ইসরায়েলে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড তাঁর। সেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন ক্ষমতা হারানোর প্রহর গুনছেন। এমন প্রেক্ষাপটে একটি প্রশ্ন সামনে এসেই যায়। আর তা হলো, তবে কি ইসরায়েলের রাজনীতিতেও নেতানিয়াহু অধ্যায়ের অবসান ঘটতে যাচ্ছে?
ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে নেতানিয়াহু এত দিন সব চেষ্টাই করেছেন। সামনে তাঁর হাতে যে কদিন আছে, তখনো তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টাটা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা যায়।
অন্যদিকে ইসরায়েলের বিরোধী দলগুলো লক্ষ্য—নেতানিয়াহুকে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা থেকে হটানো। অনেক আলোচনা, দর-কষাকষির পর নতুন জোট সরকার গড়তে ইসরায়েলের বিরোধী দলগুলো একেবারে শেষ মুহূর্তে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ঘোষণা দিয়েছে। মধ্যপন্থী, ডানপন্থী, বামপন্থী মিলিয়ে নানা মত ও পথের বিরোধী দলগুলোর এই ঐক্যই নেতানিয়াহুর সামনে পতনঘণ্টা বাজাচ্ছে।
সব ঠিকঠাক থাকলে, নতুন সরকার গঠিত হলে, নেতানিয়াহুর ১২ বছরের শাসনের অবসান ঘটবে। বিরোধী দলগুলোর চুক্তি অনুযায়ী, কট্টর ডানপন্থী দল ইয়ামিনা পার্টির প্রধান নাফতালি বেনেট প্রথম দুই বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। পরবর্তী দুই বছর প্রধানমন্ত্রী হবেন মধ্যপন্থী দল ইয়েস আতিদের নেতা ইয়ার লাপিড।
শপথ নেওয়ার আগে সরকার গঠনে বিরোধী জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে কি না, তা যাচাই হবে। এ জন্য পার্লামেন্টে ভোটাভুটি হবে। ১২০ আসনের পার্লামেন্টে জোট যদি কোনো কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়, তাহলে নতুন করে জাতীয় নির্বাচন হবে। বিরোধী দলগুলো ঐক্যে পৌঁছায় তারা পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নেতানিয়াহুর যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তাঁর যে অতীত কর্মকাণ্ড, তা থেকে ধারণা রা যায়, তিনি বিরোধী নেতা হিসেবে নতুন সরকারকে যেকোনো সময় বেকায়দায় ফেলতে পারেন। নতুন সরকারের জন্য তিনি হুমকি হয়ে উঠতে পারেন।
আপাতত যে পরিস্থিতি, তাতে ইসরায়েলের ক্ষমতা থেকে নেতানিয়াহু বিদায় নিতে যাচ্ছেন, সে কথা বলা যায়। তবে ইসরায়েলের রাজনীতিতে নেতানিয়াহু অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে বলে মনে হয় না। এমনকি ইসরায়েলের ক্ষমতার রাজনীতিতে নেতানিয়াহুর ফের ফিরে আসার সম্ভাবনা বিশ্লেষকেরা নাকচ করতে পারছেন না।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, আগামী অন্তত ১০ দিনের আগে ইসরায়েলে নতুন সরকার গঠিত হচ্ছে না। এই সময় পর্যন্ত নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী থাকছেন। তখন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। এই সময়ে নেতানিয়াহু তাঁর প্রতিপক্ষদের ধরাশায়ী করতে সব রকমের চেষ্টাই চালাবেন।
বিবিসির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সম্পাদক জেরেমি বোয়েনেরও প্রায় একই অভিমত। তাঁর মতে, ক্ষমতা ধরে রাখতে নেতানিয়াহু মরিয়া। নতুন সরকার, নতুন প্রধানমন্ত্রী আসার আগপর্যন্ত তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে সবকিছুই করবেন। আবার তিনি যদি বিরোধী নেতা হন, তা হলেও জোট সরকারকে অস্থিতিশীল করতে সবকিছুই করবেন তিনি।
গত মার্চে ইসরায়েলে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠন করার মতো আসন পায়নি। তবে আসনের দিক দিয়ে নেতানিয়াহুর ডানপন্থী দল লিকুদ পার্টি সবার ওপরে। পার্লামেন্টে তাঁর দল ৩০টি আসন পেয়েছে। তাঁর দলের পরই রয়েছে লাপিডের ইয়েস আতিদ। ইয়েস আতিদের আসন ১৭টি। আসনসংখ্যা বলে দেয়, ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর ভালোই জনসমর্থন আছে।
ক্ষমতা হারালে নেতানিয়াহু হবেন বিরোধী নেতা। বিরোধী নেতা হিসেবে তিনি জোট সরকারকে স্বস্তিতে থাকতে দেবেন বলে মনে করেন না বিশ্লেষকেরা। রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, নেতানিয়াহুকে হয়তো সরকার থেকে সরানো যাবে, কিন্তু তিনি ভেঙে পড়ার লোক নন। তিনি শক্তশালী বিরোধী নেতা হতে পারেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নেতানিয়াহুর যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তাঁর যে অতীত কর্মকাণ্ড, তা থেকে ধারণা রা যায়, তিনি বিরোধী নেতা হিসেবে নতুন সরকারকে যেকোনো সময় বেকায়দায় ফেলতে পারেন। নতুন সরকারের জন্য তিনি হুমকি হয়ে উঠতে পারেন।
নেতানিয়াহু বিরোধী নেতা হলে যে চুপচাপ বসে থাকবেন না, তার আভাস এখনই স্পষ্ট। তিনি ইতিমধ্যে বিরোধী দলগুলোর জোটের সম্ভাব্য সরকারকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও জনগণের জন্য বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
নেতানিয়াহুকে হটানো ছাড়া আর খুব কম বিষয়েই বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সাধারণ ঐক্য আছে। এই দিকটি নেতানিয়াহুকে ভবিষ্যতে বেশ সুবিধা দিতে পারে। তিনি এই দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে বা তাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে সচেষ্ট থাকবেন বলে ধারণা করা যায়।
অবশ্য নেতানিয়াহু যে একাই সব খেলা খেলবেন, এমনটা ভাবার কারণ নেই। বিরোধী দলে গেলে নেতানিয়াহুকে রাজনীতির মাঠের পাশাপাশি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে। এই মামলা তাঁর জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে।