২০০ বছর ধরে প্রভাবশালী দেশগুলো আকাশপথে কীভাবে নজরদারি চালাচ্ছে

সম্প্রতি বেলজিয়ামের একটি বিমানঘাঁটি এলাকায় কয়েকটি সন্দেহজনক ড্রোন শনাক্ত হয়। ২ নভেম্বর দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাবি করেন, বেলজিয়ামের ‘সামরিক যুদ্ধবিমানের ওপর নজরদারি করতে’ ড্রোনগুলো সেখানে পাঠিয়েছে কেউ। এমন অভিযোগ নতুন কিছু নয়। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো একে অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় মত্ত। আর তা করতে গিয়ে দেশগুলো অনেক সময় একে অপরের কর্মকাণ্ডের দিকে গোপনে নজর রাখে। এসব নজরদারির ঘটনা যখন সামনে আসে তখন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে শুরু হয় পাল্টাপাল্টি উত্তেজনা। একসঙ্গে বিস্তৃত এলাকাকে নজরদারির আওতায় রাখতে অনেক বছর আগে থেকেই আকাশপথকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে আকাশপথে নজরদারির মাধ্যমগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

২০২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় শনাক্ত হয় একটি চীনা বেলুন। প্রায় ২০০ ফুট উঁচুতে ভেসে ছিল সেটি। এর নিচে ঝুলে ছিল অন্তত ৩০ ফুট চওড়া একটি ফ্রেম। দক্ষিণ ক্যারোলাইনা উপকূলে এফ-২২ যুদ্ধবিমানের সাহায্যে বেলুনটি ভূপাতিত করে যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় বেশ হইচই শুরু হয়।

যুক্তরাষ্ট্র তখন অভিযোগ করেছিল, এটি চীনের নজরদারি বেলুন। এর সঙ্গে নজরদারির সামগ্রী যুক্ত ছিল বলে দাবি করে তারা। তবে চীন দাবি করে, এটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী বেলুন ছিল এবং বেসামরিক গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল। প্রবল বাতাসের কারণে বেলুনটি পথভ্রষ্ট হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছিল।

বেলুন হলো আকাশপথে নজরদারির প্রাচীনতম মাধ্যমগুলোর একটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনারা যুক্তরাষ্ট্রে অগ্নিসংযোগকারী বোমা ফেলার জন্য এ ধরনের বেলুন ব্যবহার করতেন। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালেও যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যাপকভাবে বেলুনের ব্যবহার করেছিল। তবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এ সময়ে এসেও ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে নজরদারির কাজে বেলুনের ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কবুতর যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। কবুতরগুলো আটকে পড়া নাবিকদের সাহায্য চেয়ে পাঠানো বার্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দিত। গুপ্তচরদের পাঠানো সাংকেতিক বার্তাগুলোও যথাযথ জায়গায় পৌঁছে দিত।

এক দেশ আরেক দেশের ওপর নজরদারি চালাতে আজকাল নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে ঠিকই, তবে এ ক্ষেত্রে ওপর থেকে (আকাশ থেকে) নজরদারিকে সবচেয়ে কার্যকর বলে বিবেচনা করা হয়।

আকাশ থেকে নজরদারির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের ইমেরিটাস কিউরেটর টম ডি ক্রাউচ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শত্রুরেখার পেছনের অংশে কী আছে, তা যতটা বেশি সম্ভব নজরে রাখার জন্য উঁচুতে উঠে পর্যবেক্ষণ করাটাই সব সময় কার্যকর।

২০০ বছরের বেশি সময় ধরে আকাশপথে বিভিন্ন মাধ্যম ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে এক দেশ আরেক দেশের ওপর নজরদারি চালিয়ে আসছে। ওই সময় থেকে এ পর্যন্ত বেলুন থেকে শুরু করে ঘুড়ি, ক্যামেরাবাহী কবুতর, গোয়েন্দা উড়োজাহাজ, ড্রোন, স্যাটেলাইটসহ নানা মাধ্যমের ব্যবহার দেখা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিয়ন আর্মি ইনট্রেপিড নামের এ গোয়েন্দা বেলুনটি ব্যবহার করত
ছবি: লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ওয়েবসাইট

গোয়েন্দা বেলুন

১৭৯০-এর দশকের শুরুর দিকে ফরাসিরা যুদ্ধক্ষেত্রে নজরদারি চালাতে সর্বপ্রথম গোয়েন্দা বেলুনের ব্যবহার শুরু করেন। বেলুনগুলো হাইড্রোজেন গ্যাসে ভরা থাকত। এগুলো যে শত্রুপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় গিয়ে ওড়াউড়ি করত, এমন নয়। এগুলোকে নিজেদের সীমান্ত এলাকায় একধরনের তারের সাহায্যে আটকে রাখা হতো।

বেলুনের সঙ্গে যুক্ত ঝুড়িতে দুজন সেনা বসতে পারতেন। তাঁদের একজন দুরবিন দিয়ে শত্রুপক্ষের অবস্থান দেখতেন। আর অন্যজন পতাকা ব্যবহার করে ভূমিতে থাকা কর্মকর্তাদের কাছে সংকেত পাঠাতেন।

ইতিহাসবিদ এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পাই মিউজিয়ামের কিউরেটর অ্যান্ড্রু হ্যামন্ড বলেন, আকাশ পরিষ্কার থাকলে ওই ধরনের বেলুনে চড়ে ৫০ মাইল দূর পর্যন্ত দেখা যেত।

যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ চলার সময় উদ্ভাবক থ্যাডেউস লোও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সামনে একটি গোয়েন্দা বেলুন প্রদর্শন করেন। লিংকন তখন ওই বেলুনের কার্যকারিতা দেখে মুগ্ধ হন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিয়ন আর্মি গোয়েন্দা বেলুনের ব্যবহার শুরু করে। সবচেয়ে বড় বেলুনটির নাম ছিল ইনট্রেপিড। এটিতে একজন টেলিগ্রাফ অপারেটরসহ পাঁচজন বসতে পারতেন।

ঘুড়ি ব্যবহার করে আকাশ থেকে ছবি তোলা

১৮৮০-এর দশকে ব্রিটিশ আবহাওয়াবিদ ডগলাস আর্চিবল্ড বড় ক্যানভাস ঘুড়ি দিয়ে বাতাসের গতিবেগ পরিমাপ করতেন। তিনি ঘুড়িতে ক্যামেরা লাগিয়ে রাখতেন আর দূর থেকে একটি কেব্‌লের সাহায্যে ক্যামেরার শাটারটি চালাতেন।

আর্চিবল্ডের তোলা ছবিগুলো ওই সময় বেশ আলোড়ন তৈরি করেছিল। ছবিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সেনা করপোরাল উইলিয়াম এড্ডির নজরে আসে। ১৮৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র-স্পেন যুদ্ধ চলাকালে এড্ডি নিজেই ঘুড়িতে ক্যামেরা লাগিয়ে শত্রুর অবস্থানের ছবি তুলেছিলেন।

গৃহযুদ্ধের সময় সাধারণ ফটোগ্রাফি চালু ছিল ঠিকই, তবে এড্ডির ঘুড়ি দিয়ে তোলা ছবিকেই সামরিক উড়োজাহাজ থেকে তোলা প্রথম নজরদারির ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কবুতর যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল
ছবি: ইন্টারন্যাশনাল স্পাই মিউজিয়ামের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

ক্যামেরা বহনকারী কবুতর

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কবুতর যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। কবুতরগুলো আটকে পড়া নাবিকদের সাহায্য চেয়ে পাঠানো বার্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দিত। গুপ্তচরদের পাঠানো সাংকেতিক বার্তাগুলোও যথাযথ জায়গায় পৌঁছে দিত। কবুতরের মাধ্যমে আকাশ থেকে ছবি তোলারও চেষ্টা করা হতো।

১৯০৭ সালে জার্মান ফার্মাসিস্ট জুলিয়াস নিউব্রোনার কবুতরের গায়ে লাগিয়ে ব্যবহার উপযোগী একটি ক্যামেরা উদ্ভাবন করেন এবং এটির পেটেন্ট পান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনারা এভাবে কবুতর দিয়ে ছবি তোলা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন।

ইতিহাসবিদ হ্যামন্ড বলেন, তাঁরা আসলেই কবুতরের সঙ্গে ক্যামেরা বেঁধে ফ্রান্সের পরিখাগুলোতে পাঠাতেন; কিন্তু ছবি অস্পষ্ট হতো এবং বোঝা কঠিন হতো।

