আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) পরিচালিত ‘ম্যাডলিন’ জাহাজটি ইতালি থেকে গাজা উপত্যকার পথে রয়েছে। জাহাজটি গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী ওই জাহাজে আছেন।
গত ২ মার্চ থেকে গাজায় পুরোপুরিভাবে ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ করে দেয় জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। এমন অবস্থায় অনাহারে ভুগে বেশ কয়েকজন শিশু মারা যায়। ত্রাণ প্রবেশে বাধা দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ‘ম্যাডলিন’ নামের এই জাহাজ যাত্রা শুরু করে।
বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার হিসাব অনুসারে, গাজার ২৩ লাখের বেশি বাসিন্দার মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ তীব্রমাত্রায় খাদ্যসংকটে ভুগছেন।
গাজার প্রথম ও একমাত্র নারী মৎস্যশিকারির নামানুসারে ‘ম্যাডলিন’ জাহাজটির নামকরণ করা হয়েছে। এটি ১ জুন ইতালির সিসিলির কাতানিয়া শহর থেকে রওনা দিয়েছে। মাল্টার উপকূলে ‘কনসায়েন্স’ নামে এফএফসি পরিচালিত আরেকটি ত্রাণবাহী জাহাজে বোমা হামলা হওয়ার মাত্র এক মাসের মাথায় জাহাজটি যাত্রা শুরু করেছে।
২ হাজার কিলোমিটার (১ হাজার ২৫০ মাইল) দীর্ঘ এই যাত্রায় যদি কোনো বিঘ্ন না ঘটে, তাহলে গন্তব্যে পৌঁছাতে জাহাজটির প্রায় ৭ দিন সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গবেষণা সংস্থা ফরেনসিক আর্কিটেকচার ও জাহাজে থাকা গারমিন লাইভ ট্র্যাকারের মাধ্যমে জাহাজটির অবস্থান শনাক্ত করা হচ্ছে। গ্রিনিচ মান সময় ৪ জুন রাত ১১টা নাগাদ গ্রিক দ্বীপ ক্রিটের দক্ষিণে অবস্থান করছিল ‘ম্যাডলিন’।
গত মঙ্গলবার ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বলেছে, তারা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের ত্রাণবাহী জাহাজটিকে নিজেদের জলসীমায় প্রবেশ করতে দেবে না।
নজরদারি ড্রোন
গত মঙ্গলবার গভীর রাতে ‘ম্যাডলিন’ জাহাজের ওপর একটি নজরদারি ড্রোনকে ওড়াউড়ি করতে দেখা যায়। জাহাজটি তখন গ্রিসের জলসীমা থেকে প্রায় ৬৮ কিলোমিটার (৪২ মাইল) দূরত্বে অবস্থান করছিল।
পরে জানা যায়, এটি গ্রিসের হেলেনিক কোস্টগার্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘হেরন’ মডেলের ড্রোন। পরে এটি সরে যায়।
জাহাজের ভেতর কারা আছেন
‘ম্যাডলিন’ জাহাজে মোট ১২ জন মানবাধিকারকর্মী আছেন। তাঁরা হলেন—সুইডেনের পরিবেশবিষয়ক আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ফরাসি নাগরিক ও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য রিমা হাসান, জার্মানির ইয়াসেমিন আচার, ফ্রান্সের ব্যাপতিস্ত আন্দ্রে, ব্রাজিলের থিয়াগো আভিলা, ফ্রান্সের ওমর ফায়াদ, পাস্কাল মৌরিয়েরাস, ইয়ানিস মোহামদি, তুরস্কের সুলাইব ওর্দু, স্পেনের সার্জিও তোরিবিও, নেদারল্যান্ডসের মার্কো ফন রেনেস ও ফ্রান্সের রিভা ভিয়া।
এফএফসি জোরালোভাবে বলেছে, ম্যাডলিন জাহাজে থাকা স্বেচ্ছাসেবক ও নাবিকদের সবাই অসহিংস আচরণের চর্চা করেন। তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে বেসামরিক প্রতিরোধের অংশ হিসেবে নিরস্ত্র অবস্থায় গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যাত্রা করছেন।
আগের জাহাজগুলোর কী হয়েছিল
গত মাসে গাজার উদ্দেশে ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার সময় আরেকটি জাহাজ মাল্টার উপকূলে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ড্রোন হামলার শিকার হয়েছে। জাহাজটি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল।
এফএফসি আল–জাজিরাকে বলেছে, গত ২ মে স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ২৩ মিনিটে ‘কনসায়েন্স’ নামের জাহাজটিতে ড্রোন হামলা হয়। এতে জাহাজে বড় ধরনের গর্ত তৈরি হয় ও ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়।
১৫ বছর আগে, ২০১০ সালের ৩১ মে ইসরায়েলি কমান্ডোরা তুর্কি কর্মীদের বহনকারী সবচেয়ে বড় ত্রাণবাহী জাহাজ মাভি মারমারাতে প্রাণঘাতী হামলা চালায়। ‘গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা’ নামক জাহাজটি গাজার অবরোধ ভাঙার উদ্দেশ্যে ১০ হাজার টন মানবিক সহায়তা নিয়ে ইস্তাম্বুল থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। ওই হামলায় ৯ জন স্বেচ্ছাসেবক নিহত হন।
২০০৭ সাল থেকে গাজার স্থল, জল ও আকাশপথ অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরায়েল।
জাহাজটিতে কী কী ত্রাণ আছে
ফ্রি ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের এক বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, গাজার মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে যেসব সহায়তা দরকার, সেগুলো বহন করছে জাহাজটি। এর মধ্যে আছে—চিকিৎসা সরঞ্জাম, ময়দা, চাল, শিশুদের দুধ (বেবি ফর্মুলা), ডায়াপার, নারীদের স্যানিটারি পণ্য, পানি বিশুদ্ধকরণ কিট, ক্রাচ ও শিশুদের কৃত্রিম অঙ্গ।
গাজায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি
ইসরায়েলে তিন মাস ধরে পুরোপুরি অবরোধ চলার কারণে গাজার প্রতি পাঁচ ফিলিস্তিনির একজন এখন চরম খাদ্যসংকটে ভুগছেন।
সর্বশেষ ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশনের (আইপিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার মোট জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ১৯ লাখ ৫০ হাজার মানুষ তীব্র খাদ্যঘাটতিতে আছে।
আইপিসি আরও বলেছে, ইসরায়েলের এই অবরোধ অব্যাহত থাকলে ‘প্রশাসনিক অঞ্চলের ভেতরে ও বাইরে বিপুলসংখ্যক মানুষের স্থানচ্যুতি’ ঘটতে পারে। কারণ, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত বিতর্কিত ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) নামের একটি ত্রাণ বিতরণ সংস্থা গত মাসে গঠিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল গাজায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু ২৭ মে এর নতুন বিতরণকেন্দ্র চালু হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বিশেষ করে কয়েক দিন ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ইসরায়েলি বাহিনীর প্রাণঘাতী গুলিতে বিপুল প্রাণহানির ঘটনার পর এই কেন্দ্র ঘিরে বিতর্ক আরও জোরদার হয়েছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা ফিলিস্তিনিদের ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে ওই ত্রাণকেন্দ্রগুলোয় নিয়ে আসছে এবং সেখানে হামলা চালাচ্ছে। এসব কেন্দ্রে গত আট দিনে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ভয়াবহ সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৫৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।