১২ দিনের ‘ঝড়ে’ বাশারের পতন, মস্কোয় আশ্রয়

বাশারের বিদায়ের মধ্য দিয়ে দেশটিতে আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে।

সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদফাইল ছবি: রয়টার্স

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ায় দুই যুগের আলোচিত-সমালোচিত শাসক বাশার আল-আসাদের পতন হয়েছে। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের ঝোড়ো অভিযানের মাত্র ১২ দিনের মাথায় ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। রাশিয়ার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। মস্কোয় বাশার ও তাঁর পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক এখন বাশারবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে। দামেস্ক শহরের একটি মসজিদে দেওয়া ভাষণে বিদ্রোহী যোদ্ধাদের প্রধান নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি বলেছেন, ‘এই বিজয় সিরিয়ার সব মানুষের।’ এর আগে এক বিবৃতিতে জোলানি বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের আগপর্যন্ত অন্তর্বর্তী দায়িত্বে থাকবেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-জালালি।

আরও পড়ুন

বাশার সরকারের পতনের পর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গুলি, ভাঙচুর ও লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। এই পরিস্থিতিতে সেখানে কারফিউ জারি করেছেন বিদ্রোহীরা। এমন অবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিরিয়ায় ক্ষমতায় ছিলেন বাশারের বাবা হাফিজ আল-আসাদ। বাবার মৃত্যুর পর ক্ষমতার মসনদে বসেন বাশার। প্রথমে সংস্কারের পথ ধরে এগোলেও পরে বাবার মতোই কর্তৃত্ববাদী শাসকে পরিণত হন। মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধীদের কঠোর নিপীড়নসহ নানা অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এর জের ধরে ‘আরব বসন্তের’ সময় ২০১১ সালে বাশারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। ধীরে ধীরে তা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। সেই গৃহযুদ্ধই চলছিল প্রায় ১৩ বছর ধরে।

গৃহযুদ্ধ ও রক্তপাতের ধারাবাহিকতায় গত ২৭ নভেম্বর নতুন করে অভিযান শুরু করেন বিদ্রোহী যোদ্ধারা। এই অভিযানে নেতৃত্ব দেয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। সঙ্গে ছিল ছোট-বড় আরও কয়েকটি গোষ্ঠী। অভিযান শুরুর চার দিনের মাথায় ৩০ নভেম্বর সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখলে নেয় তারা। বিদ্রোহীদের অভিযানের মুখে কৌশলগত বিভিন্ন অবস্থান থেকে একের পর এক পালিয়ে যেতে থাকেন বাশারের সরকারি বাহিনীর সদস্যরা।

এ সময় বাশার অবশ্য বিদ্রোহীদের ‘নির্মূল’ করার হুমকি দিয়েছিলেন। বাশার সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া বিদ্রোহীদের ওপর দফায় দফায় বিমান হামলাও চালিয়েছে। আলেপ্পো থেকে বিদ্রোহীদের দামেস্ক যাওয়া ঠেকাতে মধ্যবর্তী হামা শহরে যোদ্ধা পাঠিয়ে সরকারি বাহিনীকে সহায়তা করেছে বাশারের আরেক ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানের সমর্থক সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ। এত কিছুর পরও বৃহস্পতিবার হামা দখল করে নেন বিদ্রোহী যোদ্ধারা।

বিদ্রোহীরা দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ট্যাংকের ওপর বসে জনগণের উল্লাস
ছবি : এএফপি

এরপর এইচটিএসের নেতৃত্বে দুর্বার গতিতে দামেস্কের দিকে এগোতে থাকেন বিদ্রোহী যোদ্ধারা। গত শনিবার তাঁদের হাতে সিরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর হোমসের পতন হয়। এরপর একে একে দামেস্কের কাছের ডেরা ও সুয়েইদা শহরের নিয়ন্ত্রণ হারায় সরকারি বাহিনী। শেষে গতকাল রোববার দামেস্কে প্রবেশ করেন বিদ্রোহী যোদ্ধারা। ঘোষণা আসে, স্বৈরাচারী বাশার পালিয়ে গেছেন। দামেস্ক পুরোপুরি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে।

