ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এখন কেন

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাত বহুদিনের। মধ্যে কয়েক বছর বড় ধরনের কোনো সংঘর্ষ হয়নি। অনেকটা চুপচাপই ছিল দুই পক্ষ। তবে গত সপ্তাহ থেকে হঠাৎ উত্তেজনা চরমে ওঠে।

চলছে ইসরায়েলি বিমান হামলা। চলছে রকেট হামলা। প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আহত হচ্ছে নারী, শিশু। হঠাৎ এই উত্তেজনা চরমে ওঠার কারণ খুঁজেছেন নিউইয়র্ক টাইমসের আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রতিনিধি প্যাট্রিক কিংসলে।

আল–আকসা মসজিদ চত্বরে সংবাদ সংগ্রহের সময় এক গণমাধ্যমকর্মীকে ধাওয়া করে ইসরায়েলি পুলিশ
ছবি: রয়টার্স

মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘর্ষের কারণ খুঁজতে যেতে হবে প্রায় এক মাস পেছনে। পবিত্র রমজান মাসের প্রথম রাত ১৩ এপ্রিল জেরুজালেমের আল–আকসা মসজিদে ঢুকে পড়েছিল ইসরায়েলি পুলিশের একটি দল। তারা কেটে দিয়েছিল মসজিদের লাউড স্পিকারের তারগুলো।

আবার ওই দিন ছিল ইসরায়েলের মেমোরিয়াল ডে। মসজিদের কাছাকাছি ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টের বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের আশঙ্কা ছিল, আজানের কারণে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে বিঘ্ন ঘটতে পারে। তাই তার কেটে দেয় তারা। ঘটনাটি নিশ্চিত করেছেন মসজিদের ছয়জন কর্মী। তাঁদের মধ্যে তিনজন সে সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন। তবে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ইসরায়েলি পুলিশ।

জেরুজালেমের গ্র্যান্ড মুফতি শেখ একরিমা সাবরির মতে, এক সপ্তাহ ধরে ইসরায়েল আর ফিলিস্তিনের মধ্যে যে সংঘর্ষ চলছে, তার শুরুটা এই ঘটনা থেকেই। আগুনে ঘি ঢেলেছিল আল–আকসা মসজিদে পুলিশের এই অভিযান। তিনি বলেন, ‘মসজিদে ইসরায়েলি পুলিশের ওই অভিযানের কারণেই পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়ে যায়।’

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে এক সপ্তাহ ধরে চলা সংঘর্ষে ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের হিসাব অনুযায়ী, সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ১৪৮ জন নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪১টি শিশুও রয়েছে। ইসরায়েল একের পর এক বিমান হামলা চালাচ্ছে। হামাসও রকেট ছুড়ছে। শনিবার ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় ১২ তলা একটি ভবন গুঁড়িয়ে দেয়। ওই ভবনে বার্তা সংস্থা এপি ও কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার কার্যালয় ছিল। একই দিনে গাজার পশ্চিমাঞ্চলে শরণার্থীশিবিরেও হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে এক পরিবারের ১০ সদস্য নিহত হয়। গুরুতর আহত হয় পাঁচ মাসের এক শিশু। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে এমন ঘটনা।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরায়েলি সরকার আধিপত্য বজায় রাখতে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আর ইসরায়েলের চোখে সন্ত্রাসী দল হামাস ফিলিস্তিনি আন্দোলনে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাইছে।

ওয়ার্ল্ড জায়োনিস্ট অর্গানাইজেশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইসরায়েলি পার্লামেন্টের সাবেক স্পিকার আব্রাহাম বার্গ বলেন, গাজায় বছরের পর বছর ধরে চলা অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা, পশ্চিম তীর দখল করে রাখা ও আরবদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের পরিণতিতেই এমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। আব্রাহাম বার্গ সংঘর্ষের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তুলনা দিয়ে বলেন, ‘সব ইউরেনিয়াম রাখা ছিল। শুধু ট্রিগার চাপার অপেক্ষা ছিল। আর সেই ট্রিগার ছিল আল–আকসা মসজিদ।’

