মধ্যপ্রাচ্য সফরে ট্রাম্প, নেতানিয়াহু এবারও নিছকই দর্শক
ডোনাল্ড ট্রাম্প সবার আগে নেমেছিলেন রিয়াদে। ২০১৭ সালে তাঁর নয়া প্রশাসনের কয়েক মাস না পেরোতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট সৌদি বাদশাহর সঙ্গে বৈঠক করেন। আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নচেষ্টার অংশ ছিল সেটা। তবে সে সফরসূচিতে ইসরায়েলে যাওয়ার কথা না থাকাটা প্রকটভাবে চোখে পড়ে।
আর এখন যখন ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্য সফরে, একই সমস্যা প্রকট হয়েই রয়ে গেছে। গতকাল মঙ্গলবার সৌদি আরবে পৌঁছেছেন ট্রাম্প। সৌদি আরব ছাড়াও তিনি কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও সফর করবেন।
হোয়াইট হাউস ট্রাম্পের এই সফরকে ‘মধ্যপ্রাচ্যে ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন’ আখ্যা দিয়েছে। পাশপাশি ‘স্থিতিশীলতা, সুযোগ ও পারস্পরিক সম্মানের একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গির’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে ট্রাম্পের এবারের মধ্যপ্রাচ্যের সফরসূচিতেও ইসরায়েলের নাম নেই।
এর আগে ইরানের সঙ্গে আলোচনার ঘোষণা, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে চুক্তি এবং হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার মতো বিষয়ে ইসরায়েলকে একাধিকবার অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এবারের মধ্যপ্রাচ্য সফরেও হয়তো নতুন কোনো চমক আসতে পারে, এমনটা ভেবে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন।
‘ফলাফল শূন্য হলে তিনি আসবেন না’
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত একটি সূত্রের বরাতে জানা গেছে, এই সফরের সময় ট্রাম্প জেরুজালেম কিংবা তেল আবিবে নামবেন কি না, তা জানতে চেয়েছিলেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা। কিন্তু গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট নিজেই সেই ক্ষীণ আশাটুকুও নস্যাৎ করে দেন, যখন তিনি বলেন, ইসরায়েলে থামার কোনো পরিকল্পনা নেই তাঁর।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা অন্য কোনো সময় সেটা করব, কিন্তু এই সফরে সেটা হবে না।’
নেতানিয়াহুর কাছে এমন কিছু নেই, যা ট্রাম্প চান, তাঁর প্রয়োজন কিংবা যা নেতানিয়াহু তাঁকে দিতে পারেন। সৌদি আরব, কাতার বা আরব আমিরাতের কাছে তেমনটা আছে।
ট্রাম্পকে হয়তো ইসরায়েল সফরে রাজি করানো যেত, যদি তিনি এর সুবাদে কিছু একটা বিজয় দেখাতে পারতেন। সেটা গাজায় যুদ্ধবিরতির চুক্তি, কোনো মানবিক সহায়তার পরিকল্পনা কিংবা যা–ই হোক না কেন।
কিন্তু ইসরায়েল গাজায় যুদ্ধ সম্প্রসারণের জন্য দিন গুনছে। সুতরাং এমন কোনো কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই। সোমবার হামাসের হাতে জিম্মি এডান আলেক্সান্ডারের মুক্তির সম্ভাবনা সত্ত্বেও একটি সামগ্রিক যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা এখনো অনেক দূরে বলেই মনে হচ্ছে।
ওই সূত্র বলেছে ‘ফলাফল শূন্য হলে তিনি (ইসরায়েলে) আসবেন না।’
ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বনেতাদের মধ্যে প্রথম তাঁর সঙ্গে দেখা করেন নেতানিয়াহু। এ নিয়ে তাঁর বেশ গর্ব রয়েছে। এর দুই মাস পর এপ্রিলে দ্বিতীয়বারের মতো ওয়াশিংটন সফর করেন তিনি। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যের ওপর নতুন শুল্কনীতি ঘোষণার পর তিনিই প্রথম নেতা, যিনি একটি নতুন বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরুর চেষ্টা করেছিলেন। তবে শেষমেশ কোনো ধরনের বাণিজ্য চুক্তি পকেটে না ভরেই নেতানিয়াহু হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেন।
ইসরায়েলের সাবেক কূটনীতিক অ্যালন পিনকাস বলেন, নেতানিয়াহুর সমস্যা হলো এই মুহূর্তে ওয়াশিংটনে তাঁর প্রভাব খুবই সীমিত।
ধনী আরব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। শুধু তা–ই নয়, তারা মোটা অঙ্কের অস্ত্র কেনার ঘোষণাও দিতে পারে, যেটাকে ট্রাম্প আমেরিকান উৎপাদন খাতের জন্য বিজয় হিসেবে তুলে ধরতে পারেন।
অ্যালন পিনকাস আরও বলেন, নেতানিয়াহুর কাছে এমন কিছু নেই, যা ট্রাম্প চান, তাঁর প্রয়োজন কিংবা যা নেতানিয়াহু তাঁকে দিতে পারেন। সৌদি আরব, কাতার বা আরব আমিরাতের কাছে তেমনটা আছে।
