গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু, সামনে কঠিন সময়

শুরু হয়েছে যুদ্ধবিরতি। ধ্বংসস্তূপ পাশ কাটিয়ে দীর্ঘ ১৫ মাস পর নিজ ঠিকানায় ফিরছেন গাজার বাসিন্দারা। ইসরায়েলের নির্মম হামলায় পুরো উপত্যকাটিতে এখন ধ্বংসের চিহ্ন। রোববার উত্তর গাজায়ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের গাজায় দীর্ঘ ১৫ মাস পর যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্য দিয়ে থামল ইসরায়েলের নৃশংসতা। বন্ধ হয়েছে নির্বিচার হামলা। আসতে শুরু করেছে ত্রাণ। উপত্যকাটির বাসিন্দাদের মধ্যে এখন কিছুটা স্বস্তির ছোঁয়া। ইসরায়েলিদের মধ্যেও আনন্দের রেশটা কম নয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তাঁরা মিলিত হতে যাচ্ছেন গাজায় হামাসের হাতে বন্দী থাকা জিম্মিদের সঙ্গে।

গতকাল রোববার যুদ্ধবিরতি শুরু হয় ঘণ্টা তিনেক বিলম্বে, স্থানীয় সময় বেলা সোয়া ১১টায়। গাজায় বন্দী যেসব জিম্মিকে হামাস মুক্তি দেবে, তাঁদের নাম হস্তান্তর করা হয়নি—এমন অভিযোগ এনে যুদ্ধবিরতির সময় পিছিয়ে দেয় ইসরায়েল। এর আগমুহূর্ত পর্যন্ত উপত্যকাটিতে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গেছে তারা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও আগামী কয়েকটা সপ্তাহ কঠিন হতে চলেছে।

দেরিতে যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও গাজাবাসী আনন্দ উদ্‌যাপন শুরু করতে দেরি করেননি। শোনা যাচ্ছিল আতশবাজি পোড়ানো ও পটকা ফোটানোর শব্দ। সকাল থেকেই গাজায় নিজ নিজ এলাকায় ফেরা শুরু করেন লোকজন। এমনই একজন আনোয়ার। গাজার দক্ষিণে রাফায় নিজ বাড়িতে ফিরছেন তিনি। আনোয়ার বলেন, ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আশা করি, যুদ্ধবিরতি চলতে থাকবে।’

উত্তর গাজায় ইসরায়েলি হামলা। আজ রোববার
ছবি: রয়টার্স

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হয় গাজায় একতরফা যুদ্ধ, ইসরায়েলের নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ। এর পর থেকে যুদ্ধবিরতির বহু চেষ্টা হলেও আশার আলো দেখা যায়নি। তবু যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় চলছিল সমঝোতার প্রচেষ্টা। এরই মধ্যে ১৫ জানুয়ারি কাতারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দোহায় আলোচনার পর যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন হামাস ও ইসরায়েলের প্রতিনিধিরা।

গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে এককাট্টা সমর্থন দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টাও কম করেনি। এ নিয়ে তৎপর ছিলেন নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। গতকাল বিদায়ের আগের দিন এক ভাষণে বাইডেন বলেন, ‘আজ গাজায় বন্দুকের শব্দ থেমে গেছে। আমার অংশ নেওয়া সবচেয়ে কঠিন আলোচনাগুলোর একটি ছিল এটি।’

চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি হবে তিন ধাপে। প্রথম ধাপের ছয় সপ্তাহে ৩৩ জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস। এর বিনিময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দী মুক্তি পাবেন ইসরায়েলের কারাগার থেকে। গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানো হবে এবং ইসরায়েলি সেনাদের একাংশকে গাজা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হবে এবং স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি শুরু হবে।

তবে যুদ্ধবিরতির প্রথম ছয় থেকে সাত সপ্তাহ সময়টা কঠিন হবে বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের বিশেষজ্ঞ ইয়োসি মেকেলবার্গ। তিনি বলেন, এই যুদ্ধ থামানোর কোনো ইচ্ছা নেই ইসরায়েলের বর্তমান সরকারের। তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি এজেন্ডা রয়েছে। সেই এজেন্ডা হলো তারা গাজা দখল করতে চায়, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিতে চায়।

যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর রাফায় ফেরা ফিলিস্তিনিদের উচ্ছ্বাস। রাফা, গাজা, ফিলিস্তিন, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫
ছবি: এএফপি

সন্তানের অপেক্ষায় ফিলিস্তিনি মা

গাজায় যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার মধ্য দিয়ে। ওই হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের বেশি নিহত হন। জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় আড়াই শ জনকে। এখনো হামাসের হাতে জীবিত বা মৃত প্রায় ১০০ জন জিম্মি রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। সেদিন থেকেই গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন প্রায় ৪৭ হাজার মানুষ।

চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে মুক্তি পেতে যাওয়া ৩৩ জনের নামের তালিকা ইসরায়েলকে দিয়েছে হামাস। এর মধ্য তিনজনকে গতকাল মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি। তাঁদের বরণ করে নিতে তেল আবিবে ইসরায়েলিদের জড়ো হতে দেখা যায়। এই জিম্মিদের মুক্ত করতে ১৫ মাস ধরে আন্দোলন করেছেন তাঁরা।

এদিকে গতকাল প্রায় ৯০ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়ার কথা ইসরায়েলের। দেশটির বিভিন্ন কারাগারে তাঁরা বন্দী। তাঁদের মধ্যে নিজের দুই সন্তানও রয়েছেন বলে জানান দখলকৃত পশ্চিম তীরের এক নারী। তিনি বলেন, ‘সন্তানদের মুক্তির খবর শুনে প্রথমে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কাঁপছিলাম।’

গাজায় ঢুকছে ত্রাণের গাড়ি

গত ১৫ মাসে ইসরায়েলের হামলায় গাজার উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন সেখানকার ২৩ লাখ বাসিন্দা। শীত, ক্ষুধা, তৃষ্ণা পরিস্থিতি আরও বিভীষিকাময় করেছে। এরই মধ্যে গতকাল গাজা সীমান্তে ত্রাণবাহী শত শত ট্রাক জড়ো হয়। প্রায় ২০০ ট্রাক গাজায় প্রবেশের জন্য মিসর সীমান্তে অপেক্ষায় ছিল। যুদ্ধবিরতি শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে প্রথম ট্রাকগুলো গাজায় প্রবেশ করে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবিক-বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) প্রধান জোনাথন হুইটল।

এদিকে অনেক দিন পর শরণার্থীশিবির ছেড়ে প্রথমবারের মতো নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন গাজাবাসী। যদিও তাঁদের এই স্বস্তি কত দিন টিকবে, তা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করছেন। তবে যুদ্ধবিরতির চুক্তির প্রতি হামাস প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন সংগঠনটির মুখপাত্র আবু ওবেইদা। তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়ার সাফল্য নির্ভর করবে ইসরায়েলের সদিচ্ছার ওপর।

আরও পড়ুন

একমাত্র উপায় ‘দখলদারি বন্ধ’

গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিরুদ্ধে ছিলেন ইসরায়েল সরকারের কট্টর ডানপন্থীদের অনেকে। যুদ্ধবিরতি ইসরায়েলের মন্ত্রিসভায় পাস হলে পদত্যাগের হুমকিও দিয়েছিলেন তাঁরা। যেমন জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির গতকাল যুদ্ধবিরতি শুরুর পর পদত্যাগ করেছেন। বোঝাই যায় ফিলিস্তিনিদের রক্তপাত নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

এটি যে সত্যি, তা প্রমাণিত হয় গতকালের একটি ঘটনাতেই। যুদ্ধবিরতি যখন বিলম্ব হচ্ছে, সেই তিন ঘণ্টায়ও গাজায় হামলা চালাতে ছাড়েনি ইসরায়েল। এতে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৯ জন। ফিলিস্তিনিদের ওপর এই নৃশংসতা বন্ধের একমাত্র উপায় দখলদারি বন্ধ করা, এমনটা মনে করেন দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক তামের কারমত।

কারমত বলেন, ইসরায়েলিরা দাবি করতে পারে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে বড় পরিবর্তন এনেছে, হিজবুল্লাহকে দুর্বল করেছে, সিরিয়ায় সরকার পতন করেছে। তবে ফিলিস্তিনে এখনো তারা দখলদারির নীতিতে আটকে রয়েছে। এই দখলদারি যত দিন বন্ধ না হবে, তত দিন ফিলিস্তিনের এই সংঘাত থামবে না।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন