গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি
চুক্তির পর সরকার টেকানো নিয়ে চাপে নেতানিয়াহু
গাজা দখল, ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ ও সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের যে স্বপ্ন কট্টর ইসরায়েলিদের, তা এই চুক্তির ফলে ভেঙে যাবে।
গাজায় যুদ্ধবিরতিকে মহান দিন হিসেবে বর্ণনা করেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে গাজায় চালানো নির্বিচার হামলাকে কূটনৈতিক ও সামরিক বিজয় হিসেবে দেখছেন তিনি। তবে গাজায় যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার বিষয়টি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর শেষের শুরু হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে ইসরায়েলি সমাজের প্রায় সবাই সমর্থন করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর চরম ডানপন্থী জোটসঙ্গীরা তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের অসন্তোষের কথা সরাসরি বলে দিয়েছেন। কারণ, এই যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের শুরু অনুযায়ী ইসরায়েলকে প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। এর মধ্যে ২৫০ জন সন্ত্রাসবাদ-সংশ্লিষ্ট অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
ইসরায়েলের কট্টর জাতীয়তাবাদীদের জন্য আরও উদ্বেগের বিষয় হলো তাঁদের দীর্ঘদিন ধরে গাজা দখল, ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ ও সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের যে স্বপ্ন, তা এই চুক্তির ফলে ভেঙে যাবে। কারণ, চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েলকে গাজায় ধ্বংসাত্মক সামরিক অভিযান স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া হামাসকে পুরোপুরি নিরস্ত্রীকরণ বা ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে ইসরায়েলকে গাজা দখল না করার অঙ্গীকারও করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে নেতানিয়াহুর যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার বিষয়টি এখন তাঁর জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করেছে। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক মিত্রদের তুষ্ট রাখতে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার অভিযোগ উঠেছে। এখন যুদ্ধবিরতি চুক্তির ফলে চরম ডানপন্থীদের সমর্থন হারাতে পারেন তিনি। এ সমর্থনের ওপর নির্ভর করেই তিনি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে সরকার টিকিয়ে রেখেছেন।
ডানপন্থীদের বিরোধিতা
গতকাল শুক্রবার ভোরে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সহজেই পাস হয়েছে। তবে এর বিরোধিতা করেছে ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচের রিলিজিয়াস জায়নিজম পার্টি এবং নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গাভিরের জিউইশ পাওয়ার পার্টি।
স্মোটরিচ ও বেন গাভির—দুজনেই চুক্তির বিপক্ষে ভোট দিলেও এখনো প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেননি। তবে মন্ত্রিসভায় ভোটের আগে বেন গাভির হুমকি দিয়ে বলেন, ‘হামাসের শাসন ভেঙে না ফেলা হলে জিউইশ পাওয়ার সরকারই ভেঙে দেবে।’
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনায় পুরো যুদ্ধ বন্ধ ও ‘মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি’ প্রতিষ্ঠার একটি সামগ্রিক চুক্তির ধারণা রয়েছে। কিন্তু নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, এই চুক্তির কেবল ‘প্রথম ধাপ’ নিয়েই সমঝোতা হয়েছে। অর্থাৎ জিম্মিদের বিনিময়ে বন্দিবিনিময় এবং ইসরায়েলি সেনাদের আংশিক পুনর্বিন্যাস, এর বেশি কিছু নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনায় যেসব ভবিষ্যৎ ধাপ রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং গাজা পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক পক্ষ ও ফিলিস্তিনিদের নিয়ে গঠিত একটি বিকল্প কমিটি। এগুলোর বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনাই শুরু হয়নি।
নেতানিয়াহুর প্রচারক ট্রাম্প
নেতানিয়াহুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মিত্র প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত সপ্তাহে স্পষ্ট করে বলেন, গাজা যুদ্ধে তাঁর ধৈর্য কমে এসেছে এবং তিনি এটিকে শেষ করার চেষ্টা করছেন। ট্রাম্পের চাপের মুখে নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতি মানতে বাধ্য হতে হয়েছে।
তবে নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠরা যুক্তি দেন, নেতানিয়াহু নিজেও কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধ শেষ করতে প্রস্তুত ছিলেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী জোট ভেঙে আগাম নির্বাচন দিতে হলেও তিনি যুদ্ধ শেষ করতে চাইছিলেন। এর কারণ, নেতানিয়াহু এ সময়টাকেই যুদ্ধ শেষ করার জন্য সঠিক বলে মনে করছিলেন।
নেতানিয়াহুর সঙ্গে আগে কাজ করা রাজনৈতিক কৌশলবিদ নাদাভ শেঠাউখলার বলেছেন, ‘এখন সরে আসার সময় যথাযথ ছিল। কারণ, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর সঙ্গে ভবিষ্যতের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তির সম্ভাবনা এবং ট্রাম্পের ইসরায়েল সফরের বিষয়গুলো এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
চুক্তির সমর্থনে বিবৃতি দেওয়া বিরোধী নেতারা এখন দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছেন। চুক্তি দ্বিতীয় ধাপে গেলে এবং ইসরায়েল সেনা সরিয়ে নিলে নেতানিয়াহুর জোট সরকার ভেঙে যাবে এবং নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।
বিরোধী এক নেতা বলছেন, ২০২৬ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও নেতানিয়াহু এটিকে যতক্ষণ সম্ভব দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করতে পারেন।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ইসরায়েলে ক্ষোভ থাকলেও সেখানে এখন ট্রাম্প ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এটিই নেতানিয়াহুর জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক খবর। ট্রাম্পই নেতানিয়াহুকে জনপ্রিয় নেতা বলে প্রচার করে যাচ্ছেন।