গাজার এক কবির সাক্ষাৎকার: ‘বেঁচে থাকার জন্য যেখানে মরতে হয় বারবার’

মোসাব আবু তোহাছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

‘আপনি যদি গাজায় বসবাস করেন, আপনাকে একাধিকবার মরতে হবে’—নিজের ‘ফরেস্ট অব দ্য নয়েজ’ নামক কাব্য সংকলনে এভাবেই লিখেছেন মোসাব আবু তোহা। ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১৫ অক্টোবর সংকলনটি প্রকাশিত হবে।

বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবু তোহার কবিতায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের হৃদয়বিদারক ও প্রাণবন্ত বর্ণনা উঠে এসেছে। কবিতাগুলো বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
সম্প্রতি আল–জাজিরার সংবাদদাতা নিক হিলডেন আবু তোহার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সাক্ষাৎকারে তোহা তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু, গাজার মানবিক পরিস্থিতি, মানুষের দুর্বিষহ জীবন ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। গাজা যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে এ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি।

গাজায় বাঁচতে একজন মানুষকে বারবার মরতে হবে—কাব্য সংকলন এভাবে শুরু করা প্রসঙ্গে আবু তোহা বলেন, ‘এর অনেক ধাপ আছে। যেমন গাজায় বসবাস করলে আপনি বিমান হামলায় মারা যেতে পারেন। শুধু সৌভাগ্যই এ ক্ষেত্রে আপনাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। এ ছাড়া পরিবারের অনেক সদস্য হারিয়ে ফেলতে পারেন। এটিও মৃত্যুর সমান। তা–ও না হলে, আশাহত হয়ে পড়তে পারেন; সেটিও মৃত্যুরই নামান্তর।’

এক দশক আগে ফেসবুকে কবিতা লিখতে শুরু করেন আবু তোহা। বিদেশ থেকে ইংরেজি ভাষাভাষী বন্ধুরা তাঁকে নির্দেশনা দিতেন। সেসব কবিতায় ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি নিপীড়নের চিত্র ও তীব্রতা ফুটে উঠত। মুক্ত ছন্দে ইংরেজিতে এসব কবিতা লিখতেন তোহা।

‘প্রতিটি রাতই আমাদের জন্য একটি নতুন জীবন। এটি ভেবে আপনাকে ঘুমাতে যেতে হবে যে সম্ভবত এবার আপনার ও আপনার পরিবারের মরার পালা। এভাবে প্রতি রাতেই নিজেকে মৃতদের তালিকায় শামিল করে নিতে হবে, যা বারবার মরে যাওয়ার সমতুল্য,’ বলছিলেন মোসাব আবু তোহা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বাড়িতে বসে জুম মিটিংয়ে তিনি আমাকে (আল–জাজিরার সংবাদদাতা) এসব কথা বলছিলেন।

গত বছরের শেষ দিকে আবু তোহা গাজা ছাড়তে বাধ্য হন। তিনি প্রথমে সপরিবার মিসর চলে যান। সেখান থেকে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।

গাজায় গত এক বছরে শতসহস্র বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছেন ইসরায়েলি সেনারা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

জানতে চাইলাম, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন জীবন কেমন কাটছে। আবু তোহা কিছু একটা ভাবলেন এবং মুখে তিক্ত অভিব্যক্তি নিয়ে মাথা ঝাঁকালেন। বললেন, ‘আমি এটিকে নতুন জীবন বলব না। মনে হচ্ছে, যেসব প্রিয় মানুষ গাজায় ফেলে এসেছি, তাঁদের সঙ্গে আমার একটি অংশ সেখানেই রয়ে গেছে। তবে এটি স্বস্তির, আমার সন্তানেরা এখানে ভালো খাবারদাবার পাচ্ছে। গাজায় থাকলে খাওয়ার পানির জন্য আমাকে লাইনে দাঁড়িয়ে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো, যেমনটা আমার অন্য বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের করতে হচ্ছে। এখানে (নিউইয়র্কে) আমি দোকানে যেতে পারছি এবং তাদের আইসক্রিম কিনে দিতে পারছি, এটিই বিশেষ কিছু।’

আবু তোহার তিন শিশুসন্তান এ মুহূর্তে প্রবাসজীবন কাটালেও তাদের ওপরও গাজা যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে বলে জানান তিনি।

