গাজায় নিহতদের মধ্যে শিশুই ২০০০

২৪ ঘণ্টায় গাজায় ৩২০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা। ধ্বংস হয়েছে মসজিদসহ বহু স্থাপনা।

ইসরায়েলের হামলা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ছোট্ট শিশুটির। দাফনের আগে শিশুটির মরদেহ কোলে এক ফিলিস্তিনি। গতকাল গাজার খান ইউনিসে
ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনি শিশুটি বাড়িতে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ সেখানে বোমা হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায় বাড়িটি। হামলায় হতবিহ্বল শিশুটি জানে না তার কী দোষ। তার মতোই অসহায় আরেক শিশুর বাবা। তাঁর তিন মাস বয়সী সন্তানের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ইসরায়েলের হামলা।

এ চিত্র ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার রাফাহ এলাকার। গতকাল সোমবার সেখানে নির্বিচার বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। শুধু রাফাহই নয়, হামলা হয়েছে গাজাজুড়েই। গাজার বাসিন্দারা বলছেন, ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরুর পর থেকে গতকালই সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হয়েছেন তাঁরা।

গতকালের হামলা যে কতটা নারকীয় ছিল, তা বোঝা যায় হতাহত মানুষের সংখ্যার দিকে তাকালেই। এদিন গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় উপত্যকাটিতে বোমায় ৪৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে গত ১৭ দিনে গাজায় নিহত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮৭–তে। তাঁদের মধ্যে ২ হাজার ৫৫ জন বা ৪০ শতাংশই শিশু। আর ১ হাজার ১১৯ জন নারী।

সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ৩২০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো হয়েছে বলে গতকাল জানিয়েছে ইসরায়েল। এতে ধ্বংস হয়েছে একটি মসজিদসহ বহু স্থাপনা। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হয়েছে উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে। সেখানে অন্তত ৩০ জন নিহত হন। ফলে অন্যান্য দিনের মতো গতকালও গাজার হাসপাতালগুলোতে ছিল আহত ফিলিস্তিনিদের ঢল আর লাশের সারি।

গাজার হাসপাতালগুলোর অবস্থা চরম শোচনীয়। সেখানে না আছে বিদ্যুৎ, না আছে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম। চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। আহত ব্যক্তির সংখ্যা এত যে তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্তও পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে রেডক্রস ও গাজার বাসিন্দাদের রক্ত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

জাতিসংঘ বলছে, গাজায় চলমান সংঘাতে উপত্যকাটির ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে প্রায় ১৪ লাখ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন শরণার্থীশিবির ও হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছেন। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে এক হাসপাতালে আশ্রয় নেওয়া এক ফিলিস্তিনি বলেন, হাসপাতাল চত্বরে তাঁকে পরিবার নিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। সন্ধ্যার দিকে আবার শীত নামতে শুরু করেছে। এতে দুর্দশা বেড়েছে। তবে অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

সর্বাত্মক স্থল হামলার অপেক্ষা

বিমান হামলার মধ্যেই এবার গাজায় স্থল অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। তাদের মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি গতকাল বলেছেন, রোববার রাতভর গাজায় ইসরায়েলের ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনী অভিযান চালিয়েছে। ‘সন্ত্রাসীদের’ হত্যা করতে ও হামাসের হাতে জিম্মি ইসরায়েলিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে এ অভিযান চালানো হয়েছে।

ওই দিন রাতে খান ইউনিসের সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষে জড়ান ইসরায়েলি সেনা ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা। ইসরায়েলি বাহিনী বলছে, ওই এলাকায় অভিযান চালানোর সময় হামাসের হামলায় এক সেনা নিহত ও তিনজন আহত হন। সংঘর্ষের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে হামাসও।

রোববার রাতের এ স্থল অভিযান সীমিত পরিসরে ছিল বলে জানিয়েছে ইসরায়েল। পুরোদমে গাজায় স্থল অভিযান শুরু করতে সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে ট্যাংক ও বিপুলসংখ্যক সেনা। তবে কবে নাগাদ পুরোদমে এ অভিযান শুরু হবে, তা স্পষ্ট নয়।

এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের উপরাষ্ট্রদূত এলিয়াভ বেনিয়ামিনকে ইসরায়েলি আর্মি রেডিও প্রশ্ন করেছিল, পুরোদমে স্থল হামলা দেরিতে শুরু করার বিষয়ে ওয়াশিংটনের চাপ আছে কি না? জবাবে এই কূটনীতিক বলেন, ‘তারা (যুক্তরাষ্ট্র) জানে আমরা নিজেদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই এই যুদ্ধ করছি। দিন শেষে আমাদের যা করা দরকার, যখন করা দরকার, তা করব।’

এদিকে গতকাল লেবাননের ভূখণ্ডে ইরানপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর দুটি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া গোষ্ঠীটির অন্যান্য অবকাঠামো ও তল্লাশিচৌকিতেও হামলা হয়েছে। হিজবুল্লাহ বলেছে, এ হামলায় তাদের এক যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। অপরদিকে গত কয়েক দিনে হিজবুল্লাহর হামলায় লেবানন সীমান্তে সাত ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছেন বলে জানায় ইসরায়েল। আর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন।

‘মার্কিন সেনাদের ওপর হামলা হলে বদলা’

৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এরপর থেকে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। সংঘাতের মধ্যেই ইসরায়েলকে সহায়তায় এই অঞ্চলে রণতরিসহ নানা অস্ত্র পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রোববার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এনবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের জেরে মধ্যপ্রাচ্যে কোনো মার্কিন সেনার ওপর হামলা হলে তার বদলা নিতে ওয়াশিংটন প্রস্তুত।

এদিকে রোববার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকসহ পশ্চিমা নেতারা একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলা হয়, দেশটির নিজেদের ‘রক্ষা করার অধিকার রয়েছে’। একই সঙ্গে বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে চলা ও বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষা দেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করা হয়েছে। মানবিক সহায়তার জন্য উপত্যকাটিতে যুদ্ধবিরতি শুরু করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, কোনো যুদ্ধবিরতি হলে তা থেকে সুবিধা নেবে হামাস।

গাজায় ত্রাণ ঢুকতে না দেওয়া ‘যুদ্ধাপরাধ’

অবরুদ্ধ গাজায় আগের দুদিনের মতো গতকালও ত্রাণের ট্রাক প্রবেশ করেছে। তবে ভীষণ রকম মানবিক সংকটে থাকা মানুষগুলোর প্রয়োজনের তুলনায় এ ত্রাণ মাত্র ৪ শতাংশ বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ। আর রেডক্রস আগেই বলেছে, এই ত্রাণ ‘মহাসাগরে এক ফোঁটা পানি’র মতো।

গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর শনিবার প্রথম ২০ ট্রাক ত্রাণ মিসর সীমান্তের রাফাহ ক্রসিং হয়ে গাজায় প্রবেশ করে। এর আগে ইসরায়েলের বিমান হামলা ও বাধার কারণে ক্রসিংটি বন্ধ রেখেছিল মিসর। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) কর্মকর্তা সারি বাশি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘গাজার প্রায় অর্ধেক বাসিন্দাই শিশু। সেখানে ত্রাণ ঢুকতে বাধা দেওয়া যুদ্ধাপরাধ। এর মাধ্যমে বেসামরিক লোকজনকে সাজা দেওয়া হচ্ছে।’