ফিলিস্তিনের নতুন প্রধানমন্ত্রী কে এই মুস্তাফা, কী করতে চান তিনি

ফিলিস্তিনের নতুন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মুস্তাফা (ডানে)। তাঁর পাশে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসছবি: এএফপি

মোহাম্মদ মুস্তাফা গতকাল বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি একজন নেতৃস্থানীয় ফিলিস্তিনি ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব। তিনি হামাস-শাসিত গাজা পুনর্গঠনে তদারক করছেন।

পিএর প্রধান মাহমুদ আব্বাসের একজন চমৎকার মিত্র মুস্তাফা। যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখা করা অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা একসময় ফিলিস্তিনি টেলিকম কোম্পানি প্যাল্টেল পরিচালনা করতেন। সবশেষ তিনি পিএর ফিলিস্তিন বিনিয়োগ তহবিল (পিআইএফ) পরিচালনা করে আসছিলেন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি সম্পদ তহবিল রয়েছে পিআইএফের।

এক দশক আগে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। ওই যুদ্ধের পর গাজায় পুনর্গঠনের উদ্যোগে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজে সহায়তা দিতে মুস্তাফাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে গাজায় তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গাজা পুনর্নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন মুস্তাফা। ফিলিস্তিনি নেতারা আশা করছেন, তিনি এখন ফিলিস্তিনিদের কাছে একজন ঐক্যের মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হবেন।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পিএ ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীরে সীমিত পরিসরে স্ব-শাসন পরিচালনা করছে। তারা ২০০৭ সালের নির্বাচনে হামাসের কাছে গাজার নিয়ন্ত্রণ হারায়। চলমান গাজা যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের শাসনব্যবস্থাকে আবার এক করা লক্ষ্য পিএর।

আব্বাসের ফাতাহর উপদলের একজন সদস্য মোহাম্মদ এশতায়েহ। তিনি ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। একটি ঐক্যের মন্ত্রিসভা গড়ার পথ প্রশস্ত করতে তিনি ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে পদত্যাগ করেন। তাঁর সরকারও পদত্যাগ করে।

ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য আবারও ফাতাহ ও হামাসের নেতারা শিগগিরই রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় বৈঠক করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

মাহমুদ আব্বাসের ঘনিষ্ঠ হলেও মুস্তাফা কিন্তু ফাতাহর সদস্য নন। সম্ভবত এ কারণেই তাঁকে নিয়ে বিতর্কও কম।

মুস্তাফার কাঁধে এখন ব্যবস্থাপনা ও কূটনীতির বড় একটি দায়িত্ব এসে পড়েছে। ইসরায়েলি হামলায় গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার অধিকাংশই বাস্তুচ্যুত। তাঁদের সাহায্য প্রয়োজন। পশ্চিম তীরেও কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা দেখা গেছে।

গাজা পুনর্গঠনে শত শত কোটি ডলার আন্তর্জাতিক সাহায্য আশা করা হচ্ছে। এই সহায়তার তত্ত্বাবধানসহ হামাস ও তার সমর্থকদের কাছ থেকে মুস্তাফাকে স্বীকৃতি অর্জন করতে হবে। পাশাপাশি ইসরায়েলের সহযোগিতাও দরকার হবে তাঁর, যারা হামাসকে নির্মূল করতে চাইছে।

যুদ্ধ–পরবর্তী গাজা শাসনে পিএর একটি অগ্রণী ভূমিকা আশা করছে যুক্তরাষ্ট্র। পিএ পরিচালনায় ব্যাপক সংস্কার আনার আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুস্তাফার নিয়োগ পাওয়ার আগে ফিলিস্তিনি অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ আবু জায়েব বলেন, সবাই সংকটের মধ্যে আছে। ফাতাহ পশ্চিম তীরে সংকটে আছে। হামাস স্পষ্টতই গাজায় সংকটে আছে। ৬৯ বছর বয়সী মুস্তাফা উভয়ের জন্য সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ বের করতে পারেন।

বড় সমস্যার উপসর্গ ৭ অক্টোবর

আব্বাস ২০১৫ সালে মুস্তাফাকে পিআইএফের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। তিনি ২০১৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল অর্থনীতিসংক্রান্ত বিষয়াবলি। এই সময় সাত সপ্তাহের যুদ্ধের পর গাজা পুনর্গঠনের জন্য গঠিত একটি কমিটির নেতৃত্ব দেন তিনি। এই যুদ্ধে ২ হাজার ১০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন।

