ইসরায়েলের ফেরত দেওয়া ফিলিস্তিনিদের মরদেহে নির্যাতনের চিহ্ন

ইসরায়েলের ফেরত পাঠানো ৩০ ফিলিস্তিনির মরদেহের ব্যাগ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর পর মেঝেতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন ফিলিস্তিনের এক স্বাস্থ্যকর্মী। এসব মরদেহে ভয়াবহ রকম নির্যাতনের চিহ্ন ছিল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। শুক্রবার দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সেএএফপি

ইসরায়েলের সেনাদের নির্যাতনে প্রাণ হারানো আরও ৩০ ফিলিস্তিনির মরদেহ গত শুক্রবার গাজায় পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির মাধ্যমে পাঠানো এসব মরদেহে নানা নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে। একই দিন ইসরায়েলের কাছে তিন মরদেহ হস্তান্তর করেছে হামাস। তবে গতকাল শনিবার ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মরদেহ তিনটি গাজায় থাকা ইসরায়েলি বন্দীদের নয়।

ফিলিস্তিনিদের মরদেহে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই শুক্রবার এক ফিলিস্তিনি বন্দীকে নির্যাতনের একটি ভিডিও প্রকাশের ঘটনায় ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর শীর্ষ আইনজীবী ইয়াফাত তোমের-ইয়েরুশালমিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত বছর প্রকাশ হওয়া ওই ভিডিওতে ইসরায়েলের কুখ্যাত সদে তাইমান কারাগারের এক ফিলিস্তিনি বন্দীকে ইসরায়েলি সেনাদের নির্যাতন করতে দেখা গেছে। অভিযোগ উঠেছে, ওই ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের সেনাদের দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন।

ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, যুদ্ধবিরতির পর থেকে ইসরায়েল শুক্রবার পর্যন্ত মোট ২২৫ ফিলিস্তিনির মরদেহ ফেরত পাঠিয়েছে।

ইসরায়েলের পাঠানো ফিলিস্তিনিদের মরদেহে নির্যাতনের চিহ্ন নতুন কিছু নয়। শুক্রবার পর্যন্ত আগের ২১ দিনে ইসরায়েল আরও যেসব ফিলিস্তিনির মরদেহে পাঠিয়েছে, সেগুলোতেও নানা ধরনের নির্যাতনের চিহ্ন ছিল বলে নিশ্চিত করেছেন চিকিৎসকেরা। এসব মরদেহে কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা বা হাত-পা বাঁধার চিহ্ন, আগুনে পোড়ার ক্ষত, দাঁতসহ কিছু অঙ্গ না থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

মিডল ইস্ট আই জানায়, গতকাল গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক মুনির আল-বুরশ বলেন, সর্বশেষে যেসব মৃতদেহ ইসরায়েল ফেরত পাঠিয়েছে, সেগুলো শনাক্ত করা সবচেয়ে কঠিন ছিল। তাঁর ভাষায়, ‘অধিকাংশ মরদেহ নষ্ট হয়ে গেছে বা ট্যাংকের চাপায় হাড় পর্যন্ত ভেঙে গেছে। কিছু ব্যক্তিকে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল।’

রয়টার্স জানায়, গত ১০ অক্টোবর ঘোষিত যুদ্ধবিরতি অনুযায়ী, হামাস জীবিত ২০ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে। বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, হামাস ২৮ ইসরায়েলি বন্দীর মরদেহ হস্তান্তর করতে রাজি হয়েছে। সর্বশেষ তিনজন ছাড়াও হামাস এরই মধ্যে ১৭ জনের মরদেহ হস্তান্তর করেছে। ইসরায়েলের ৩৬০ ফিলিস্তিনির মরদেহ হস্তান্তরের কথা, যাদের গত দুই বছরে হত্যা করা হয়েছে।

হামাস বলেছে, রেড ক্রসের সহযোগিতায় তারা গাজার ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ইয়েলো লাইন’ এলাকাতেও জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধারের কাজ চালাতে চায়। এ জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও সহযোগিতা দরকার।

হামলা অব্যাহত

শুক্রবার পর্যন্ত টানা চার দিন গাজার বিভিন্ন এলাকায় গোলা ও বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের সেনারা, যাতে অন্তত ১০৪ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শুক্রবার নিহত হয়েছেন ৩ জন। এদিন মধ্য গাজার আজ-জাহরা এলাকার আবি মেদেইন পরিবারের বিধ্বস্ত বাড়িঘর থেকে আলাদা করে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

যুদ্ধবিরতির পর ফিলিস্তিনের বিধ্বস্ত উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ২০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

ইউরো-মেডিটেরেনিয়ান মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থার তথ্যমতে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার পরও প্রতিদিন গড়ে ১০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যার মধ্য দিয়ে গাজায় জাতিগত নিধন অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। ইহুদি রাষ্ট্রটির দুই বছরের হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ৬৮ হাজার ৫৩১–এ। আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৯৫ জন।

তুরস্কে বৈঠক

শুক্রবার তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান আঙ্কারায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, কয়েকটি আরব ও মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা গাজা যুদ্ধবিরতি এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনার জন্য আগামীকাল সোমবার ইস্তাম্বুলে বৈঠকে বসবেন। বৈঠকে গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা অংশ নিয়েছিলেন তাঁরাও থাকবেন।

যুদ্ধবিরতি কতটা সফল হবে, তা নিয়ে তুরস্কের আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে হাকান ফিদান বলেন, সোমবারের বৈঠকে গাজা টাস্কফোর্স এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠন নিয়েও আলোচনা হবে।

গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকে কাতার, সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক কাউন্সিল ফর আরব-ব্রিটিশ আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের পরিচালক ক্রিস ডয়েল আল–জাজিরাকে বলেন, অংশগ্রহণকারীরা যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি পরবর্তী ধাপগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। উত্তেজনা ও জাতিগত নিধনের মাত্রা কমানো যথেষ্ট নয় বরং যথাযথ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়া উচিত।