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার পরও বড় কোনো সংঘর্ষ হয়নি। বড় চারটি আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পরও কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। দুই মাস আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী কয়েকটি ঘাঁটি স্থাপনের পর সংঘর্ষ হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। তখনো তেমনটি ঘটেনি।

দামেস্ক গেটে ফিলিস্তিনিদের দেহ তল্লাশি ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী
ছবি: এএফপি

ইসরায়েলের সামরিক কর্মকর্তারা গোপন এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন, ইসরায়েলের বড় হুমকি হলো ইরান ও লেবানন। গত মার্চে কূটনীতিকেরা সেনাবাহিনীর দুজন জেনারেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্যেষ্ঠ এক কূটনীতিক সে সময় জানিয়েছিলেন, ওই দুই জেনারেলের মধ্যে সংঘর্ষ নিয়ে কোনো আশঙ্কা ছিল না।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল গাজা। হামাসসহ ফিলিস্তিনের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মার্চে নির্বাচনের অপেক্ষায় ছিল। এ ছাড়া গাজায় ইসরায়েলি অবরোধের কারণে বেকারত্বের হার পৌঁছায় ৫০ শতাংশে। ফিলিস্তিনিরা যুদ্ধের চেয়ে আর্থিক সংকটকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন। তাই হামাসের জনপ্রিয়তাও কমছিল।

মোড় ঘুরে এপ্রিলে

এপ্রিলে এসে পরিস্থিতি বদলে যায়। আল–আকসা মসজিদের জনকল্যাণ কর্মকর্তা বলেন, ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট রুয়েভেন রিভলিনের আল–আকসা মসজিদের কাছে পবিত্র রমজানের প্রথম রাতে বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। তাঁর বক্তব্যের সময় মসজিদের মাইকে আজান ও দোয়া বন্ধ রাখার অনুরোধ জানায় ইসরায়েল। তবে মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হয়নি।

এরপরই বাধে বিপত্তি। পুলিশ মসজিদে অভিযান চালায় ও লাউডস্পিকারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। শেখ সাবরি বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই, পবিত্র রমজান মাসে আল–আকসা মসজিদের পবিত্রতা ইসরায়েলি পুলিশ নষ্ট করতে চেয়েছে।’ প্রেসিডেন্টের একজন মুখপাত্র প্রথমে লাউডস্পিকারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা অস্বীকার করেন। তবে পরে তাঁরা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখবেন বলে জানান।

আগুনে ঘি ঢেলেছিল যেসব ঘটনা

হয়তো ঘটনা এখানেই থেমে যেত। তবে গত মাসে বেশ কয়েকটি অপ্রত্যাশিত ঘটনায় পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়।

কেবল আল–আকসা মসজিদে পুলিশের অভিযানের কারণেই নয়, তরুণ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে জাতীয় পরিচয় নিয়ে একধরনের বোধ জাগরিত হয়েছিল। ছয় ফিলিস্তিনি পরিবারকে বাড়ি থেকে উৎখাত করার পর তরুণ ফিলিস্তিনিরা বিক্ষোভ করেন। ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে হঠাৎ শূন্যতা ও তৃণমূল পর্যায়ে বিক্ষোভের কারণে হামাস তাদের শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ পেয়েছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেটের সাবেক পরিচালক অ্যামি আয়ালন বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। সবকিছু স্থিতিশীল আছে, এমন ধারণা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে।’