পরিবারসহ মস্কোয় বাশার

সরকার পতনের পর বাশারের অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা শুরু হয়। বিদ্রোহী যোদ্ধারা গতকাল যখন দামেস্কে প্রবেশ করছিলেন, তখন দামেস্ক বিমানবন্দর ছেড়ে যায় একটি উড়োজাহাজ। ‘সিরিয়ান এয়ার ৯২১৮ ফ্লাইটটি’ দামেস্ক থেকে উড়াল দেওয়া সর্বশেষ ফ্লাইট ছিল বলে জানিয়েছে ফ্লাইটরাডার ২৪। বিশ্বজুড়ে উড়োজাহাজ চলাচলের ওপর নজর রাখা ফ্লাইটরাডার ২৪-এর তথ্যানুযায়ী, দামেস্ক থেকে উড়োজাহাজটি প্রথমে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে উড়ে যায়। সেখান থেকে পরে আবার উল্টোপথে যাওয়া শুরু করে। কয়েক মিনিট পর সেটি রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। তিনি কোন দেশে গেছেন, তাৎক্ষণিকভাবে কেউ এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাচ্ছিল না।

পরে বাংলাদেশ সময় গতকাল দিবাগত রাত ১২টার দিকে রুশ বার্তা সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাশার মস্কোয় পৌঁছেছেন। সেখানে তাঁদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

এদিকে সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য আজ সোমবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রুদ্ধদ্বার বৈঠক আয়োজনের অনুরোধ জানিয়েছে রাশিয়া।

অন্তর্বর্তী দায়িত্বে প্রধানমন্ত্রী জালালি

হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

বাশারের পতনের পর রাজধানী দামেস্কসহ সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে সাধারণ মানুষকে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। দামেস্ক থেকে গবেষক রায়না কাতাফ বলেন, ‘মনে হচ্ছে আমরা ১৩ বছর পানিতে ডুবে ছিলাম। এখন ওপরে উঠে শ্বাস নিতে পারছি। আমরা আবার সেই ২০১১ সালে ফিরে গেছি। আমাদের বয়স ১৩ বছর কমে গেছে।’

এদিকে বাশারের পতনের পর রাজধানী দামেস্কসহ অনেক স্থানে বাশারের বাবা হাফিজ আল-আসাদের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। হামলা হয়েছে দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে। প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে লুটপাট করা হয়েছে। লুটপাট হয়েছে বাশারের ব্যক্তিগত বাসভবনেও। এই পরিস্থিতিতে গতকাল বিকেল চারটা থেকে আজ ভোর পাঁচটা পর্যন্ত দামেস্কে কারফিউ জারি করেন বিদ্রোহীরা।

এমন পরিস্থিতিতে সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-জালালি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় বলেন, জনগণের বেছে নেওয়া যেকোনো ‘নেতৃত্বকে’ সহায়তা করতে তিনি প্রস্তুত। এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সময়ে কীভাবে দেশ চলবে, সে বিষয়ে জোলানির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তিনি।

বাশারের পতনের পর এক বিবৃতিতে জোলানি বলেন, গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আল-জালালি পরবর্তী ক্ষমতা হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত নিজের পদে থাকবেন। পরে দামেস্কের উমাইয়া মসজিদে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘আজ আমরা পুরস্কার হিসেবে এই বিজয় পেয়েছি। এই জয় সিরিয়ার সব মানুষের।’

১৩ বছর রক্তাক্ত সিরিয়া

সিরিয়ায় ২০১১ সালে প্রথম বাশারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। ওই বিক্ষোভ শক্ত হাতে দমন করেছিলেন তিনি। তখন অনেক বিক্ষোভকারী অস্ত্র হাতে তুলে নেন। সামরিক বাহিনীর অনেকে যোগ দেন তাতে। একপর্যায়ে এই বিক্ষোভ সশস্ত্র বিপ্লবে রূপ নেয়। তখন থেকে সিরিয়ায় ১৩ বছর ধরে চলা সংঘাতে জড়িয়েছে বিভিন্ন পক্ষ। ধাপে ধাপে তারা দেশটির বড় একটি অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়।