‘প্রতিটি রাতই আমাদের জন্য একটি নতুন জীবন। এটি ভেবে আপনাকে ঘুমাতে যেতে হবে যে সম্ভবত এবার আপনার ও আপনার পরিবারের মরার পালা। এভাবে প্রতি রাতেই নিজেকে মৃতদের তালিকায় শামিল করে নিতে হবে, যা বারবার মরে যাওয়ার সমতুল্য।’
মোসাব আবু তোহা, ফিলিস্তিনি লেখক।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আবু তোহা বলেন, ‘আমার চার বছর বয়সী ছোট ছেলে জানে যুদ্ধ মানে কী। সে জানে যুদ্ধবিমান মানে কী, বোমা মানে কী। বিমান হামলা, বিস্ফোরণ, ড্রোন কিংবা এফ-১৬ মানে কী, তা–ও সে জানে।’

একদিন গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় বোমা থেকে বাঁচার জন্য তাঁর মেয়ে কতটা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছিল, সেটির বর্ণনা দিয়েছেন আবু তোহা। ওই সময় তাঁর ছয় বছর বয়সী ছেলে কম্বলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বোনকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। বোনকে বাঁচাতে এ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তার। ঘটনাটি ‘ফরেস্ট অব নয়েজ’ বইয়ের একটি কবিতায় উঠে এসেছে।

আবু তোহা বলেন, ‘গাজার শিশুরা এখন আর আঁকাআঁকি, রং করা কিংবা বাইসাইকেল চালানো শিখছে না। সুন্দরভাবে জীবনধারণ করা শিখছে না—তারা শিখছে বাঁচার জন্য লড়াই করতে।’

গাজা যুদ্ধে নিহতদের বড় একটি অংশ শিশু
ফাইল ছবি: রয়টার্স

গাজায় বেঁচে থাকার এ সংগ্রাম ও সেই চেষ্টায় বারবার হেরে যাওয়ার গল্প আবু তোহার কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। তিনি বলেন, ইসরায়েলি বিমান হামলার পর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে এক তরুণীর মৃত্যু হয়। নিজের বিছানাই পরিণত হয় তাঁর সমাধিতে। এ পর্যন্ত গাজায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শতসহস্র বাড়িঘর। বেশির ভাগ সময় এসব বাড়িঘরের ভেতরে থাকা মানুষ ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ছেন। আর তা একেবারে সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইসরায়েলি বিমান হামলার সময় গাজার একজন বাসিন্দার উচিত, বোমা বিস্ফোরণের সময় বাতি নেভানো থেকে শুরু করে জানালা থেকে দূরে থাকা, ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেওয়া, বারান্দায় থাকা ফুলের টব থেকে এক মুঠো মাটি নেওয়া পর্যন্ত বাস্তব ও অবাস্তব সব ধরনের কাজের তালিকা করা। ফিলিস্তিনে চলমান বাস্তুচ্যুতি এবং যার যার ভূখণ্ডকে আঁকড়ে রাখার প্রতীক এই মাটি।

তিন প্রজন্মের জন্ম শরণার্থীশিবিরে

এক দশক আগেই ফেসবুকে কবিতা লিখতে শুরু করেন আবু তোহা। বিদেশ থেকে ইংরেজি ভাষাভাষী বন্ধুরা তাঁকে নির্দেশনা দিতেন। সেসব কবিতায় ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি নিপীড়নের চিত্র ও তীব্রতা ফুটে উঠত। মুক্ত ছন্দে ইংরেজিতে এসব কবিতা লিখতেন তোহা। তিনি বলেন, ‘ওই সময় আমি লেখাগুলো কবিতা বলতাম না। আমার পরিবারের কেউ সাহিত্যিক ছিলেন না। আমি যা দেখেছি এবং যা অনুভব করেছি, তা–ই লিখেছি।’

আবু তোহা বলেন, ‘আমি একটি শরণার্থীশিবিরে জন্মেছি। মা–বাবাও শরণার্থীশিবিরে জন্মেছেন। দাদা-দাদিও তা–ই। আমি শিকড় ভুলে যেতে যেতে পারি না।’ আহত হওয়ার পরও ২৭ বছর বয়স হওয়ার আগপর্যন্ত কখনো গাজা ছেড়ে যাননি বলে জানান তোহা। বাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং ইসরায়েলি সেনারা তাঁকে একবার অপহরণ করেছে বলেও জানান এই লেখক।

‘ফরেস্ট অব নয়েজ’ বইয়ে ‘অন ইউর নি’ নামের একটি কবিতায় আবু তোহা তাঁর অপহরণের ভয়াবহ ঘটনা তুলে ধরেন। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে গাজা থেকে পালানোর সময় গত বছরের নভেম্বরে ইসরায়েলি সেনারা তাঁকে বন্দুকের মুখে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

