যুদ্ধবিরতিতে হামাস-ইসরায়েলকে কি রাজি করাতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে গাজায় বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। বাড়ছে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশাও। এমন সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। হামাস ও ইসরায়েলের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসছে তারা। তবে আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে যুদ্ধবিরতিতে যেতে ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়িয়েছে হোয়াইট হাউস। মার্কিনিদের এই তৎপরতার মুখে ইসরায়েল কি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে রাজি হবে, জানিয়েছেন বিবিসির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদদাতা হুড়ো বাচেগা।

ইসরায়েলের হামলায় বিধ্বস্ত গাজার একটি এলাকাফাইল ছবি: রয়টার্স

গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো কখনোই সহজ হয়নি। সপ্তাহের পর সপ্তাহ আলোচনা বসেও নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে ঐকমত্য হয়নি দুই পক্ষের। তবে এমন একটি চুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েই চলেছে।

গাজায় যুদ্ধবিরতির চুক্তির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রও। দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের প্রধান উইলিয়াম বার্নসকে মিসরের রাজধানী কায়রোয় পাঠাচ্ছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। সেখানে চুক্তির লক্ষ্যে নতুন আলোচনায় অংশ নেবেন তিনি।

গাজায় নতুন যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রস্তাব তুলে ধরেছে। সে অনুযায়ী প্রাথমিক ধাপে উপত্যকাটিতে ছয় সপ্তাহ যুদ্ধবিরতি চলবে।

ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে কিছু দাবি ছিল হামাসের। যেমন গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং ইসরায়েলের হামলার মুখে উত্তর গাজা থেকে পালিয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের আবার নিজের এলাকার ফেরার সুযোগ দেওয়া। এখনো সেসব দাবিতে অনড় রয়েছে হামাস।

গাজা ইস্যুতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও মাটি কামড়ে রয়েছেন। যুদ্ধ থামাতে আন্তর্জাতিক মহলের আহ্বান ও হুঁশিয়ারির মধ্যেও তিনি বলেই চলেছেন—হামাস নির্মূল এবং গোষ্ঠীটির হাতে জিম্মি থাকা ইসরায়েলিদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত গাজায় লড়াই চালিয়ে যাবেন তাঁরা।

২০১১ সালে ইসরায়েলি সেনা গিলাড সালিতের মুক্তির জন্য হামাসের সঙ্গে এক চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিলেন গেরশন বাসকিন নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেছেন, ‘এটা স্পষ্ট যে (যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে রাজি হতে) ইসরায়েলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বড় চাপ রয়েছে। আর হামাসকে চাপ দিচ্ছে মিসর ও কাতার। এখন সিআইএ প্রধান সামনে এসেছেন। এটি যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বৃদ্ধির বিষয়টি ইঙ্গিত করছে।’

হামাস যোদ্ধাদের মহড়া
ফাইল ছবি: রয়টার্স

তবে এর অর্থ এই নয় যে যুদ্ধবিরতি শেষ পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে। গাজায় সংঘাতের কারণে ইসরায়েলকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রদেশগুলোর অসন্তোষ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের কর্মকর্তারা যুদ্ধবিরতির চুক্তির ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন। চলতি সপ্তাহের শুরুতেই দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, যুদ্ধবিরতির জন্য এখনই উপযুক্ত সময়।

নতুন করে যুদ্ধবিরতি হলে হামাসের হাতে জিম্মি বেশ কয়েকজন মুক্তি পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এর বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী কিছু ফিলিস্তিনিকেও ছেড়ে দেওয়া হবে। গত নভেম্বরে গাজায় সাত দিনের যুদ্ধবিরতির সময় এমনটিই দেখা গিয়েছিল। ইসরায়েলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনো ১৩৩ জন গাজায় জিম্মি রয়েছেন। জিম্মিদের মধ্যে অন্তত ৩০ জন এরই মধ্যে মারা গেছেন।

গাজায় নতুন যুদ্ধবিরতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রস্তাব তুলে ধরেছে। সে অনুযায়ী প্রাথমিক ধাপে উপত্যকাটিতে ছয় সপ্তাহ যুদ্ধবিরতি চলবে। এ সময় জীবিত থাকা জিম্মিদের মধ্য থেকে ৪০ জনকে মুক্তি দেবে হামাস। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে নারীদের। অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবেন সেনাসদস্য, ৫০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ ও মারাত্মক শারীরিক জটিলতায় ভোগা রোগীরাও। বিনিময়ে অন্তত ৭০০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে ইসরায়েল। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০০ জন ইসরায়েলি নাগরিকদের হত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা খাটছেন।

আরও পড়ুন

তবে হামাস নাকি যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারীদের বলেছে, ইসরায়েল যে ধরনের ৪০ জনকে মুক্তির শর্ত দিয়েছে, তেমন জিম্মি তাদের কাছে নেই। এতে করে কিছু আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তা হলো, গাজায় যতজন জিম্মি মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল, সংখ্যাটা হয়তো তার চেয়ে বেশি। আর অনেক জিম্মিই হয়তো ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদসহ অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে রয়েছেন।

