকল্প ‘নিওম’ ছোট করে আনা হচ্ছে। কারণ, এ প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম এবং তেলের দামও কমে গেছে।

এ অবস্থার মধ্যেই হুতিদের হামলা নতুন এক ঝামেলার সৃষ্টি করেছে। হুতিরা জানুয়ারিতে কিছুদিন হামলা বন্ধ রেখেছিল। গাজায় তখন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধবিরতি চলছিল। মার্চে ইসরায়েল একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি প্রত্যাহারের পর হুতিরা ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে শুরু করে। অবশ্য তখন তারা সমুদ্রপথে হামলা করেনি।

তবে এই গ্রীষ্মে হুতিরা আবার সমুদ্রপথে হামলা শুরু করেছে। তারা গ্রিসের মালিকানাধীন দুটি জাহাজ আক্রমণ করে ডুবিয়ে দিয়েছে। জাহাজমালিকেরা এখন আবার আফ্রিকার চারপাশ ঘুরে যাতায়াতের মতো লম্বা পথ বেছে নিচ্ছেন। কারণ, এতে তাঁদের আয়ও বেশি এবং হুতিদের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিও কম।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বছর হুতিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করেন। সৌদি আরব তখন ট্রাম্পকে অনুরোধ করেছিল, যেন তিনি মে মাসে উপসাগর সফরের আগে হামলা বন্ধ করেন।

এই গ্রীষ্মে ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে মিসরের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মার্কিন কর্মকর্তাদের জানান, হুতিদের থামানোর একমাত্র উপায় হলো গাজায় যুদ্ধবিরতি। আর সামরিক অভিযান আবার শুরুর বিষয়ে কোনো পক্ষেরই আগ্রহ নেই।