‘হাঁটু গেড়ে বসো—ইসরায়েলি সেনাদের কাছ থেকে এই একটি কথাই শুনেছি আমি’, স্মৃতি হাতড়ে বললেন আবু তোহা। জানান, ওই সময় তাঁর মুখ ও পেটে লাথি মারা হয়েছে। পায়ে তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করার আগপর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তুলে নেওয়ার আগে হাতকড়া পরিয়ে চোখ বাঁধা হয়। জানতাম না যে আমাকে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর সেটি ছিল আমার জীবনে প্রথম ইসরায়েলে যাওয়া।’
অপহরণের প্রায় ৫০ ঘণ্টা পর তোহাকে যেখান থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে রেখে যান ইসরায়েলি সেনারা। তিনি বলেন, ‘আমার পরবর্তী মিশন ছিল স্ত্রী ও সন্তানদের খুঁজে বের করা। কারণ, আমি জানতাম না তাঁরা তখনো বেঁচে আছে কি না।’

আরও পড়ুন

আমরা যখন কথা বলছিলাম, তখন হঠাৎ করে লাল চুলের একটি কিশোর ক্যামেরার সামনে চলে আসে। আবু তোহা তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। নাম মুস্তাফা। আবু তোহার ছোট ছেলে।

আবু তোহা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে মুস্তাফার জন্ম। তার কারণেই গাজা থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া মানুষের তালিকায় আমাদের নাম ছিল। আমরা মানুষ, সেই জন্য আমেরিকার প্রশাসন আমাদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছে—এমন নয় কিংবা আমি কবি বা পুরস্কারজয়ী লেখক, সে জন্যও নয়। তারা আমাদের কথা ভেবেছে, কারণ আমাদের সন্তানের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে এবং তার একটি আমেরিকান পাসপোর্ট আছে।’

আবু তোহা বলেন, ‘গাজার যেসব পরিবারের কোনো সদস্যের বিদেশি পাসপোর্ট নেই, তারা আমাদের মতো সৌভাগ্যবান নয়। তাদের কোনো মূল্য নেই। তাদের কথা কেউ ভাবে না।’

গাজা থেকে বিশ্ববাসীর কাছে বার্তা

আবু তোহাকে জিজ্ঞেস করলাম, গাজার জনজীবন সম্পর্কে তিনি বিশ্ববাসীকে কী জানাতে চান?

জবাবে এই কবি বললেন, ‘আমি চাই, গাজার বাইরে জন্ম নেওয়া প্রত্যেকে কল্পনা করুক যে তাঁরা ফিলিস্তিনে জন্ম নিলে কেমন হতো; শরণার্থীশিবিরে জন্ম নিলে এবং দখলদারি ও অবরোধের মধ্যেই পুরোটা জীবন কাটিয়ে দিতে কেমন লাগত।’

সর্বশেষ ইসরায়েলি আগ্রাসনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে ৭ অক্টোবর। এ আগ্রাসন বিশ্ববাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে ফিলিস্তিনিদের ওপর গত ৭৫ বছর ধরে চলা নিপীড়নের ভোগান্তি এখনো আঁচ করতে পারেননি অনেকেই।

ইসরায়েলি হামলায় নিহত শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে ফিলিস্তিনি নারীর কান্না। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাফাহ এলাকার নজর হাসপাতালে
ছবি: এএফপি

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা নিদারুণ এ যন্ত্রণার বর্ণনা আবু তোহার ‘ফরেস্ট অব নয়েজ’ বইয়ে উঠে এসেছে। নাকবার সময় তাঁর দাদা-দাদিদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনাও তুলে ধরা হয়েছে সেখানে। আরবি শব্দ নাকবা অর্থ বিপর্যয়। নাকবা বলতে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের হাতে ৭ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে বাড়িঘরছাড়া হওয়ার ঘটনাকে বোঝায়।

আবু তোহা বলেন, ‘একটি বিষয় আমার জন্য সত্যিকার অর্থে যন্ত্রণাদায়ক; যা বিশ্বের মানুষকে জানা উচিত। তা হলো আমরা যখন বেঁচে থাকি, তখন আমাদের এ বিষয়টি বিশ্বের মানুষকে বোঝাতে লড়াই ও সংগ্রাম করতে হয়। সংগ্রাম কবতে হয় এটা বোঝাতে যে আমরা মানুষ, আমাদেরও অস্তিত্ব আছে। আবার আমাদের যখন মেরে ফেলা হয়, তখনো নিহত বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না আমাদের।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন