ভিন্নমতাবলম্বী নির্বাসিত সৌদি নাগরিকেরাও এমবিএস আতঙ্কে

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান
এএফপি

বুলগেরিয়ার একটি আটককেন্দ্রের ছোট্ট কক্ষে শুয়ে আছেন সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী আবদ আল-রহমান আল-খালিদি। এ সময় তাঁর মাথায় ঘুরেফির আসছে একটাই চিন্তা। এ দেশের সরকার তাঁকে সৌদিতে ফেরত পাঠালে তাঁর কী হবে। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশায় দেশ ছেড়ে বুলগেরিয়ায় এসেছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য তাঁর সহায় হয়নি। তাঁকে আটক করা হয়। এখন তাঁকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।

রাজধানী সোফিয়ায় একটি আটককেন্দ্রে আছেন খালিদি। সেখান থেকে ফোনে এএফপির সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তিনি বলেন, ‘দেশ ছাড়ার কারণে আমাকে নির্যাতন ও দীর্ঘ কারাবাসের শিকার হতে হবে। কারণ, আমি বছরের পর বছর সরকারবিরোধীদের সঙ্গে কাজ করেছি।’

২৯ বছর বয়সী খালিদিসহ সৌদি আরবের অনেক ভিন্নমতালম্বী যাঁরা সৌদি রাজতন্ত্রের সমালোচনার কারণে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এমবিএস নামে পরিচিত বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নিয়ে ভয় কাজ করছে। মরক্কোতে সাময়িক আশ্রয় চেয়েছিলেন সৌদি নাগরিক হাসান আল রাবি। কিন্তু গত মাসে তাঁকে স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়।

রাবি একটি নামকরা পরিবার থেকে এসেছেন। সৌদি আরবে পরিবারটি ভিন্নমতাদর্শের জন্য পরিচিত। রাবির বিরুদ্ধে এখন ‘সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা’ করাসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। দেশে ফেরানোর পর তাঁর সম্পর্কে আর কিছু শোনা যায়নি। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো সতর্ক করে বলছে, সৌদি আরবে তিনি ‘গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের’ শিকার হয়ে থাকতে পারেন।

তেলসমৃদ্ধ দেশটির কার্যত শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের অধীন ভিন্নমতাদর্শের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান দমন–পীড়ন বিভিন্ন দেশে নির্বাসিত সৌদি নাগরকিদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করেছে, এ ঘটনায় তার কিছুটা প্রমাণ মেলে।

সমালোচকেরা বলছেন, ৩৭ বছর বয়সী এই যুবরাজ দেশটির ক্রীড়া ও বিনোদনে বিপুল বিনিয়োগ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ বেশ কিছু উচ্চাভিলাষী সংস্কার আনলেও রাজনীতির জায়গাটিকে সংকুচিত করে ফেলেছেন।

ইউরোপিয়ান-সৌদি অর্গানাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটসের পরিচালক (আইন) তাহা আল-হাজি বলেন, রাজনৈতিক আশ্রয় বা দ্বৈত নাগরিকত্ব নেই, এমন ব্যক্তিরা ‘সব সময় বহিষ্কারের ঝুঁকিতে’ থাকেন।

আত্মগোপনের জায়গা নেই
খালিদি মানবাধিকারের দাবিতে যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছিলেন, তার সবই ছিল ২০১৫ সালে বাদশাহ সালমানের সিংহাসনে আরোহণ এবং তারও দুই বছর পর যুবরাজ মোহাম্মদকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নিয়োগের আগে।

২০১১ সালে খালিদি সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলে বিক্ষোভে বেশ সক্রিয় ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের ঢেউয়ে সেই বিক্ষোভ হয়েছিল, যদিও এই দেশে সচরাচর এমন বিক্ষোভ দেখা যায় না। ওই সময় সেখানে সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের অধিকারের দাবিতে এক হয়েছিলেন।

২০১৩ সালে খালিদি তুরস্কে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি দেখলেন, দেশ ছেড়ে নির্বাসনে যাওয়া বিশিষ্ট অধিকারকর্মীদের ওপর নজর রাখছে সৌদি সরকার।

সেই অধিকারকর্মীদের মধ্যে ছিলেন নারী অধিকারকর্মী লুজাইন আল-হাথলউল। ২০১৮ সালের মার্চে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গ্রেপ্তার হন, সেখান থেকে তাঁকে সৌদি আরবে ফিরতে বাধ্য করা হয়। এরপর সৌদি আরবে তাঁকে দুই বছরের বেশি সময় কারাগারে থাকতে হয়।

বুলগেরিয়ায় আশ্রয়প্রার্থী আবদ আল-রহমান আল-খালিদি
এএফপি

২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তাম্বুল সৌদি কনস্যুলেটে খুন হন ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক ও সমালোচক জামাল খাসোগি। তাঁকে হত্যার পর মরদেহ টুকরা টুকরা করা হয়। মার্কিন গোয়েন্দাদের ধারণা, যুবরাজ মোহাম্মদের ‘অনুমোদনক্রমেই’ ওই অভিযান পরিচালনা করেছিল সৌদি নিরাপত্তা বাহিনী। অবশ্য সৌদি আরব এ ধরনের অভিযানের খবর অস্বীকার করে আসছে।

আলোচিত এসব ঘটনার বাইরেও সৌদি আরব অনলাইন কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারি করে চলেছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত দেখেছিল, রাজপরিবারের সমালোচকদের খুঁজে বের করতে সৌদির টুইটার কর্মীদের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। যাতে বিদেশে নির্বাসিত ব্যক্তিদেরও নজরদারি করা যায়।

খালিদির পাসপোর্টের মেয়াদ ২০২১ সালে শেষ হয়ে গেলে তিনি হেঁটে বুলগেরিয়ায় চলে যান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে সুরক্ষা চেয়ে আবেদন করেন।

বুলগেরীয় এক আইনজীবী, যিনি খালিদির আবেদনটি নিয়ে লড়েছেন, নাম না প্রকাশ করার শর্তে তিনি বলেন, খালিদির আশ্রয় চেয়ে করা আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, তিনি দেশে ফিরে যে নির্যাতনের শিকার হবেন, তা তিনি যথেষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেননি। খালিদিকে প্রত্যার্পণের সিদ্ধান্ত যেকোনো সময় আসতে পারে।

তবে খালিদিসহ এ ধরনের অন্যান্য ঘটনার বিষয়ে এএফপির পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হলেও সৌদি কর্তৃপক্ষ সাড়া দেয়নি।

সাদ ইব্রাহিম আলমাদি নামের আরেক সৌদি ভিন্নমতালবম্বীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শাসকদের সমাোলচনা করায় ১৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে পরে তিনি মুক্তি পান। ২১ মার্চ তাঁর ছেলে ইব্রাহিম আলমাদি বলেন, ২০২১ সালে ইয়েমেন যুদ্ধ ও সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার সমালোচনা করে তাঁর বাবা টুইট করেছিলেন।

ফ্লোরিডায় সন্তানের সঙ্গে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ভিন্নমতাবলম্বী সাদ ইব্রাহিম আলমাদি
এএফপি

আর কখনো সূর্য দেখা হবে না
সৌদি আরবের ভিন্নমতাবলম্বী কতজন দেশের বাইরে আছেন, সেই পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু অধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের ভাষ্য, ভিন্নমতালম্বী ব্যক্তিদের গন্তব্য হিসেবে পছন্দের তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও কানাডা।

বাদশাহ সালমানের শাসনকালে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে আশ্রয় চেয়ে সৌদি নাগরিকদের আবেদনের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এজেন্সি ফর অ্যাসাইলামের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে এসব দেশে আশ্রয় চাওয়া আবেদনকারীদের মধ্যে সৌদি নাগরিক ছিলেন মাত্র ১৫ জন আর ২০১৪ সালে গিয়ে হয়েছে ৪০ জন। ২০১৭ সালে তা বেড়ে ১৩০ জনে দাঁড়ায়। ২০২২ সালেও একই সংখ্যা ছিল।

এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে আশ্রয়প্রার্থীদের পাশাপাশি যাঁরা ইতিমধ্যে আশ্রয়ের অনুমোদন পেয়েছেন, তাঁদের ভয়ও এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি।

আবদুল হাকিম আল-দাখিল নামের এক সৌদি ভিন্নমতাবলম্বী অনলাইনে রাজনৈতিক সংস্কারের ডাক দেওয়ায় ২০১০ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এরপর ২০১৭ সালে তিনি দেশে ছেড়ে পালিয়ে যান। এক দেশে থেকে আরেক দেশ। অবশেষ ২০২০ সালে তিনি ফ্রান্সে আশ্রয় পান।

আবদুল হাকিম এএফপিকে বলেন, ‘এর আগে (আশ্রয় পাওয়া) আমি ভয়ে থাকতাম, এই বুঝি আমাকে দেশে ফেরত পাঠানো হলো। আর ফিরলে আমাকে বানোয়াট অভিযোগে বিচার করা হবে। হয়তো আমি আর জীবনে কোনো দিনও সূর্যের মুখ দেখতে পাব না।’

আবদুল হাকিম এখনো তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে দিন কাটান। তিনি বলেন, ‘সবাই থাকে, আমি এমন জায়গায় থাকতে পছন্দ করি। নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় একা যেতে এখনো ভয় পাই।’

ভিন্নমতালম্বী প্রবাসী সৌদি নাগরিকদের অনেকেই কোথাও যাওয়ার সময় ট্রানজিট হিসেবে আরব দেশগুলোকে এড়িয়ে চলেন। তাঁদের ভয়, ওই সব দেশ হয়ে কোথাও গেলে তাঁদের ধরে দেশে নিয়ে যাওয়া হবে, যেমনটা রাবির সঙ্গে হয়েছে।

ইউরোপিয়ান-সৌদি অর্গানাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটসের ভাইস প্রেসিডেন্ট আদেল আল-সাইদ বলেন, ওই অঞ্চল দিয়ে যেতে কেউ সাহস করেন না। এই কারণে সৌদি আরবের অধিকারকর্মীরা লেবানন ও তিউনিসিয়ার মতো দেশে মানবাধিকার সম্মেলনের আমন্ত্রণ ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছেন।

নারী অধিকারকর্মী লুজাইন আল-হাথলউলের বোন লন্ডনভিত্তিক অধিকার গ্রুপ এএলকিউএসটির মনিটরিং প্রধান লিনা আল-হাথলউল বলেন, আশ্রয় বা দ্বৈত নাগরিকত্ব ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য ‘সুরক্ষার স্তর’ হিসেবে কাজ করে, তবে এর সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি আরও বলেন, কিছু দেশের ওপর সৌদি আরবের প্রভাব বিবেচনায় নিলে ‘এটি সুনিশ্চিত সুরক্ষা নয়’।