আল–জাজিরাকে অস্ট্রেলীয় সিনেটর মেহরীন ফারুকি

গাজায় চরম অবিচারের সময়ে আমরা নীরব থাকতে পারি না

অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার গ্রিনস দলের ১১ সিনেটর রয়েছেন। গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরায়েলকে চাপ দিতে দলটির পক্ষ থেকে সিনেটে দাবি তোলা হয়েছে। তবে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজের নেতৃত্বাধীন মধ্যম-বামপন্থী লেবার সরকার এর বিরোধিতা করেছে। গত মাসে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভোটাভুটির সময় অস্ট্রেলিয়া ভোটদানে বিরত ছিল।
গাজায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে পার্লামেন্টে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মেহরীন ফারুকি। তিনি সিনেটে অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনস দলের উপনেতা। গতকাল বুধবার আল জাজিরায় মেহরীন ফারুকির একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। এতে তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে এবং এ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া সরকারের নীতির সমালোচনা করেন। আল–জাজিরায় প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকার প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন:

আল–জাজিরা: অস্ট্রেলিয়ার সিনেটে অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনস দলের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছে। এ–সংক্রান্ত ভোটাভুটি আয়োজনে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে?

মেহরীন ফারুকি: যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে গ্রিনস পার্টি সিনেটে ভোটাভুটির প্রস্তাব দিয়েছে। তবে লেবার সরকার ও বিরোধী দল লিবারেল ন্যাশনাল এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে এক জোট হয়েছে। এতে বোঝা যায়, গাজায় নৃশংস কর্মকাণ্ডকে তারা কতটা চরমভাবে উপেক্ষা করছে।

নৈতিকভাবে দেউলিয়া বলে প্রতিপন্ন এসব বড় দল আমাদের চুপ করিয়ে রাখতে চাইছে, যেন তাদের ভীরুতা প্রকাশ না পায়। তবে অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনস দল ও আমি মুখ বন্ধ রাখব না। ফিলিস্তিনিদের ন্যায়বিচার–সংক্রান্ত গুরুতর প্রশ্নগুলো নিয়ে সরকারের অবস্থান যদি হতাশাব্যঞ্জক হয়, তবে আমরা চুপচাপ পার্লামেন্টে বসে থাকতে পারব না।

প্রশ্ন:

আল–জাজিরা: আপনি ও আপনার গ্রিনস দলের সদস্যরা অস্ট্রেলিয়ার সিনেটে বিক্ষোভ করেছেন, প্রশ্ন পর্বটি তাঁরা বর্জন করেছেন। কী কারণে আপনারা এমন পদক্ষেপ নিলেন?

মেহরীন ফারুকি: যুদ্ধবিরতির দাবি নিয়ে আমি গর্বের সঙ্গে সিনেটে গ্রিনস দলের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছি এবং দিচ্ছি। প্রশ্ন পর্বের সময় অধিবেশন বর্জন করেছি। আমি জানি, আমাদের কণ্ঠে এখানকার অনেকের কথাই উচ্চারিত হচ্ছে।

পার্লামেন্টে আমার যে অবস্থান আছে, সে জায়গাকে কাজে লাগিয়ে গাজায় যুদ্ধবিরতি, ফিলিস্তিনের দখলদারির অবসান এবং ফিলিস্তিনিদের জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে যাব।
গাজায় এত চরম অবিচারের সময়ে আমরা নীরব থাকলে পার্লামেন্টে আমাদের থাকার কোনো মানেই হয় না। আমাদের এ ব্যাপারে আরও সোচ্চার হতে হবে।

প্রশ্ন:

আল–জাজিরা: আপনি কি মনে করেন, মানবিক যুদ্ধবিরতির (গাজা) জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকারের অবস্থান অস্ট্রেলীয় জনগণের মতকেই প্রতিফলিত করছে?

