ইসরায়েলের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ১২ বছর পর ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, এবার কি ফিলিস্তিন মুক্ত হবে? কিন্তু এই প্রশ্নের এক কথায় উত্তর হলো, ব্যাপারটা ততটা সরল নয়। নেতানিয়াহু ক্ষমতা থেকে সরে গেলেন মানেই যে রাতারাতি ফিলিস্তিন প্রশ্নের সমাধান হয়ে যাবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বিষয়টি যে সহজ কিছু নয়, তা ইসরায়েলের নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই পরিষ্কার হয়ে গেছে। গাজা থেকে ওড়ানো গ্যাস বেলুনে সীমান্ত এলাকায় আগুন ধরে যাওয়ায় গত বুধবার সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এ ছাড়া এদিনই পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে এক ফিলিস্তিনি নারী নিহত হয়েছেন।
কোনো সন্দেহ নেই, নেতানিয়াহুর গত ১২ বছরের শাসনামলে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন ক্রমেই ফিকে হয়ে এসেছে। বস্তুত, তথাকথিত ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ এখন অধিকাংশ ইসরায়েলি নেতা মুখেও আনছেন না। তাঁদের কাছে বিষয়টি ‘সহনীয়’, ইসরায়েলি দৈনিক হারিৎস-এর ভাষায় ‘ম্যানেজেবল’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখানে-সেখানে মাঝেমধ্যে দখলদারির বিরুদ্ধে নিন্দা ধ্বনি উঠলেও গাজার ফিলিস্তিনিরা সুযোগ পেলে বাজি-পটকা ফোটালেও তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
দখলকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ওপর ইসরায়েলি অধিগ্রহণের ইতি টানতে প্রয়োজন নতুন শান্তিপ্রক্রিয়ার। এ জন্য দরকার মরচে পড়া ‘শান্তিপ্রক্রিয়া’ চাঙা করে তোলা। কিন্তু সে কাজের দায়িত্ব কার, সেটা এখন এক মস্ত ধাঁধার বিষয়। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) নেতা ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট হন। তবে তাতে ইসরায়েলের দখলদারি শেষ হয়নি। উল্টো পূর্ব জেরুজালেমে ও পশ্চিম তীরে একের পর এক বসতি গড়ে তুলেছে ইসরায়েল। এখন ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে অধিকাংশ ইসরায়েলি রাজনীতিক যাঁদের অন্যতম দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত, পশ্চিম তীরের প্রায় পুরোটাই ইসরায়েলের অঙ্গীভূত করে নিতে আগ্রহী। এ কাজে নেতানিয়াহু পাশে পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। দুই রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে ট্রাম্প প্রশাসন নেতানিয়াহু প্রশাসনের অধিগ্রহণ নীতির প্রতি খোলামেলা সমর্থন জানায়।
* ইসরায়েলে আটদলীয় জোট সরকারের শরিকদের মত ও পথের কোনো মিল নেই। * নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলের পুলিশ জানিয়েছে, তারা ফিলিস্তিনে দখলকৃত এলাকায় অঘোষিত হামলা চালাবে না। * ফিলিস্তিনে হামাস ও ফাতাহের সম্পর্ক দা-কুমড়ার মতো। দিনে দিনে জনপ্রিয় হচ্ছে হামাস। * ইরান ইস্যুতে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকছে। ফলে তাদের কাছে উপেক্ষিত ফিলিস্তিন।
ফিলিস্তিনিদেরও দায় কম নয়
এদিকে অব্যাহত ইসরায়েলি দখলদারির কাজটি সহজ করে দিয়েছে খোদ ফিলিস্তিনিরাই। ২০০৬ সালে দখলকৃত এলাকায় যে সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে পশ্চিম তীরের কর্তৃত্ব রয়ে যায় ইয়াসির আরাফাতের অনুসারী ফাতাহ সংগঠনের হাতে। তবে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হামাসের হাতে। এই সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে কোনো আপস আলোচনায় রাজি নয় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও একই।
পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণকারী ফাতাহর সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক অনেকটা দা-কুমড়ার মতো। সংগঠন দুটি নিয়ে কয়েকবার ফিলিস্তিনের জাতীয় সরকার গঠনের চেষ্টা হলেও তাতে কোনো অগ্রগতি আসেনি। হামাসের অভিযোগ, মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ শুধু অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজই নয়, তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে ইসরায়েলি দখলদারি প্রতিরোধ করার পরিবর্তে আপসের পথ বেছে নিয়েছে। লড়াকু অবস্থানের কারণে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হামাসের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় ভীত আব্বাস সরকার গত ১৫ বছরে নতুন নির্বাচনেরও আয়োজন করেনি। অনেকেই মনে করেন, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে আব্বাস ও ফাতাহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বেন। এই অবস্থায় সংগত প্রশ্ন, শান্তি আলোচনা হবে কার সঙ্গে?