সিআইএও হালকা ওজনের কবুতরের ক্যামেরার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিল। তবে কবুতরগুলো নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ এরিয়াল টার্গেট নামের একটি রেডিও–কন্ট্রোলড উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হয়
ছবি: ইম্পেরিয়াল ওয়াল মিউজিয়ামের ওয়েবসাইট

প্রথম নজরদারি উড়োজাহাজ এবং কোডাক ক্যামেরা

সর্বপ্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে উড়োজাহাজের ব্যবহার শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে। তবে শুরুতে এগুলোকে যুদ্ধবিমান বা বোমারু বিমান হিসেবে ব্যবহার করা হতো না। তখন উড়োজাহাজের কাজ ছিল কেবল নজরদারি চালানো। দুই আসনের উড়োজাহাজে একজন পাইলট এবং একজন পর্যবেক্ষক থাকতেন। ওই পর্যবেক্ষক দুরবিন ব্যবহার করে শত্রুপক্ষের সেনাদের অবস্থান শনাক্ত করতেন।

এরপর উড়োজাহাজে ক্যামেরা বসানো শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কোডাক কোম্পানি এ ধরনের ক্যামেরা তৈরি করে। কোডাকের রচেস্টার সদর দপ্তরে একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালু ছিল। সেখানে সেনাদের যুদ্ধক্ষেত্রে নজরদারির জন্য সহায়ক ছবি তোলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাগাদ নজরদারি বিমানগুলোতে অস্থায়ী ডার্করুম বসানো হয়। সেখানে যথাযথ সময়ে ছবিগুলো প্রক্রিয়াকরণ ও বিশ্লেষণ করা যেত। স্নায়ুযুদ্ধের সময় রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি স্থলভাগে গুপ্তচরবৃত্তি প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিল। তাই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা তখন আকাশের দিকে মনোযোগ দিয়েছিল।

স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী ডিসকভারার নামের একটি কর্মসূচি চালু করে
ছবি: ইন্টারন্যাশনাল স্পাই মিউজিয়ামের এক্স অ্যাকাউন্ট

প্রথম গোয়েন্দা স্যাটেলাইট

যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যে শুধু কার আগে কে চাঁদে পৌঁছাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করত, তা নয়। কে প্রথম কক্ষপথে গোয়েন্দা স্যাটেলাইট পাঠাবে, তা নিয়েও প্রতিযোগিতায় মেতেছিল তারা।

১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী ডিসকোভারার নামের একটি কর্মসূচি চালু করে। আদতে এটি ছিল প্রজেক্ট করোনা নামের একটি গোপন গোয়েন্দা কর্মসূচি। এর মধ্য দিয়ে গোয়েন্দা নজরদারি চালানো হতো।

১৯৬০ সালে প্রথমবারের মতো গোয়েন্দা স্যাটেলাইটগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নে নজরদারির ছবি পাঠানো শুরু করে। স্নায়ুযুদ্ধের শেষ দিকে হেক্সাগন কেএইচ-৯ নামের স্যাটেলাইটের ব্যবহার শুরু হয়। এ স্যাটেলাইট ১০০ মাইল উঁচু থেকে ২ ফুট আকারের ছোট বস্তুরও ছবি নিতে পারত।

সিআইএর তৈরি ড্রাগনফ্লাই ড্রোন
ছবি: সিআইএর ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

সিআইএর ড্রাগনফ্লাই ড্রোন

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর জাদুঘরে থাকা সবচেয়ে আলোচিত যন্ত্রগুলোর একটি হলো ইনসেক্টোথোপটার। এটি একধরনের গোপন শোনার যন্ত্র, যা দেখতে একদমই ফড়িংয়ের মতো ছিল। সে জন্য এটিকে ড্রাগনফ্লাই ড্রোন বলা হতো। সিআইএ ১৯৭০-এর দশকে এটি তৈরি করে।

ইনসেক্টোথোপটারের স্বচ্ছ ডানায় ছোট একটি গ্যাসোলিন ইঞ্জিন লাগানো ছিল। ৬০ সেকেন্ডে দুটি ফুটবল মাঠের দূরত্ব অতিক্রম করার সক্ষমতা ছিল এটির।