ইসরায়েলের বেশির ভাগ মানুষই গাজায় হামলার পক্ষে। তবে জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে চাপ দিচ্ছেন তাঁরা। ইসরায়েলজুড়ে বিক্ষোভ চলছে। সেখানে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, জিম্মিদের মুক্তিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন না নেতানিয়াহু। নিজের রাজনৈতিক জীবন টিকিয়ে রাখা নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন তিনি। বিক্ষোভ থেকে নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবিও উঠেছে।

এদিকে নেতানিয়াহুর সরকারি জোটের মধ্যেও বিভেদ বাড়ছে। এই জোটের ডানপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদীরা হামাসকে কোনো ছাড় দেওয়ার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে। গাজায় হামলা অব্যাহত রাখার বিষয়েও জোর দিচ্ছেন তাঁরা।

ইসরায়েলজুড়ে বিক্ষোভ চলছে। সেখানে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, জিম্মিদের মুক্তিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন না নেতানিয়াহু। নিজের রাজনৈতিক জীবন টিকিয়ে রাখা নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন তিনি।

নেতানিয়াহুকে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালের স্মোটরিচ বলেছেন, জিম্মিদের মুক্ত করার একমাত্র উপায় হলো হামাসের ওপর চাপ বাড়ানো। আর দেশটির জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন গভির তো সরাসরি হুমকি দিয়ে বলেছেন, গাজার দক্ষিণে রাফা এলাকায় স্থল অভিযান শুরু না করা হলে নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে ছাড়বেন তিনি।

যদিও ইসরায়েলের বাইরে সবাই রাফায় স্থল অভিযানের বিরুদ্ধে। গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার মুখে এলাকাটিতে আশ্রয় নিয়েছেন উপত্যকাটির প্রায় ১৫ লাখ বাসিন্দা। অস্থায়ী তাঁবুতে গাদাগাদি করে দুর্বিষহ এক অবস্থায় সেখানে বসবাস করতে হচ্ছে তাঁদের।

নিজ দেশের অভ্যন্তরে সমালোচনা সামাল দিতেই হয়তো গত সোমবার নেতানিয়াহু বলেছেন, রাফায় স্থল অভিযানের দিন ঠিক হয়ে আছে। যদিও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি।

গেরশন বাসকিন বলেন, ইসরায়েলে সরকার, এমনকি নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টির ভেতরে এখন বিদ্রোহ চলছে। তারা চায় না, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নেতানিয়াহু কোনো চুক্তি করুক। নেতানিয়াহু নিজের সরকারের মধ্যেই জিম্মি হয়ে পড়েছেন।

এদিকে নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু জানায়নি হামাস। তবে বলেছে, তারা এমন একটি চুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী যার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন থামবে। এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, চুক্তি নিয়ে ইসরায়েলের অবস্থান অযৌক্তিক। গোষ্ঠীটির এই প্রতিক্রিয়া ‘আশাব্যাঞ্জক নয়’ বলে মন্তব্য করেছে হোয়াইট হাউস।

আরও পড়ুন

যুদ্ধবিরতির বিষয়ে হামাসের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নেবেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ধারণা করা হয়, হামাসের এই নেতা গাজার মাটির নিচে সুড়ঙ্গের ভেতরে লুকিয়ে আছেন। নিজের সুরক্ষার জন্য আশপাশে রেখেছেন নিরাপত্তারক্ষী ও জিম্মিদের। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করাটাও কঠিন।

হামাস এটাও বিশ্বাস করে যে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির নিশ্চয়তা ছাড়া যদি কোনো যুদ্ধবিরতি হয়, তাহলে জিম্মিদের মুক্তির পর আবার গাজায় হামলা শুরু করবে ইসরায়েল। হামাসের নেতারা এটাও দেখেছেন আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার মুখে রয়েছে ইসরায়েল। তাই তাঁরা মনে করেন, যুদ্ধবিরতির জন্য নিজেদের আরও দাবি ইসরায়েলের কাছ থেকে ছাড় করিয়ে নিতে সময়টা এখন তাঁদের পক্ষে।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এদিকে যুদ্ধবিরতির চুক্তি যতই পেছাচ্ছে, গাজায় ততই হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের হামাসের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। সেদিন থেকেই গাজায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত ৩৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার বড় একটি অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। উপত্যকাটির বাসিন্দারা দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছেন।

গেরশন বাসকিন বলেন, ‘এসব বিষয় নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মূল জটিলতাটা হলো দুই পক্ষের প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়ে প্রস্তুত আছেন কি নেই। এটা পরিষ্কার নয়, নেতানিয়াহু চুক্তির জন্য প্রস্তুত কি না। হামাসের ইয়াহিয়া সিনওয়ারও বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। তবে যখন তাঁরা চুক্তিতে যাবেন, মধ্যম কোনো অবস্থানই হয়তো খুঁজে নেবেন।’

আরও পড়ুন