লেবাননের কারাগারে কেন অনশনে গাদ্দাফির ছোট ছেলে

হান্নিবাল গাদ্দাফি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

লিবিয়ার সাবেক নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির ছেলে হান্নিবাল গাদ্দাফি লেবাননের কারাগারে বন্দী আছেন। বছরের পর বছর ধরে বিনা বিচারে বন্দী রাখার প্রতিবাদে সম্প্রতি তিনি অনশন শুরু করেছেন। হান্নিবালের আইনজীবী গতকাল বৃহস্পতিবার আল–জাজিরাকে ফোনে বলেছেন, অনশন শুরুর পর থেকে তাঁর মক্কেলের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে।

গতকাল হান্নিবালের অনশন ধর্মঘটের ষষ্ঠ দিন ছিল। এদিন আল–জাজিরাকে তাঁর আইনজীবী বলেন, ৪৭ বছর বয়সী হান্নিবালের পেশি, হাত ও পায়ে খিঁচুনির মতো অনুভূতি হচ্ছে। তাঁর মাথা ঘোরা ও মাথাব্যথার মতো সমস্যা দেখা দিয়েছে। হান্নিবালের আগে থেকে মেরুদণ্ড ও নিতম্বে সমস্যা ছিল। অনশনের কারণে সেসব সমস্যা বেড়ে গেছে। প্রতিদিন একজন চিকিৎসক তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

মুয়াম্মার গাদ্দাফির পঞ্চম এবং ছোট ছেলে হান্নিবাল ২০১৫ সাল থেকে বৈরুতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর সদর দপ্তরে বন্দী আছেন। ১৯৭৮ সালে লেবাননের শিয়া ইমাম মুসা আল সদর লিবিয়ার ত্রিপোলিতে ভ্রমণে গিয়ে নিখোঁজ হন। ওই সময় হান্নিবালের বয়স ছিল তিন বছর।

আল সদর শিয়া রাজনৈতিক দল আমাল মুভমেন্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। লেবাননের দাবি, সদরের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি দায়ী।

২০১১ সালে ত্রিপোলির পতন ও বিরোধীদের হাতে মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিহত হওয়ার পর হান্নিবাল তাঁর স্ত্রী ও ভাইবোনদের কয়েকজনের সঙ্গে আলজেরিয়ায় পালিয়ে যান। পরে তিনি সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের অধীনে রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন।

অপহরণ, তারপর লেবাননে আটক

আইনজীবীরা বলছেন, ২০১৫ সালে একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার নেওয়ার নাটক সাজিয়ে হান্নিবালকে সিরিয়া-লেবানন সীমান্তে ডাকা হয়েছিল। তখন তাঁকে সাময়িকভাবে অপহরণ করা হয় এবং লেবাননের একটি দল তাঁকে আল সদরের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

হান্নিবালের আইনজীবী দলের দাবি, লেবাননে ইরান–সমর্থিত শিয়া রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহর তৎকালীন পার্লামেন্ট সদস্য হাসান ইয়াকুব এ অপহরণের ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন। ইয়াকুবের বাবা ও সাংবাদিক আব্বাস বদর এল দিনে লিবিয়ায় ওই সফরে সদরের সঙ্গে ছিলেন। তাঁকেও আর কখনো দেখা যায়নি।

২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর অপহৃত অবস্থায় হান্নিবালের দেওয়া একটি ভিডিও বার্তা লেবাননের আল–জাদিদ টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয়। ভিডিওতে তাঁর থেঁতলে যাওয়া নাক দেখা গেলেও তিনি বলেন, সুস্থ আছেন। আল সদরের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে যাদের কাছে তথ্য আছে, তাদের সামনে আসতে তিনি আহ্বান জানান।

ভিডিওটি প্রকাশের এক দিন পর বালবেক শহরে হান্নিবালকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর লেবাননের কর্তৃপক্ষ তাঁকে বৈরুতে নিয়ে যায়।

ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর ওই অপহরণের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ইয়াকুবকে আটক করা হয়। পরে তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। ইয়াকুবের দাবি, তিনি হান্নিবালের অপহরণের ঘটনায় জড়িত নন।

আল সদরের নিখোঁজ হওয়াকে কেন্দ্র করে লেবানন ও লিবিয়ার মধ্যে কয়েক দশক ধরে সম্পর্কের অবনতির কারণে বারবার হান্নিবালকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

হান্নিবালকে গ্রেপ্তারের পরপরই সিরিয়া তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। তবে হান্নিবালকে কোনো অপরাধের অভিযোগে ধরতে সিরিয়ায় অভিযান চালানো হচ্ছে না উল্লেখ করে লেবাননের আদালত সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।

আল সদরের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় তাঁর পরিবার তথ্য লুকানোর অভিযোগে হান্নিবালের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। এরপর ২০১৬ সালে লেবাননের একটি আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

আট বছর ধরে কারাবন্দী হান্নিবাল বিভিন্ন সময়ে তাঁর আইনি পরামর্শক দল পরিবর্তন করেছেন।

লেবাননের বিচারব্যবস্থাকে অবমাননার অভিযোগে ২০১৮ সালে হান্নিবালকে ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁকে এক বছরের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়েছিল।

হান্নিবালের আইনজীবীদের একজন আল–জাজিরাকে বলেন, তিনি তাঁর প্রকৃত অবস্থার প্রতি জনগণ ও সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে এই অনশন শুরু করেছেন। তাঁর ধারণা, তাঁর কথা সবাই ভুলে গেছে। তিনি এটা আর মেনে নিতে পারছিলেন না দেখে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।

তবে লেবাননে হান্নিবালের প্রতি মানুষের সমর্থন খুব হাতে গোনা। মূলত সিরিয়াপন্থী ও শিয়াবিরোধী ব্যক্তিদের অনেকে তাঁর পক্ষে। আর লেবাননের শিয়া দলগুলো হান্নিবালকে কারাবন্দী রাখতে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

বাবা মুয়াম্মার গাদ্দাফির শাসনামলে হান্নিবালের ভূমিকা কী ছিল, তা জানা যায়নি। বিলাসী ও বেপরোয়া জীবনযাপনের জন্য তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন।

একমাত্র অপরাধ গাদ্দাফির সন্তান

হান্নিবালের নতুন আইনজীবী দলের সদস্যরা এক মাস আগে কাজ শুরু করেছেন। তাঁরা আল–জাজিরাকে বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সহযোগিতা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হান্নিবালের মামলাটি নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।

হান্নিবাল বরাবরই নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে আসছেন। ২০২২ সালে সৌদি টিভি আল–হাদাথে প্রকাশিত এক চিঠিতে হান্নিবাল জানতে চান, কী করে একজন শিশু (১৯৭৮ সালে) বলতে পারবে আল সদরের কী পরিণতি হয়েছে।

হান্নিবাল গাদ্দাফির আইনজীবী বলেন, তিনি নির্দোষ। তাঁর একমাত্র অপরাধ তিনি গাদ্দাফির ছেলে। এ ছাড়া তাঁর আর কোনো অপরাধ নেই।