বিস্ফোরণের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন বৈরুতবাসী

লেবাননের বৈরুতে গত বছরের ৪ আগস্টের ভয়াবহ বিস্ফোরণে ২০০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় অসংখ্য অবকাঠামো। সেগুলোর সংস্কার হয়নি এখনো। সেই বিস্ফোরণের ক্ষত নিয়েই বছর কেটে গেল ক্ষতিগ্রস্তদের

বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত শস্যভান্ডার। এর সংস্কার এখনো সম্ভব হয়নি। বৈরুত, লেবানন।
ছবি: রয়টার্স

‘আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না, আমাকে এভাবে বেঁচে থাকতে হবে। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না...।’ লেবাননের বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজন এভাবেই স্মরণ করেন সেই বিস্ফোরণের বিভীষিকাময় মুহূর্তের কথা। গত বছরের ৪ আগস্ট ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণের দুর্বিষহ স্মৃতি নিয়ে এক বছর কেটে গেল প্রাণে বেঁচে যাওয়া এমন অনেকের।

বৈরুতের বন্দর এলাকায় এই বিস্ফোরণের কারণ ছিল অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। প্রায় আড়াই হাজার টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত ছিল সেখানে। বিস্ফোরণের কারণে কম্পন অনুভূত হয়েছিল ২৪০ কিলোমিটার দূরে সাইপ্রাস দ্বীপেও। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জানিয়েছিল, এই বিস্ফোরণের ফলে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। আর এতে ধসে যায় শত শত অবকাঠামো।

বৈরুতের কিছু ভৌত অবকাঠামোর সংস্কার সম্ভব হয়েছে।
ছবি: রয়টার্স

বিস্ফোরণের বর্ষপূর্তিতে বৈরুত শহরের বেশ কিছু ছবি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। এগুলোতে দেখা যাচ্ছে, শহরের কিছু কিছু এলাকার ভৌত কাঠামোর সংস্কার হয়েছে। কিন্তু পুরো ক্ষত এখনো সেরে ওঠেনি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ৫ শতাংশ ভবনে পানির সরবরাহ এখনো ঠিক হয়নি। ফলে অনেকে এখনো পরিষ্কার পানি পাচ্ছেন না। এতে পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। বিস্ফোরণে সেখানকার হাসপাতাল ও ক্লিনিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর অনেকগুলোর এখনো সংস্কার সম্ভব হয়নি। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আগুন নিভেছে কিন্তু কিছু কাঠামে ক্ষত রয়ে গেছে।
ছবি: রয়টার্স

আর প্রাণ? বৈরুতের এই বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিলেন ২০০–এর বেশি মানুষ। আহত হয়েছিলেন সাড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষ। এই হতাহতের পরিবারগুলো এখনো শোকাহত। তারা বিচার পায়নি। যে তদন্তের আশ্বাস রাষ্ট্র দিয়েছিল তারও সুরাহা হয়নি।

বৈরুতে বসবাস করা পরিবারগুলো কতটা ট্রমাগ্রস্ত তার একটি চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে। ওই বিস্ফোরণের পর ওই আগস্টেই আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছিল, সেখানকার এক লাখ শিশু গৃহহীন হয়ে পড়েছে। যার একটি বড় অংশ ট্রমাগ্রস্ত। এরপর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জানায়, এই শহরের ৬ লাখ শিশু ট্রমায় রয়েছে। এ ঘটনা এক বছর গড়িয়েছে কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক এক গবেষণা উঠে এসেছে, বৈরুতে বসবাসকারী প্রতি তিনটির একটি পরিবারের শিশুরা এখনো ট্রমাগ্রস্ত। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই প্রভাব আরও বেশি। সংস্থাটি বলছে, প্রায় ৪৬ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এই মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।

বিস্ফোরণের পর ওই আগস্টেই আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছিল, সেখানকার এক লাখ শিশু গৃহহীন হয়ে পড়েছে। যার একটি বড় অংশ ট্রমাগ্রস্ত। এরপর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জানায়, এই শহরের ৬ লাখ শিশু ট্রমায় রয়েছে।

বৈরুতের এই বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে লেবাননের রাজনীতিতে বেশ পরিবর্তন এসেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনসাধারণ তার ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল তৎকালীন সরকারের ওপর। এরপর সরকারে, মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আসে। কিন্তু মূল জায়গায় কেউ হাত দেয়নি। অর্থাৎ ঘটনার তদন্তের কোনো অগ্রগতি হয়নি।

আর এই তদন্ত শেষ না হওয়ায় অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো জানা যায়নি। এসব প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে, এই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট আনার ক্ষেত্রে সুবিধাভোগী কারা? কীভাবে এতে আগুন লেগেছিল? যে পরিমাণ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় মজুত করা হয়েছিল, তার সবটাই বিস্ফোরিত হয়েছিল? এ ছাড়া এই তদন্তের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকজন আমলাকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু কোনো রাজনীতিককে জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ফলে হতাহতদের পরিবারের মধ্যে হতাশা বেড়েছে, বেড়েছে ক্ষোভ। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, রাজনীতিকেরা এই ঘটনা তলিয়ে দেখতে চান না।

বৈরুতের এই বিস্ফোরণকে কেন্দ্র করে লেবাননের রাজনীতিতে বেশ পরিবর্তন এসেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনসাধারণ তার ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল তৎকালীন সরকারের ওপর। এরপর সরকারে, মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আসে। কিন্তু মূল জায়গায় জায়গায় কেউ হাত দেয়নি। অর্থাৎ ঘটনার তদন্তের কোনো অগ্রগতি হয়নি।

ক্ষতিগ্রস্তদের এসব বক্তব্যের সঙ্গে ঘটনার মিলও পাওয়া যায়। এ ছাড়া এই ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তারাও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছেন, এর পেছনে রয়েছে রাজনীতি, রয়েছে আন্তর্জাতিক শক্তিও। কারণ ওই বিস্ফোরণের প্রায় এক মাস আগেই দেশটির প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াকে বিষয়টি নিয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার এতে কর্ণপাত করেনি। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্রের উদাসীনতার বলি হয়েছিলেন বৈরুতবাসী? রাষ্ট্র কী তার নাগরিককে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হলো?

রাষ্ট্রের অক্ষমতাকে সামনে এনেই শেষ হতে পারত এমন প্রশ্নের যদি লেবাননের তদন্তকারীরা এই বিস্ফোরক নিয়ে নতুন তথ্য না জানাতেন। এই বিস্ফোরণের পর তদন্ত কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, এই বিস্ফোরক ব্যবহার হতে পারত সিরিয়ার যুদ্ধে।

সেখানে এই বিস্ফোরক ব্যবহার হয়ে থাকে ব্যারেল বোমা হিসেবে? সিরিয়ার সামরিক বাহিনীর কপ্টার থেকে এমন বোমা ফেলা হয়ে থাকে বিরোধী নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। ফলে প্রশ্ন ওঠে কোন বিদেশি শক্তি জড়িত এই বিস্ফোরক মজুতের সঙ্গে?

পারমাণবিক বিস্ফোরণ বাদ দিলে বৈরুতের এই বিস্ফোরণ বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী বিস্ফোরণ। কিন্তু এই ঘটনার পর বিশ্ব যেভাবে নড়েচড়ে বসেছিল, তাতে ধারণা করা হয়েছিল এর সুরাহা হবে। কিন্তু এক বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাপ্তি শূন্য। কারণ, এই বিস্ফোরণের পর অনেকে কাজ হারিয়েছেন। তাঁদের কর্মসংস্থান হয়নি এখনো। এরপর করোনার মহামারি আরেকটি ধাক্কা দেয়। এতেও কাজ হারিয়েছেন অনেকে। কিন্তু বিপরীতে আর্থিক সাহায্য মিলেছে খুব কমই। ফলে দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন বৈরুতবাসী।

এটা প্রত্যাশা করা যেতেই পারে, লেবাননের বৈরুতবাসীর জীবনে ২০২০ সালের ৪ আগস্টের মতো দিন আর আসবে না। কিন্তু যে ক্ষত হয়েছে সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠে ক্ষতিগ্রস্ত বৈরুতবাসী আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কি না, তা সত্যিকার অর্থেই প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ, স্বজন হারানোর বেদনা ভুলতে পারে কেউ?

* এএফপি, রয়টার্স ও বিবিসি অবলম্বনে মোজাহিদুল ইসলাম মণ্ডল