গত ১৭ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে মুস্তাফা বলেছিলেন, চলমান গাজা যুদ্ধের বিপর্যয় ও মানবিক প্রভাব এক দশক আগের যুদ্ধের তুলনায় অনেক বেশি।

গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, ইসরায়েলি হামলায় ৩১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হাজারো মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইসরায়েল বলেছে, তারা এমন কোনো ফিলিস্তিনি সরকারকে কখনোই সহযোগিতা করবে না, যারা হামাস ও তার ৭ অক্টোবরের হামলাকে প্রত্যাখ্যান করতে অস্বীকৃতি জানাবে।

আরও পড়ুন

ইসরায়েল সরকারের তথ্যমতে, ৭ অক্টোবরের হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয়েছেন। সেদিন হামাস ২৫৩ জন ইসরায়েলিকে বন্দী করে নিয়ে যায়।

দাভোসে মুস্তাফা তাঁর মন্তব্যে ৭ অক্টোবরের হামলাকে সবার জন্য দুর্ভাগ্যজনক বলে বর্ণনা করেছিলেন।

মুস্তাফা আরও বলেছিলেন, কিন্তু এটি একটি বড় সমস্যার উপসর্গও...আর তা হলো ফিলিস্তিনি জনগণ ৭৫ বছর ধরে বিরামহীনভাবে ভোগান্তির শিকার হয়ে আসছেন।

মুস্তাফা বলেছিলেন, ‘আজ অবধি, আমরা এখনো বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি রাষ্ট্রই এগিয়ে যাওয়ার পথ। তাই আমরা আশা করি, এবার তা অর্জন করতে সক্ষম হব, যাতে এই অঞ্চলের সব মানুষ নিরাপত্তা ও শান্তিতে বসবাস করতে পারে।’

আব্বাসের নেতৃত্বাধীন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) কার্যনির্বাহী কমিটির একজন সদস্য মুস্তাফা। ১৯৯৩ সালে শান্তিপ্রক্রিয়ার শুরুতে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল পিএলও। কারণ, তারা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের দখল করা অঞ্চলে (পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম) একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশা করেছিল।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা আগে বলেছেন, তাঁরা আব্বাসকে যুদ্ধোত্তর গাজা শাসনে সহায়তার জন্য পিএতে টেকনোক্র্যাট, অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞসহ নতুন মুখ আনাতে আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যানের জন্য চাপ দিতে চান না।

আরও পড়ুন

ভবিষ্যতের পথ

মুস্তাফা বলেছেন, ভালো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং পিএ যাতে আরও উন্নত শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, সে জন্য তাঁরা গাজা ও পশ্চিম তীরকে আবার এক করতে পারেন।

মুস্তাফা বলেন, কিন্তু যদি তাঁরা দখলদারির অবসান ঘটাতে না পারেন, তাহলে কোনো সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠানই আসলে একটি ভালো, সফল শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে না। কিংবা একটি সঠিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পারবে না।

মুস্তাফা যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবসায় প্রশাসন ও অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন। পরে তিনি ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকে কাজ করেছেন। তিনি পশ্চিম তীরের তুলকার্ম শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

মুস্তাফা তাঁর ১৭ জানুয়ারির মন্তব্যে বলেছিলেন, গাজায় শুধু ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণের জন্যই ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দরকার হবে।

মুস্তাফা বলেছিলেন, তিনি স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে মানবিক প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্ব দেবেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, গাজার সীমান্ত খুলে দেওয়া হবে। একটি পুনর্গঠন সম্মেলন আহ্বান করা হবে।

হামাসের জন্য কী ভবিষ্যৎ–ভূমিকা দেখছেন, এমন প্রশ্নে মুস্তাফা বলেন, ভবিষ্যতের সর্বোত্তম উপায় হলো যতটা সম্ভব অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া। তিনি চান, ফিলিস্তিনিরা পিএলওর অ্যাজেন্ডাকে কেন্দ্র করে এক হোক।

আরও পড়ুন