জেরুজালেমের অন্যতম প্রবেশদ্বার দামেস্ক গেটের কাছে পপুলার প্লাজা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পুলিশ। পবিত্র রমজান মাসের রাতে তরুণ ফিলিস্তিনিরা সেখানে সমবেত হন। এরপরই আল–আকসা মসজিদের লাউডস্পিকারগুলো বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশের মুখপাত্র মিকি রোজেনফিল্ড বলেন, সহিংসতার আশঙ্কায় ওই প্লাজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফিলিস্তিনিদের কাছে এটি ছিল অসম্মানজনক। প্লাজা বন্ধ করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাতে ইসরায়েলি পুলিশ ও ফিলিস্তিনি তরুণদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। তবে বেশির ভাগ ফিলিস্তিনির কাছে ঘটনাটি ছিল অবমাননাকর। এ ঘটনায় তাদের মনে ক্ষোভ জন্মায়।
পূর্ব জেরুজালেমে বেশির ভাগ ফিলিস্তিনি বাসিন্দা নিজেদের পছন্দে ইসরায়েলের নাগরিক নন। ১৯৬৭ সাল থেকেই জেরুজালেম দখল করে রেখেছে ইসরায়েল।

ফিলিস্তিনি অধিবাসীদের অনেকেই বলছেন, তাঁরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন। তবে তা মেলেনি। তাঁরা ভোটও দিতে পারেন না। অনেকেই আশঙ্কা করেন, তাঁদের জোর করে জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা চলছে। বাড়ি নির্মাণে তাঁদের ওপর বিধিনিষেধ রয়েছে। এসব বিধিনিষেধের কারণে তাঁরা শহর ছাড়তে অথবা অবৈধভাবে বসবাস করতে বাধ্য হন। ফিলিস্তিনিরা এ কারণে সব সময়ই বৈষম্যের শিকার হয়।

পূর্ব জেরুজালেমের বাসিন্দা ২৭ বছর বয়সী মাজেদ আল–কাইমারি বলেন, ‘বাড়িঘর নির্মাণে এমন বিধিনিষেধ থাকায় মনে হয় তারা আমাদের শহর থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়।’

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ছবি: রয়টার্স

দামেস্ক গেটে সংঘর্ষের ঘটনায় এসব ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সংঘর্ষের ওই ঘটনার পরের সপ্তাহে ফিলিস্তিনি তরুণেরা ইসরায়েলিদের ওপর হামলা শুরু করেন। অনেকে এসব হামলা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকে ভিডিও পোস্ট করেন।

আল–আকসা মসজিদে পুলিশের অভিযানের এক সপ্তাহ পর ২১ এপ্রিল ইহুদিদের উগ্রবাদী দল লেহাভার কয়েক শ সদস্য জেরুজালেমে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তাঁরা রাস্তায় হেঁটে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালান। ফিলিস্তিনিদের ঘরে ইসরায়েলের একটি দলের হামলার ছবিও দেখা যায়। ফিলিস্তিনি গাড়িচালকদের ওপরও অনেকে হামলা চালায়।

সংঘাত নিরসনে উদ্যোগের অভাব

কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জেরুজালেমে ইসরায়েলি সরকারের প্রতি শিথিলতা প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। দামেস্ক গেটের বাইরে স্কয়ার খুলে দিতেও তারা আহ্বান জানায়। তবে ইসরায়েলি সরকার এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ইসরায়েলে গত মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কাউকে সুস্পষ্টভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়নি। রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য নেতানিয়াহুর সঙ্গে উগ্রবাদী ডানপন্থী আইনপ্রণেতাদের আলোচনার প্রয়োজন ছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নেতানিয়াহুর বায়োগ্রাফার আনশেল ফেফার বলেন, ইহুদি ও আরবদের মধ্যে উত্তেজনা নেতানিয়াহুর তৈরি নয়। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই এই উত্তেজনা ছিল। তবে নেতানিয়াহু তাঁর দীর্ঘ শাসনামলে এই উত্তেজনাকে জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করেছেন। এখন উত্তেজনা যখন চরমে, তখন একজন নেতা হিসেবে তা নিরসনে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।

তবে নেতানিয়াহুর জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা মার্ক রেজেভ আনশেলের বক্তব্যকে সমর্থন করেন না। তিনি বলেন, আসল সত্য এর বিপরীত। নেতানিয়াহু উত্তেজনা নিরসনে সবকিছু করেছেন।

**নিউইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন শুভা জিনিয়া চৌধুরী