হঠাৎ এত দিলখোলা কেন সৌদি যুবরাজ

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান
ছবি: রয়টার্স

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাকে একসময় হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ‘এমবিএস’ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত সেই সৌদি যুবরাজ এখন আঞ্চলিক সমৃদ্ধির নতুন যুগের সূচনার কথা বলে সমঝোতার সবুজ সংকেত দিচ্ছেন।

প্রথম যখন মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদির যুবরাজ হন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৯ বছর। ক্ষমতায় এসেই ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে তিনি নৃশংসতম হামলা শুরু করেছিলেন। কিন্তু এখন আড়াল থেকে আলোচনার কথা বলছেন। তাঁর এই আলোচনার প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত হয়তো ইয়েমেন থেকে সৌদি সৈন্যদের প্রত্যাহারের পথ খুলে দিতে পারে।

যুবরাজ হলেও কার্যত সৌদি আরবের শাসক বলা যায় মোহাম্মদ বিন সালমানকে। তিনি এখন আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী কাতার ও তুরস্কের সঙ্গে তিক্ততা কমিয়ে আনতে আলোচনার কথা বলছেন। এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে নিজেদের সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন।

এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা কমিয়ে আনা হচ্ছে দারুণ এক কৌশল। এই চুক্তির মাধ্যমে সৌদি আরব তার আশপাশের প্রক্সি যুদ্ধ থেকেও রেহাই পেতে পারে
অ্যানা জ্যাকবস, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসব উদ্যোগ থেকে ইঙ্গিত মিলছে, সৌদি আরবের যুবরাজ নতুন রূপে বিশ্বমঞ্চে আসতে চাচ্ছেন। একজন ধ্বংসাত্মক নেতা থেকে এখন বাস্তববাদী ‘প্রভাবশালী খেলোয়াড়’ হতে চান তিনি।

বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৌদি পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ওমর করিম বলছিলেন, ইরানের সঙ্গে চুক্তির পর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সৌদি যুবরাজের মধ্যে ‘বিশাল পরিবর্তন’ লক্ষ করা যাচ্ছে। অবশ্য, আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমনে তাঁর এমন উদ্যোগ কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে এখনই কোনো অনুমান করা যাচ্ছে না।

নিওম মেগাসিটি প্রকল্পের কাজ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়াও সৌদি যুবরাজের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ–রয়টার্স

ইরানের সঙ্গে চুক্তি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সাত বছর পর আগামী মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দুই দেশ একে–অন্যের রাজধানীতে দূতাবাস চালু করতে পারে।

সৌদি আরব আর সিরিয়াও দুই দেশের মধ্যে কনস্যুলেট চালুর বিষয়ে কথা বলছে। গত বৃহস্পতিবার সৌদির রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই ছিল না মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশটির।

সৌদি আরবের নিওম বা আলাউলা শহরে যদি একটি ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ে, তাহলে কোনো বিনিয়োগ বা পর্যটন আর থাকবে না। পুরো স্বপ্নই শেষ হয়ে যাবে।

রিয়াদ কোনো রাখঢাক না রেখেই দীর্ঘদিন ধরে আসাদ সরকারকে উৎখাত করতে নানা তৎপরতা চালিয়ে আসছিল।

ভবিষ্যতে কী হবে, তা এখন মুখ্য বিষয় নয়। আপাতত রিয়াদের কর্মাকাণ্ডে তাদের উদ্দেশ্য অনেকটা পরিষ্কার। সেটা হচ্ছে, দেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারকাজ চালিয়ে যেতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনতে চাচ্ছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।

সৌদি সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য। কারণ, আপনার সঙ্গে যদি অঞ্চলেরও উন্নতি না হয়, তাহলে আপনি যা কিছু অর্জন করুন, তাতে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকবে।’

হুমকির মুখে স্বপ্ন

দেশের মধ্যে নানা সংস্কারকাজ চালু করে প্রথমে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের ভাবমূর্তি বেশ খানিকটা উজ্জ্বল করতে পেরেছিলেন।

যুবরাজ সৌদিতে নারীকে গাড়ি চালানো, সিনেমা হল খুলে দেওয়া, পর্যটন ভিসা চালুসহ নানা সংস্কারমূলক কাজ করেছেন। ধর্মীয় পুলিশ বাহিনীকে তিনি নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন।

তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে নিউক্যাসল ইউনাইটেড থেকে জাপানের বহুজাতিক ভিডিও গেম কোম্পানি নিনতেন্দোতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করে সৌদি সরকার। এর মাধ্যমে তাঁর ‘ভিশন–২০৩০’ সংস্কার কেমন হতে পারে, তার একটি নমুনা দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি।

