ইরান–ইসরায়েলের অর্থনীতি এই সংঘাত কত দিন চালিয়ে নিতে পারবে

তেল আবিবের রামাত গান এলাকায় গতকাল বৃহস্পতিবার হামলা চালায় ইরানছবি: রয়টার্স

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত দ্বিতীয় সপ্তাহে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এ অঞ্চলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য দেশ দুটির রয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

১৩ জুন ভোররাতে হামলা চালিয়ে ইরানের কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করে ইসরায়েল। এ ছাড়া হামলায় দেশটির কিছু পারমাণবিক স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জবাবে ইরানও ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। এতে দুই পক্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে।

তবে এই সংঘাত দুই দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এর মধ্যে দুটি দেশই শতকোটি ডলার ক্ষতির মুখে পড়েছে, যা তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করতে পারে।

যুদ্ধের পেছনে ইসরায়েলের কত খরচ

২০২৩ সালের অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধ শুরু করে ইসরায়েল। এখানো সেখানে যুদ্ধ চলছে। এরই মধ্যে ইরানের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনা দেশটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সংঘাতের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

ইসরায়েলের বাণিজ্যিক পত্রিকা ক্যালক্যালিস্ট ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা গেছে, শুধু গাজা যুদ্ধেই ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ইসরায়েলের মোট খরচ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৭০৫ কোটি মার্কিন ডলার।

গত ১৫ জুন ইসরায়েলের গণমাধ্যম ওয়াই নেট নিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইসরায়েলি সেনাপ্রধানের সাবেক আর্থিক উপদেষ্টার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর মাত্র দুই দিনেই ইসরায়েলের ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৪৫ কোটি মার্কিন ডলার। যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে সাত সপ্তাহের মধ্যে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ গাজা যুদ্ধের ব্যয়কে ছাড়িয়ে যেতে পারে।

ইরানের আরক পারমাণবিক স্থাপনায় গতকাল বৃহস্পতিবার হামলা চালায় ইসরায়েল। ২০০৬ সালে তোলা
ছবি: রয়টার্স

সর্বশেষ সংঘাত ইসরায়েলের ঋণপরিস্থিতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে

সম্প্রতি ইসরায়েলের রাজস্বের প্রক্ষেপণ কিছুটা বেড়েছে। ১৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। তবুও ২০২৫ সালে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ৩ দশশিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।

ব্যবসা জরিপ প্রতিষ্ঠান কো–ফেসবিডিআই–এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে জনবলসংকট, লজিস্টিক সমস্যা এবং দুর্বল ব্যবসায়িক অবস্থার কারণে প্রায় ৬০ হাজার ইসরায়েলি কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরুর আগে দেশটিতে যে পরিমাণ পর্যটক আসতেন, বর্তমানে তা বিপুল পরিমাণে কমে গেছে।

ইসরায়েল যদি ইরানের সঙ্গে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে এ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি বা ঋণমাণ নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস ইসরায়েলের অর্থনীতির দুর্বলতা নিয়ে একটি সতর্কতা জারি করেছে।

সংস্থাটি জানিয়েছে, ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে—বিশেষ করে ইরান দীর্ঘমেয়াদি ও কৌশলগতভাবে পাল্টা হামলা চালাতে থাকলে ইসরায়েলের ক্রেডিট রেটিং ‘এ’ থেকে ‘এ মাইনাসে’ নামিয়ে আনা হতে পারে। এর ফলে ঋণের খরচ বেড়ে ইসরায়েলি অর্থনীতিতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যেতে পারে।

হামলার আশঙ্কায় জাহাজে করে ইসরায়েল ছেড়ে যাচ্ছেন পর্যটকেরা। হাইফা বন্দর, ইসরায়েল, ১৯ জুন
ছবি: রয়টার্স

ইরানের জীবাশ্ম জ্বালানিশিল্পে কতটা প্রভাব পড়েছে

ইরানের অর্থনীতি অনেকটা তেল রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। কয়েক দিন ধরে দেশটির তেল রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান কেপলারের তথ্য অনুযায়ী, গত রোববার দেশটির অপরিশোধিত তেল ও গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া কনডেনসেট রপ্তানি ১ লাখ ২ হাজার ব্যারেলে নেমে এসেছে। অথচ পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছর প্রতিদিন গড়ে ২ লাখ ৪২ হাজার ব্যারেল রপ্তানি করার কথা ছিল।

ইরানের ৯০ শতাংশের বেশি তেল রপ্তানি করা হয় খার্গ দ্বীপ থেকে। গত শুক্রবার থেকে সেখানকার রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। এলএসইজি স্যাটেলাইট শিপ ট্র্যাকিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবার পর্যন্ত খার্গ দ্বীপে কোনো তেলবাহী জাহাজ নোঙর করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য সংস্থার (ইআইএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ইরান গড়ে দৈনিক প্রায় ৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করেছে। এসব তেলের প্রধান ক্রেতা ছিল চীন।

