ফিলিস্তিনকে ছাড়াই মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বৈঠক ইসরায়েলের, সফল হবে কি

চার আরব দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে ইসরায়েল এ সম্মেলন আয়োজন করেছে।

চার আরব দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে ইসরায়েল একটি সম্মেলন আয়োজন করেছে। দ্রুত বদলাতে থাকা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতেই এ উদ্যোগ দেশটির। এ সম্মেলনে অংশ নেন চার আরব দেশের শীর্ষ নেতারা। দেশ চারটির মধ্যে তিনটি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। তারা ২০২০ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে।

দক্ষিণাঞ্চলীয় নাকাবে (নেগেভ) ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়নের সমাধির পাশে একটি অবকাশকেন্দ্রে কূটনীতিকেরা বৈঠক করেন। জ্বালানি, পরিবেশ, নিরাপত্তা ইস্যুসহ অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা বিস্তৃত করা এবং অন্যদেরও এই চুক্তিতে আনার বিষয়ে চার আরব মন্ত্রী ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন অঙ্গীকার করেন।

এ সম্মেলনে ফিলিস্তিনিদের রাখা হয়নি; যদিও গত ৫০ বছর আরব-ইসরায়েল সম্পর্কের মূল বিষয় ছিল ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অব্যাহত দখলদারত্ব।

ব্লিঙ্কেন বলেন, কয়েক বছর আগেও এ ধরনের সম্মেলন কল্পনা করাও কঠিন ছিল। এ অঞ্চল এবং এর বাইরের অঞ্চলকেও বদলে দেবে—এমন একটি প্রক্রিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছে এবং ভবিষ্যতেও সমর্থন করে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় আব্রাহম অ্যাকর্ডের অধীন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় আলাদা চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করে মরক্কো।

মরক্কোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাসের বাউরিতা বলেন, ‘আমরা প্রকৃতই আন্তরিক ও দৃঢ়ভাবে শান্তিতে বিশ্বাস করি বলেই আজ এখানে উপস্থিত হয়েছি। এটা সে ধরনের পরোক্ষ শান্তির বিষয় নয়, যেখানে আমরা পরস্পর থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখি এবং শান্তিপূর্ণভাবে একে অপরকে এড়িয়ে যাই। আমরা এ অঞ্চলে পরিপূর্ণ, ফলপ্রসূ, পরিবর্তন আনয়নকারী ও মূল্যবোধ সৃষ্টিকারী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করি।’

জর্ডানই একমাত্র আরব দেশ, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকার পরও এ সম্মেলনে অংশ নেয়নি। এ সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতে ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীর সফর করেন দেশটির বাদশাহ আবদুল্লাহ।

ইরানবিরোধী জোট

এমন সময় এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো, যখন ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি পুনর্জীবিত করতে কাজ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করার বিনিময়ে শত শত বিলিয়ন ডলার থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এ চুক্তিতে। সম্মেলনে অংশ নেওয়া সব মন্ত্রীই এ অঞ্চলে ইরানের আচরণ এবং দেশটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক চুক্তির সম্ভাব্য নবায়নের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ার লাপিড বলেন, এ জোট ‘ইতিহাস সৃষ্টি করছে’। প্রতিবছর এ সম্মেলন আয়োজন করা হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি। ইয়ার লাপিড আরও বলেন, ‘নতুন আঞ্চলিক কাঠামো তৈরি আমাদের একমাত্র অভিন্ন শত্রু ইরানকে ভয়ের মধ্যে রাখবে এবং প্রতিরোধ করবে। নিশ্চিতভাবে তারা ভয় পাবে।’

চার আরব দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে ইসরায়েল এ সম্মেলন আয়োজন করেছে।

আল-জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা বলেন, বাগাড়ম্বরিতা ও বাস্তবতা—এমন দুই জগতের প্রতিফলন এ সম্মেলন। আর বাস্তবতা হলো মানুষ দখলদারত্বের মধ্যে বাস করছে। চার আরব মন্ত্রী অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে যাওয়ার সাহসটুকুও দেখাননি, কিছুটা হয়তো লজ্জা থেকে, কিছুটা অপরাধবোধ থেকে। কারণ, তাঁরা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছেন।’

মারওয়ান বিশারা আরও বলেন, এ বৈঠকের মানে ইরানের বিরুদ্ধে নতুন জোট গঠন করতে চায় ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও চার আরব দেশ। নেপথ্যে তারা যে বিষয় সৃষ্টি করছে, সেটা হলো নতুন স্নায়ুযুদ্ধ।

সম্মেলনে নেই ফিলিস্তিন

এ সম্মেলনে লক্ষণীয় বিষয় ছিল ফিলিস্তিনিদের অনুপস্থিতি। উত্তেজনা কমাতে পদক্ষেপ গ্রহণ ও চূড়ান্ত পর্যায়ে শান্তি আলোচনা পুনর্জীবিত করতে পরিবেশ সৃষ্টিতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট একটি জোড়াতালি দেওয়া জোট সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যাদের মধ্যে সামান্যই মতাদর্শিক মিল আছে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন বলে জানান তিনি। শান্তি আলোচনা পুনরায় চালুর কোনো ইচ্ছা নেই বলেও জানান ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। এর পরিবর্তে উত্তেজনা হ্রাস এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থা ধরে রাখতে ফিলিস্তিনিদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান নাফতালি বেনেট।

আল-জাজিরার বিশেষজ্ঞ নিদা ইব্রাহিম বলেন, এসব আলাপ ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘বিলাসিতার মতোই ঠেকবে’, যত দিন তারা দখলদারত্বের মধ্যে বসবাস করবে।

উত্তেজনা কমানো এবং জীবনমান উন্নয়নের যে আলাপ এখন হচ্ছে, আলোচনার টেবিলে সে আলাপ এখন চায় না ফিলিস্তিনিরা। তার চেয়ে বরং তারা এমন একটি শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে চায়, যাতে দখলদারত্বের অবসান হবে এবং ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র অর্জনের পথ উন্মুক্ত হবে।

অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লা থেকে নিদা ইব্রাহিম আরও বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করা, বৈঠকে বসা এবং দেশটিতে সম্মেলনে যোগ দিতে দেখে খুবই হতাশ ফিলিস্তিনিরা। তিনি বলেন, যখন আরব জনগণ ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে, তখন আরব সরকারগুলো তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে—এমন উপলব্ধি তাদের।

জর্ডান সরকার এ সম্মেলনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এর পরিবর্তে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীর সফর করেছেন।