ব্যাপক দমন–পীড়ন বিশেষ করে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের পর যুবরাজের এসব সংস্কারকাজ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

তবে সৌদি কর্মকর্তারা এ–ও বুঝতে পারছেন, যুবরাজ বিন সালমানের বিরাট পরিকল্পনার জন্য নিরাপত্তা হুমকিও কম নেই। বিশেষ করে ইরানের হুমকির বিষয়ে তারা সজাগ।

২০১৯ সালে সৌদি আরবের বেশ কয়েকটি তেল স্থাপনায় ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের হামলার বিষয়টি স্মরণ করা যেতে পারে। ওই হামলার ফলে সৌদি সরকারকে তেল উত্তোলন সাময়িকভাবে অর্ধেকে কমিয়ে আনতে হয়েছিল।

তখন রিয়াদ ও ওয়াশিংটন অভিযোগ তুলেছিল, ওই হামলার পেছনে তেহরানের হাত রয়েছে। তবে ইরান সেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল।

বিশ্লেষক ও কূটনীতিকেরা বলছেন, ওই ঘটনা এই অঞ্চলের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সৌদি আরব আঞ্চলিক ঐক্যের বিষয়ে তখন থেকে বেশ তাগিদ অনুভব করছিল।

সৌদি কর্মকর্তারা ওই সময় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হালকা প্রতিক্রিয়ায় খুবই হতাশ হন। তাদের মনে বিশ্বাস জন্মায়, যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণ দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশকের তেলের বিনিময়ে নিরাপত্তা বাণিজ্যকে খাটো করেছে।

রিয়াদভিত্তিক এক আরব কূটনীতিক বলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের আচরণে সৌদি আরব এতটাই হতাশ হয়েছিল যে তারা ভেবেই নিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র তাদের রক্ষায় কিছুই করেনি।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সৌদি কর্মকর্তারা আমাদের বলেছেন, তাঁরা এখন বড় বড় প্রকল্পে গুরুত্ব দিতে চান।’ কূটনীতিক বলেন, এসব প্রকল্পের মধ্যে নিওম (এনইওএম) নামে পরিচিত ভবিষ্যৎ মেগাসিটি ও উত্তরাঞ্চলীয় আলাউলা শহরে বিকাশমুখী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের মতো প্রকল্প রয়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, সৌদি আরবের নিওম বা আলাউলা শহরে যদি একটি ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ে, তাহলে কোনো বিনিয়োগ বা পর্যটন আর থাকবে না। পুরো স্বপ্নই শেষ হয়ে যাবে।

উত্তেজনা প্রশমন

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান কেবল একা ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছেন না; প্রতিবেশী কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত গত বছরই আবার ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে।

তবে সৌদি–ইরান চুক্তি অন্যান্য দেশের মতো নয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এই চুক্তি অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করছে। কারণ, এই অঞ্চলে প্রভাবশালী এই দুই দেশ একে–অন্যের প্রতিপক্ষ। ইয়েমেন সংঘাতে তারা একে–অন্যের মুখোমুখি। শুধু সেখানে নয়, লেবানন ও ইরাকেও তারা একে–অন্যের শত্রু।

ইউরেশিয়া গ্রুপের আইহাম কামেল বলেন, সৌদি যুবরাজ মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিকে নতুন করে সাজাতে চাচ্ছেন। তিনি সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিবেশের উন্নয়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের অ্যানা জ্যাকবস বলেন, এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা কমিয়ে আনা হচ্ছে দারুণ এক কৌশল। এই চুক্তির মাধ্যমে সৌদি আরব তার আশপাশের প্রক্সি যুদ্ধ থেকেও রেহাই পেতে পারে।

চুক্তির বাস্তবায়নে এখন সৌদি ও ইরানের কর্মকর্তাদের আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। তবে এখনো তাদের বৈঠকের কোনো সময়সূচি ঠিক হয়নি।

চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে ইরানের এক কর্মকর্তা বলেছেন, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বাবা বাদশাহ সালমান ইরানি প্রেসিডেন্টকে সৌদি আরব সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে রিয়াদের পক্ষ থেকে এই আমন্ত্রণের বিষয়ে এখনো অবশ্য পরিষ্কার কিছু জানানো হয়নি।

সন্দেহ নেই, দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের মুখোমুখি বৈঠকের ওপর পুরো বিশ্ব গভীর নজর রাখবে। কারণ, দুই দেশের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য এখনো বেশ ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে রয়েছে।

জ্যাকবস বলেন, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে অবিশ্বাস অনেক গভীরে। দুই পক্ষকেই এখন সবকিছু ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। তাহলেই তাদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।