ছবি: এএফপি

ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়ার সামরিক সহায়তায় ২০২০ সাল নাগাদ আলেপ্পোসহ সিরিয়ার মূল শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পান বাশার। তখন থেকেই সিরিয়ার সিংহভাগ অঞ্চলে চলছিল বাশারের শাসন। তবে সংঘাত-রক্তপাত একেবারে থেমে থাকেনি। সিরিয়ায় ২০১১ সাল থেকে চলা যুদ্ধে সব মিলিয়ে নিহত হয়েছেন ৬ লাখের বেশি মানুষ। বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে হয়েছে অন্তত ১ কোটি ২০ লাখ মানুষকে।

রাশিয়া ও ইরানের এককাট্টা সমর্থন পাওয়া বাশারের পতন এমন সময় হলো, যখন যুদ্ধ-সংঘাতে অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে বিশ্ব। লেবাননে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর অনেক নেতা নিহত হয়েছেন। গোষ্ঠীটি এখন আগের চেয়ে দুর্বল। বাশারের আরেক মিত্র রাশিয়াও এখন ইউক্রেনে যুদ্ধ করছে। মূলত সেই যুদ্ধের দিকেই বর্তমানে নজর দিচ্ছে মস্কো।

আরও পড়ুন

হায়াত তাহরির আল-শাম কারা

২০১২ সালে দামেস্কে বোমা হামলা চালানো নুসরাত ফ্রন্টকে বলা হতো বাশারবিরোধী সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী। ২০১৬ সালে আল-কায়েদা থেকে আলাদা হয়ে যায় তারা। পরে আরও কয়েকটি গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে তারা হায়াত তাহরির আল-শাম বা এইচটিএস নামে আত্মপ্রকাশ করে।

এই গোষ্ঠীকে এখনো আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট মনে করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘ। আর গোষ্ঠীটির প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানিকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়েছে ওয়াশিংটন।

আরও পড়ুন

যা বলছে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র-ইরান

বাশার আল–আসাদের দেশত্যাগের খবরে আনন্দ-উল্লাস। তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ফাতিহ মসজিদ এলাকায়, ৮ ডিসেম্বর ২০১৪
ছবি : এএফপি

বাশারের মস্কোয় আশ্রয় নেওয়ার খবর সামনে আসার আগে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করে সিরিয়া ছাড়তে সম্মত হন বাশার। বৈঠকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের দিকনির্দেশনাও দেন তিনি।

বাশারের পতনের পর দেরি করে হলেও মুখ খুলেছে ইরান। গতকাল এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব ও দেশটির মানুষের একতার প্রতি সম্মান রয়েছে তেহরানের। দেশটিতে দ্রুত সামরিক সংঘাতের অবসান, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দমন এবং সমাজের সব পক্ষের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে তারা।

সিরিয়া প্রসঙ্গে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, রাশিয়া কিংবা ইরানের হিজবুল্লাহ—কেউই সিরিয়া সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি। বাশারের পতনের পর এখন ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চয়তার এক মুহূর্ত বিরাজ করছে। সিরিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় বিদ্রোহী দলগুলোর সঙ্গে কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্লেষকদের কারও কারও মত, বাশারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা এইচটিএসের গোড়া হলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আল-কায়েদা। সংগঠনটির অতীতে উগ্রবাদ রয়েছে। যদিও পরে তারা নিজেদের জাতীয়বাদী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই সংগঠনটি সাম্প্রতিক বার্তায় সমঝোতা-আলোচনার কথা বললেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবস্থান কেমন হবে, তা নিশ্চিত নয়।

বাশারের পতনের পর যে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা হচ্ছে, তা কতটা শৃঙ্খলাপূর্ণ হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওকলাহোমার সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের পরিচালক জোশুয়া ল্যান্ডিস। তিনি বলেন, আসল প্রশ্নটা হচ্ছে কতটা শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে এই ক্ষমতা হস্তান্তর হবে? তবে এটা পরিষ্কার যে জোলানি তা শৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই করতে চান। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ইরাকে যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, তা তিনি চাইবেন না।