ইরান ইস্যু এবং আরব দেশগুলোর অনাগ্রহ
ফিলিস্তিন মুক্তির পথ জটিল হওয়ার আরেকটি কারণ, আরব দেশগুলোর অনাগ্রহ। মুখে ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে অনিঃশেষ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের কথা বললেও ওই সব দেশের সরকার বেশ আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কাতারসহ দু-একটি উপসাগরীয় দেশ মাঝেমধ্যে অর্থ জুগিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করলেও রাজনৈতিকভাবে ইসরায়েল ও মার্কিন নীতির বিরোধিতা করার সাহস তাদের নেই। এসব দেশের কাছে প্রধান শত্রু ইসরায়েল নয়, ইরান। শিয়া অধ্যুষিত ইরানের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যে তারা ভীত। যদিও ওই অঞ্চলে ইরানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইসরায়েল। তারপরও আরব দেশগুলোর লক্ষ্য একটাই—ইরানকে কিছুতেই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে দেওয়া যাবে না।
একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘আমার শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’। ইরান ইস্যুতে এই কথাই আরব দেশগুলোর ক্ষেত্রে খাটে। আর তাই আরব দেশগুলো ফিলিস্তিন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সখ্য গড়তেই বেশি আগ্রহী। এ কাজে জোর মদদ দিয়েছে ট্রাম্পের প্রশাসন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার আগ মুহূর্তে তাঁর প্রশাসনের মধ্যস্থতায় চারটি আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণা দেয়। অনেক বিশেষজ্ঞেরই ধারণা, ট্রাম্প আর কিছুদিন ক্ষমতায় থাকলে কিংবা দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এলে সৌদি আরবও ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্যে গাঁটছড়া বাঁধত।
ইসরায়েলের জোট সরকারে মত–পথের ভিন্নতা
এদিকে নেতানিয়াহুর ১২ বছরের শাসনের অবসানের পর কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন, এবার হয়তো শান্তি আলোচনা গতি পাবে। কিন্তু এখনো তা না শুরু হওয়ার অন্যতম কারণ, ইসরায়েলের নতুন সরকার। যদিও এই সরকারের মেয়াদ এক সপ্তাহও হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আট দল নিয়ে যে গোঁজামিলের জোট সরকার গঠন করা হয়েছে ইসরায়েলে, তা অনেকটা তাসের ঘরের মতো। এই আট দলের মত ও পথের কোনো মিল নেই। এই জোটে কট্টর জাতীয়তাবাদীদের পাশাপাশি মধ্যপন্থীরাও রয়েছেন। যেমন নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চেয়েও ডানপন্থী। তিনি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিরোধী। অন্যদিকে সরকারের দুই নম্বর ব্যক্তি এবং এই জোটের নেতা ইয়ার লাপিদ মধ্যপন্থী। তিনি শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু করার পক্ষে। এই জোটে রা’ম (ইউনাইটেড আরব লিস্ট) নামের একটি ছোট ইসলামপন্থী আরব দলও রয়েছে। তারা স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু তারাও এই মুহূর্তে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কথা বলে ঝামেলা বাড়াতে চায় না। তাদের প্রধান লক্ষ্য, ইসরায়েলের ভেতর যে আরব নাগরিকেরা রয়েছে, তাদের স্বার্থ রক্ষা করা। সব মিলিয়ে এই জোট এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তারা সব ধরনের বিতর্কিত ইস্যু এড়িয়ে যাবে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেই এই পথ তারা বেছে নিয়েছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
তবে ইসরায়েলে ক্ষমতার পালাবদলে আশার কিছু যে নেই, তা নয়। নেতানিয়াহুর বিদায় ইসরায়েলের ভেতরে যেমন, বাইরেও তেমনই স্বস্তির কারণ হয়েছে। অনেকের আশা, নতুন সরকার ফিলিস্তিন প্রশ্নে অপেক্ষাকৃত বেশি ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করবে। তার কিছু লক্ষণও নজরে এসেছে এরই মধ্যে। ইসরায়েলের পুলিশ জানিয়েছে, তারা ফিলিস্তিনে দখলকৃত এলাকায় আরব বসতিগুলোয় অঘোষিত হামলা চালাবে না। দখলকৃত এলাকায় নতুন কোনো ইহুদি বসতির অনুমতি দেওয়া হবে না বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে তারা।
আশাবাদী হওয়ার আরও একটি কারণ হলো, গাজায় সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার পর সারা বিশ্বে ফিলিস্তিন প্রশ্নটি নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ইসরায়েলি হামলার সমালোচনা করে বক্তব্য এসেছে। এই অবস্থায় বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন চাইলেও ফিলিস্তিন প্রশ্নটি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারবে না। আজ হোক অথবা কাল, বিষয়টি নিয়ে তাঁকে এগোতেই হবে। এই কাজটা ত্বরান্বিত হবে, যদি শান্তিপ্রক্রিয়া প্রশ্নে ফিলিস্তিনিরা ও আরব দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেয়।