এই ধনী আরব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। শুধু তা–ই নয়, তারা মোটা অঙ্কের অস্ত্র কেনার ঘোষণাও দিতে পারে, যেটাকে ট্রাম্প আমেরিকান উৎপাদন খাতের জন্য বিজয় হিসেবে তুলে ধরতে পারেন।
পিনকাস বলেন, বছরের পর বছর ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ট্রাম্পের সবচেয়ে একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে থেকেও নেতানিয়াহুর হাতে এখন আর খেলার মতো তেমন কোনো চাল নেই। ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের সময়, নেতানিয়াহু প্রায়ই রিপাবলিকান সমর্থকদের ব্যবহার করে হোয়াইট হাউসের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেন। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে তিনি কখনো প্রকাশ্যে সমালোচনা করেননি। এমনকি এখন তা শুরু করার সম্ভাবনাও নেই।
‘চমকে দেওয়ার নীতি’
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর যত ঘনিয়ে এসেছে, এটা কী বয়ে আনবে, তা নিয়ে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের উদ্বেগ ততই বেড়েছে। সফরের আগের কয়েক সপ্তাহে ট্রাম্প এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে প্রায় অসহায় দর্শকের মতো করে রেখেছে।
ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটি তেহরানের জন্য কিছু বেসামরিক পারমাণবিক সক্ষমতা বজায় রাখার সুযোগকে নাকচ করে দিচ্ছে না। এ ছাড়া তিনি ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছেন, তবে ইসরায়েলের ওপর হুতিদের হামলা বন্ধ নিয়ে কোনো কথা বলেননি।
এ ছাড়া রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ট্রাম্প এখন আর সৌদি আরবের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তার শর্ত হিসেবে দেশটিকে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে বলছেন না।
এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলকে পাশ কাটিয়ে হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তি করে শেষ জীবিত মার্কিন জিম্মি এডান আলেক্সান্ডারকে মুক্ত করেছে।
গাজা যুদ্ধ শেষ করার জন্য একটি সর্বাত্মক চুক্তি এখনো অধরা রয়ে গেছে, তবে ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে এটিই তাঁর লক্ষ্য।
গত রোববার ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘এই নির্মম সংঘাতের অবসান ঘটাতে যেসব পদক্ষেপ দরকার, আশা করি এটি সেগুলোর প্রথমটি।’
এ বিষয়ে অবগত আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, যদি হামাসের সঙ্গে আরও জিম্মি ফিরিয়ে আনার চুক্তি হাতের নাগালে বলে মনে হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সেই চুক্তি মেনে নিতে ইসরায়েলের ওপর চাপ দেবে।
গাজার হামাস নেতা মোহাম্মদ সিনওয়ার সীমিত চুক্তিতে সম্মত হবেন কি না, তা নিয়ে বড় ধরনের সন্দেহ ছিল। তবে ট্রাম্পের বেলায় হামাস কৌশলে ইসরায়েলকে হারিয়ে দিয়ে এগিয়ে গেছে।
ট্রাম্প ‘বুলডোজারের মতো’ এগিয়ে যাচ্ছেন
ইসরায়েলে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও ওয়াশিংটনের চিন্তক প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো ড্যান শাপিরো বলেন, ‘চমকে দেওয়ার চর্চাটা উভয় পক্ষকেই এড়িয়ে চলতে হবে। অন্যথায় এই অংশীদারত্বের জন্য যে আস্থা গুরুত্বপূর্ণ, তা খুব দ্রুত ভেঙে পড়বে।’
ড্যান শাপিরো আরও বলেন, নিজের লক্ষ্য অর্জনের জন্য ট্রাম্প ‘বুলডোজারের মতো’ এগিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে যুদ্ধবিরতি চুক্তি এবং জিম্মি মুক্তি তাঁর লক্ষ্যের তালিকায় রয়েছে।
ড্যান শাপিরো বলেন, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে নেতানিয়াহুর দেরি করা এবং নিজের রাজনৈতিক টিকে থাকাকে সবার ওপরে রাখার প্রবণতা ক্ষতিকর হয়েছে। সম্ভবত এসব কারণে হোয়াইট হাউস ইসরায়েলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে পরামর্শ করতে আগ্রহী নয়।
সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, তিনি (ট্রাম্প) স্পষ্টতই নেতানিয়াহুকে নিয়ে হতাশ, যেমনটা নেতানিয়াহুর সঙ্গে কাজ করা প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্টই হয়েছিলেন।