মেহরীন ফারুকি: বেশির ভাগ মানুষ যেখানে যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সেখানে তাঁদের মত উপেক্ষা করে অস্ট্রেলিয়া সরকার যে অবস্থান নিয়েছে, তা অত্যন্ত অমর্যাদাকর ও লজ্জাজনক।

মানবিক যুদ্ধবিরতির জন্য আহ্বান জানানোটা একেবারেই ন্যূনতম বিষয়। তারা সেটাও করতে পারছে না। গাজায় হামলা শুরুর পর থেকে প্রতি সপ্তাহান্তে অস্ট্রেলিয়ায় হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করছে।

তারা গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছে এবং অস্ট্রেলিয়া সরকার যেন ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দেয় সে দাবি জানাচ্ছে।

হাজার হাজার ফিলিস্তিনি এবং তাদের মিত্রদের কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষার মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলিয়া সরকার সেসব মানুষকে অমর্যাদা করল, যারা তাদের নির্বাচিত করেছিল। যারা তাদের বিশ্বাস করেছিল।

জনগণ এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা ভুলবে না। সরকারের কর্মকাণ্ডের এ ইতিহাসকে ভালোভাবে দেখা হবে না।

প্রশ্ন:

আল–জাজিরা: ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংঘাতে অস্ট্রেলীয় সরকার কতটা জড়িত। এ ধরনের সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলীয় সরকারের সদস্যদের কী দায়ী করা হতে পারে?

মেহরীন ফারুকি: বিশ্বে সবচেয়ে গোপন অস্ত্র বাণিজ্যের জায়গাগুলোর একটি অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত।

আমরা জানি, গত কয়েক বছরে আমরা ইসরায়েলকে কয়েক শ সামরিক চালান পাঠিয়েছি।

আমি যতটুকু জানি, ১১ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যার মতো ঘটনায় আমাদের দেশের হাত আছে।

ইসরায়েলে যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে এবং ফিলিস্তিনিদের গোষ্ঠীগতভাবে শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে ইসরায়েলে সামরিক রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, গাজায় অভিযান এবং ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে দখলদারি প্রশ্নে যে গুটিকতেক পশ্চিমা দেশ ইসরায়েলকে জবাবদিহি থেকে দূরে রেখেছে, তাদেরই একটি অস্ট্রেলিয়া।

অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর সরকারের সমর্থন পাওয়া যাবে—এমনটা জানার পর ইসরায়েল যদি দানবীয় আচরণ করে থাকে, তবে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।

প্রশ্ন:

আল–জাজিরা: অস্ট্রেলিয়ার সিনেটে গ্রিনস দলের ১১টি আসন আছে। এ সংঘাতে অস্ট্রেলিয়ার সম্পৃক্ততার ব্যাপারে গ্রিনস দল কী পদক্ষেপ নিতে পারে?

মেহরীন ফারুকি: ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা সংখ্যাগরিষ্ঠ অস্ট্রেলীয় জনগণের কণ্ঠস্বরকে পার্লামেন্টে তুলে ধরছে গ্রিনস দল। অনেক দিক থেকেই এটি শক্তিশালী। এর মধ্য দিয়ে জনগণ উপলব্ধি করতে পারছে, দেশের উচ্চতর কার্যালয়ে এমন কেউ আছে, যারা তাদের কথা শুনতে পায়। যারা নীতিগত অবস্থান নেওয়ার সাহস পায়। এতে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারির অবসান ও যুদ্ধবিরতির দাবিতে সরকারের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে।

ইসরায়েলে জবাবদিহি ব্যবস্থার সংকট নিয়ে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের মতো আমিও ভীত। গাজায় যখন হাজার হাজার শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে, তখন যুদ্ধবিরতির দাবি না জানানোটা নির্মম ও লজ্জাজনক বিষয়। আমাদের সরকার অবৈধ কাজের সহযোগী হতে পারে, কিন্তু আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে।

আমি অস্ট্রেলিয়া জুড়ে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিক্ষোভ করছি, এসব বিক্ষোভে কথা বলছি।

এসব মানুষের বিক্ষোভকে পার্লামেন্টে নিয়ে আসার সময় হয়েছে, যেন সরকার কোনো না কোনোভাবে তাদের আহ্বানে সাড়া দিতে বাধ্য হয়।