পারস্য উপসাগরে অবস্থিত সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্র কাতার ও ইরানের যৌথ মালিকানাধীন। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র। ইরানের মোট গ্যাস উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ এখান থেকেই আসে। ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কারণে গত শনিবার সাউথ পার্স গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস উৎপাদন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে ইরান।

ইসরায়েলের হামলায় নিহত দুই রেড ক্রিসেন্টকর্মীকে শেষবিদায় দিচ্ছেন তাঁর স্বজনেরা। তেহরান, ইরান
ছবি: এএফপি

ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে

১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। পরবর্তী সময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এই নিষেধাজ্ঞা আরও জোরদার করা হয়।

পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে তেহরানকে একটি চুক্তি করার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোকে ইরানের কাছ থেকে তেল কেনা কমাতে বা বন্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই প্রচেষ্টার ফলে দেশটির ওপর আরও বাড়তি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।

তবে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইরানের স্বাক্ষরিত জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন চুক্তির ফলে এই নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করা হয়। এর পরের বছর ইরান প্রতিদিন গড়ে ২ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ২০১৮ সালে ইরানের ওপর আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা দেন। তিনি অধিকাংশ দেশকে ইরানের কাছ থেকে অপরিশোধিত তেল কেনা বন্ধ করতে আবারও চাপ দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য সংস্থার (ইআইএ) তথ্য অনুযায়ী, এর ফলে ২০২২ ও ২০২৩ সালে তেল রপ্তানি করে ইরান মাত্র ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। এ সময় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করা হয়, যা ২০১৬ সালে তেল রপ্তানির তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ কম।

বারবার নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ইরানের প্রধান তেল ক্রেতা হচ্ছে চীন। অল্প কয়েকটি দেশ যারা এখনো তেহরানের সঙ্গে বাণিজ্য করছে, চীন তাদের অন্যতম।

আরও পড়ুন
ইরানের হামলার আশঙ্কায় ইসরায়েলের বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ সাইপ্রাসে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সাইপ্রাস, ১৯ জুন
ছবি: এএফপি

ইরানের অন্যান্য চ্যালেঞ্জ

শুধু নিষেধাজ্ঞার চাপেই নয়, ইরান আরও বেশ কয়েকটি গুরুতর সংকটে ভুগছে। এর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি ও পানিসংকট, মুদ্রার ভয়াবহ দরপতন এবং আঞ্চলিক মিত্রদের সামরিক পরাজয়। নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে এসব সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।

এ ছাড়া বিনিয়োগ-ঘাটতি, প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন হ্রাস এবং অকার্যকর সেচব্যবস্থা—এসব কারণে ইরানে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট ও পানিসংকট তৈরি হয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ওয়েবসাইটগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ইরানের ওপর আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে দেশটির মুদ্রার (রিয়াল) ৯০ শতাংশ দরপতন হয়েছে।

সরকারি হিসাবে ইরানের বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ৪০ শতাংশ। তবে দেশটির কিছু অর্থনীতিবিদের মতে, প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার ৫০ শতাংশের বেশি হতে পারে।

লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান টিএস লমবার্ডের অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হামজা আল গাউদ বলেন, সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, তবে বাস্তব পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ।

ইসরায়েলের হামলায় জ্বলছে ইরানে অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম বড় গ্যাসক্ষেত্র সাউথ পার্স। ১৪ জুন, বুশেহর প্রদেশ
ছবি: রয়টার্স

গত জানুয়ারিতে ইরানের শ্রম ও সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের প্রধান ইব্রাহিম সাদেগিফারকে উদ্ধৃত করে দেশটির আধা সরকারি সংবাদমাধ্যম তাসনিম নিউজ এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশটির ২২ থেকে ২৭ শতাংশ নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে।

অবশ্য সরকারি হিসাবে দেশটিতে বেকারত্বের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ। তবে ইরানের শ্রমিকদের শীর্ষ সংগঠন সুপ্রিম অ্যাসেম্বলি অব ওয়ার্কার্স রিপ্রেজেন্টেটিভসের তথ্য অনুযায়ী, জীবিকা নির্বাহের উপযোগী কাজ না থাকা মানুষের সংখ্যা এই হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি।

ইরানের খরচ করার সামর্থ্য

হামজা আল গাউদের মতে, বাজেটে সামরিক খাতে তুলনামূলক কম খরচ করে ইরান। মোট জিডিপির মাত্র ৩ থেকে ৫ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করে, যা অর্থমূল্যে দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার।

বর্তমানে ইরানের ব্যবহারযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

হামজা আল গাউদ বলেন, এই জায়গাতেই ইরান পিছিয়ে পড়ছে। স্বল্পমেয়াদি সামরিক সংঘাত মোকাবিলায় রিজার্ভ ব্যবহার করলে, দীর্ঘমেয়াদে তাদের অর্থনীতি ভয়াবহ চাপে পড়বে।

আরও পড়ুন