সংঘাতে কতটা ভয় আর আতঙ্কে দিন কাটছে আরব ইসরায়েলিদের
‘আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল’—বলছিলেন ৬৭ বছর বয়সী আরব ইসরায়েল কাসেম আবু আল-হিজা।
ইরানের ছোড়া একটা ক্ষেপণাস্ত্র গত শনিবার উত্তর ইসরায়েলের তামরা শহরে কাসেমের বাড়িতে আঘাত হেনেছিল। সিমেন্টের ছাদটা ভেঙে পড়েছিল ঘরের ভেতরেই।
ওই এক হামলাতেই কাসেমের পরিবারের চারজন নিহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বাড়ির ভেতর থেকে বই, জামাকাপড়, বাচ্চাদের খেলনা, আর দেহের টুকরা অংশগুলো উড়ে এসে রাস্তায় পড়েছিল।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন কাসেমের মেয়ে ৪৫ বছর বয়সী মানার খাতিব, দুই নাতনি ২০ বছরের শাদা আর ১৩ বছরের হালা আর তাদের ৪১ বছর বয়সী খালা মানাল খাতিব।
তাঁরা সবাই একই সঙ্গে বাড়ির ভেতরেই কংক্রিটের ঢালাই করা একটা ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটা সরাসরি এসে পড়েছিল ওই ঘরেই।
উত্তর ইসরায়েলের যে তামরা শহরে কাসেম ও তাঁর পরিবার থাকতেন, সেখানকার বেশির ভাগ বাসিন্দাই আরব।
ওই চারজনের মৃত্যুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই অনলাইনে একটা ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যাচ্ছিল, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রটা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে আসছে।
তামরা শহরের ওপরে যখন মিসাইলটা পড়ল, তখনই ভিডিওতে একটা গলা শোনা গেল, হিব্রুতে কেউ চিৎকার করে বলছে, ‘গ্রামে পড়েছে, গ্রামে পড়েছে।’
এরপর বেশ কয়েকজনকে একসঙ্গে হাততালি দিয়ে গান গাইতে শোনা যাচ্ছিল, ‘তোমাদের গ্রামটা পুড়ে যাক।’
ধরা গলায় কাসেম বলছিলেন, ‘আমার পরিবারে যা ঘটল, সেটা নিয়ে ওরা গান গাইছিল।’ তাঁকে তখন ঘিরে রেখেছিলেন আত্মীয়স্বজন।
ওই ভিডিওতে যে গানটা শোনা যাচ্ছিল, সেই ‘আরববিরোধী’ স্লোগান মাঝেমধ্যেই উগ্র জাতীয়তাবাদী ইহুদিরা গেয়ে থাকে। ওই ভিডিও ইসরায়েলে ভাইরাল হয়ে গেছে, তবে দেশের ভেতরেই ভিডিওটার প্রবল নিন্দাও হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগ মন্তব্য করেছেন, ‘ভয়াবহ ও লজ্জাজনক।’
আরব ইসরায়েলিদের নেই সরকারি বাংকার
ওই ঘটনায় কাসেম ও তামরার বৃহত্তর আরব সমাজের ক্ষুব্ধ হওয়ার পেছনে আরও কারণ আছে।
শুধু ওই এলাকায় নয়, ইসরায়েলের অন্যান্য আরব–অধ্যুষিত এলাকায় প্রায় ৩৮ হাজার মানুষের জন্য কোনো সরকারি বাংকার নেই।
কাছাকাছি ইহুদি–অধ্যুষিত শহর কারমিয়েলের জনসংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। সেখানে ১২৬টি সরকারি বাংকার রয়েছে।
বিষয়টি দেখলেই দুই এলাকার ফারাকটা চোখে পড়ার মতো। তামরার বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরেই এই বৈষম্য নিয়ে সতর্ক করে যাচ্ছেন।
ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম শহর হাইফা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে তামরা শহরের অবস্থান। আবার লেবাননের সীমান্ত থেকে শহরটির দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। তাই ইরান–সমর্থিত হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর ছোড়া রকেট এ শহরে আঘাত হানতেই পারে।
হিজবুল্লাহর ছোড়া একটি রকেটের আঘাতে গত বছরের অক্টোবরে এক নারী গুরুতর আহত হয়েছিলেন।
পুরো ইসরায়েলেই মোট জনসংখ্যার এক–চতুর্থাংশ উপযুক্ত বাংকারে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ পান না। তবে অ-ইহুদি এলাকায় সংখ্যাটা বেড়ে হয়ে যায় মোট বাসিন্দার প্রায় অর্ধেক। এ তথ্য ২০১৮ সালে দিয়েছিল ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় প্রধান হিসাবরক্ষকের দপ্তর।
চিন্তক প্রতিষ্ঠান ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের লিতাল পিলার বলছিলেন, অনেক দশক ধরে আরব–অধ্যুষিত এলাকার স্থানীয় কর্মকর্তারা নানা খাতেই কম সরকারি অনুদান পান। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে বোমা বা রকেট হামলার মতো জরুরি প্রয়োজনের জন্য প্রস্তুতির খাত।
পিলার বলেন, আবার যেসব জায়গায় বাংকার আছে, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও খুব খারাপ, দীর্ঘদিন থাকার উপযুক্ত নয়।
বিবিসি বিষয়টি নিয়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য জানতে চেয়েছিল। তবে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক
ইসরায়েলের বাসিন্দা আরবদের অনেকেই নিজেদের ফিলিস্তিনি নাগরিক বলে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ইসরায়েলের মোট জনসংখ্যার এক–পঞ্চমাংশ, অর্থাৎ ২০ শতাংশই আরব। আইন অনুযায়ী, ইহুদি নাগরিকদের মতো সমান অধিকার পাওয়ার কথা তাঁদের।
কিন্তু আরব ইসরায়েলিরা নিয়মিতই অভিযোগ তুলে থাকেন, সরকারিভাবেই তাঁরা বৈষম্যের শিকার হন এবং তাঁদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের মতো আচরণ করা হয়।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকেই তেল আবিব আর হাইফায় যখন ইরাকি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করতে থাকে, সেই সময়েই ইসরায়েলি সরকার নির্দেশ দিয়েছিল—যত নতুন ভবন তৈরি হবে, সেগুলোতে ‘মামাদ’ বা মোটা কংক্রিটের ঢালাই করা নিরাপদ ঘর থাকতে হবে।
সমাজকর্মীরা বলছেন, আরব সমাজকে এমনিতেই নতুন বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করতে গিয়ে এত কড়া নিয়মকানুনের মোকাবিলা করতে হয় যে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা অনিয়ম করেই বাড়ি বানান, যেখানে বাংকার রাখা হয় না।
স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, তামরার ৪০ শতাংশ বাড়িতে নিজস্ব বাংকার আছে। বাকি সিংহভাগ মানুষকে আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রতিবেশীদের বাড়িতে দৌড়াতে হয়। অনেক সময়ই রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার যথেষ্ট আগে সতর্কবার্তা আসে না। তাই আশ্রয় নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে।
আরব-জিউশ সেন্টার ফর এমপাওয়ারমেন্ট, ইকুয়ালিটি অ্যান্ড কো–অপারেশনের ইলান আমিত বলছেন, ‘ফারাকটা বিরাট।’ ওই সংগঠন আরবদের আশ্রয়স্থল গড়ে দেওয়ার কাজ করে।
আমিত বলেন, ‘আমি জেরুজালেমে থাকি। প্রতিটা বাড়িতে বাংকার আছে। প্রতিটা পাড়ায় একটা করে সরকারি বাংকার রয়েছে।’
আরব বেদুইন আর গরিব ইহুদিদেরও বাংকার নেই
তামরায় তখন অন্ধকার নামছে। সব বাসিন্দার ফোনে একই সঙ্গে সতর্কবার্তা এল, ‘আপনাকে নিশ্চিতভাবে কোনো নিরাপদ জায়গার কাছাকাছি থাকতে হবে।’
একটু পরেই সাইরেন বেজে উঠল। বাসিন্দাদের মনে গত শনিবারের ঘটনাটা তখনো তাজা রয়েছে। মানুষজন আতঙ্কে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। মায়েরা বাচ্চাদের এক জায়গায় করে ফেললেন, রাস্তায় হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। কয়েকটা পরিবার গাদাগাদি করে একটি বাংকারে আশ্রয় নিলেন। কেউ কাঁদছেন, কেউ হাসছেন, অন্য অনেকের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
এক ব্যক্তি চোখ বুজে প্রার্থনা করছেন। ওপরে শুরু হলো ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরণের শব্দ।
বাংকারের সমস্যাটা ইসরায়েলের আরব বেদুইন সমাজের ক্ষেত্রে আরও প্রকট। তাদের অনেকেই নেগেভ মরুভূমির কাছাকাছি গ্রামগুলোতে থাকেন। ওই সব গ্রামের আবার ইসরায়েল সরকারের স্বীকৃতি নেই। তাই সেখানে সরকারি বাংকার তৈরিও করা হয় না।
গত বছরের এপ্রিলে যখন ইসরায়েল আর ইরানের মধ্যে সংঘাত বেড়ে গিয়েছিল, সেই সময়ে একমাত্র যিনি গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন, সেই অল্প বয়সী নারী এক বেদুইন সমাজের সদস্য ছিলেন। ইরানের ছোড়া মিসাইলের কিছু টুকরা তাঁর মাথায় উড়ে এসে লেগেছিল। বছরখানেক তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।
আবার তেল আবিবের দক্ষিণের যেসব এলাকায় তুলনামূলক গরিব ইহুদিরা থাকেন, সেখানেও বাংকারের অভাব একটা বড় সমস্যা।
উভয় সংকটে আরব ইসরায়েলিরা
হিব্রু ইউনিভার্সিটির এক নতুন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইহুদি ইসরায়েলিদের ৮২ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষই ইরানের ওপরে আক্রমণকে সমর্থন করেন। কিন্তু আরব ইসরায়েলিদের মধ্যে ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ এ হামলার বিরুদ্ধে। ওই সমীক্ষাতেই উঠে এসেছে, আরব ইসরায়েলিদের ৬৯ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ হামলার ভয়ে ভীত। আর ২৫ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
ইলান আমিত বলছিলেন, আরব সমাজ মনে করে, তারা অবহেলার শিকার হয়ে পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষা আর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যেমন বিরাট ফারাক আছে, তেমনই রয়েছে বাংকারের ক্ষেত্রেও।
তামরার পৌর প্রশাসনের এক কর্মকর্তা আদেল খাতিব বলছিলেন, ‘এ ঘটনা যেদিন ঘটল, সেই শনিবার থেকেই কী পরিমাণ ক্রোধ মানুষের মধ্যে জমা হয়েছে, সেটা আপনি টের পাবেন।’
খাতিব বলেন, ‘আমরা একেবারে সাধারণ সুযোগ–সুবিধাও পাই না। বেশির ভাগ আরব এলাকাতেই কমিউনিটি সেন্টার নেই বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আলাদা ভবন নেই।’
ইসরায়েল সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আরব সমাজের ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিলেন।
সম্প্রতি দুই সমাজের মধ্যে ফারাকটা কমিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে। ইসরায়েলের বিগত সরকার ২০২১ সালে আরব সমাজের জন্য একটা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এনেছিল।
ইলান আমিত বলছিলেন, বড় আকারের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মতো ক্ষেত্রগুলোতে যাতে ফারাকটা কমিয়ে আনা যায়, সেই কাজই চলছে এখন।
বর্তমান ক্ষমতাসীন দক্ষিণপন্থী জোট দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে কট্টরপন্থী বলে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তারা ওই পরিকল্পনায় বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে সেই অর্থের ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই বরাদ্দ ছাঁটাই একবার হয়েছে গাজার যুদ্ধের জন্য সরকার যে বাজেটে অদলবদল ঘটায়, সেই সময়ে।
ইলান আমিত বলছেন, সহজ ভাষায় বলতে গেলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার চাকা আটকে দিয়েছে বর্তমান সরকার। বৃহত্তর উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোও বাস্তবায়িত হতে দিচ্ছে না তারা।
আমিত বলেন, বছর দেড়েক ধরে আরব সমাজ উভয় সংকটে পড়েছেন। একদিকে তারা নিজেরা বর্তমান সরকারের নীতির কারণে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। অন্যদিকে এই যুদ্ধের ফলে গাজায় আর পশ্চিম তীরে তাদের সমাজেরই মানুষদের সংকটও তাদের দেখতে হচ্ছে।
বোমা তো আর ইহুদি বা আরব দেখে ফাটে না
কাসেম আবু আল-হিজার বাড়ির ধ্বংসাবশেষের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরই প্রতিবেশী ১৬ বছর বয়সী মুহাম্মদ ওসমান বলছিলেন, ‘সবাই ক্রুদ্ধ আর ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন।’
শাদার কথা বলতে গিয়ে ওসমান বলছিলেন, সব সময়েই পড়াশোনা নিয়ে থাকত। সবচেয়ে ভালো হয়ে উঠতে চাইত সে। তার বাবা একজন আইনজীবী, সে–ও বাবার মতোই হতে চাইত। তার সব স্বপ্ন নিমিষেই মুছে গেল।
ওসমান বলেন, ছবির মতো একটা সুখী পরিবার ছিল। যখনই মনে পড়ছে ওদের কথা, তখনই আবার চোখে ভেসে উঠছে ওই সুন্দর ছবির টুকরা টুকরা হয়ে যাওয়া।
জানাজা শুরুর আগে সমাজের সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে চা–কফি খেতে খেতেই একে অপরের হাত ধরে নীরবে শোক পালন করছিলেন।
কাসেম আবু আল-হিজা বলছিলেন, ‘বোমা তো আর ইহুদি বা আরব দেখে ফাটে না। এই যুদ্ধ শেষ করা দরকার আমাদের, এখনই।’