ইনসেক্টোথোপটার এমনভাবে তৈরি হয়েছিল, যেন একজন অপারেটর লেজার বিম ব্যবহার করে এটির ওড়াউড়িকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং মাইক্রোফোনে ধারণ করা অডিও শুনতে পাওয়া যায়। তবে ইনসেক্টোথোপটার যন্ত্রটিকে কার্যকরভাবে চালানো যায়নি। কারণ, বাতাসের গতি ঘণ্টায় পাঁচ মাইলের বেশি হলেই এটি ভেঙে যেত।

কুইন বি ড্রোন
ছবি: ইম্পেরিয়াল ওয়াল মিউজিয়ামের ওয়েবসাইট

প্রথম চালকবিহীন উড়োজাহাজ বা ড্রোন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ এরিয়াল টার্গেট নামের একটি রেডিও–কন্ট্রোলড উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হয়। ওই সময় ব্রিটিশ সেনাদের আকাশে নিশানা করার প্রশিক্ষণ দিতে এ ধরনের উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী চালকবিহীন এ উড়োজাহাজের নাম দেন কুইন বি। এটি ছিল পুনর্ব্যবহারযোগ্য। যুদ্ধবিমানের চালকেরা এটিকে নিশানা করার মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ চালাতেন। ব্রিটিশ উড়োজাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ডি হাভিল্যান্ড এই কুইন বি উড়োজাহাজ তৈরি করেছিল।

উড়োজাহাজটির রাডার ও এলিভেটর নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোম্পানিটি একটি রেডিও-নিয়ন্ত্রিত সার্ভো ব্যবহার করেছিল। ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, এই মৌমাছি থিমযুক্ত চালকবিহীন বিমান থেকেই ‘ড্রোন’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নজরদারি কর্মসূচির অংশ হিসেবে সর্বপ্রথম ভিয়েতনাম যুদ্ধে জেটচালিত নজরদারি ড্রোন ব্যবহার করা হয়। এটির নাম ছিল একিউএম-৩৪ রায়ান ফায়ারবি।

যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যে শুধু কার আগে কে চাঁদে পৌঁছাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা করত, তা নয়। কে প্রথম কক্ষপথে গোয়েন্দা স্যাটেলাইট পাঠাবে, তা নিয়েও প্রতিযোগিতায় মেতেছিল তারা। ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী ডিসকভারার নামের একটি কর্মসূচি চালু করে। আদতে এটি ছিল প্রজেক্ট করোনা নামের একটি গোপন গোয়েন্দা কর্মসূচি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৩৪ হাজারের বেশি নজরদারি মিশনে এ ড্রোন ব্যবহার করা হয়। রাডারকে ফাঁকি দিয়ে চলাচলের উপযোগী করে এটির রং করা হয়েছিল। এটি যেমন শত্রুর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করত, পাশাপাশি শত্রুপক্ষের সীমানায় প্রচারপত্র ছড়াতেও এটিকে ব্যবহার করা হতো।

এ তো গেল পুরোনো ধাঁচের সব নজরদারি মাধ্যমের কথা। তবে প্রযুক্তিতে পুরোনো হলেও এগুলো নতুনরূপে এখনো ফিরে আসছে এবং এগুলোতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ফিল্ড মার্শাল জোহানেস আরভিন রোমেল একবার বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে স্থলযুদ্ধের শুরুটা আকাশ থেকেই হবে। এর মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হয়ে যাবে, কোন পক্ষ অভিযান পরিচালনায় ও কৌশলগতভাবে দুর্বল হবে এবং যুদ্ধ চলাকালে বারবার সমঝোতার পথে যেতে বাধ্য হবে।’

রোমেলের এ কথাটি আজকের দিনে আগের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রগুলো এখনো অন্য দেশে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য স্যাটেলাইট, ড্রোনসহ নানা অত্যাধুনিক মাধ্যম ব্যবহার করছে। হয়তো এটি যুদ্ধবিমানের মুখোমুখি লড়াইয়ের বিষয় নয়। তবু এটি আকাশে আধিপত্য বজায় রাখার এক লড়াই হিসেবে থেকে গেছে। নজরদারির মাধ্যমগুলোতে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তিও যুক্ত করা হচ্ছে।

এখন কথা হলো, আকাশপথে অন্য দেশের ওপর নজরদারির বিষয়টি কতটা হুমকির। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশকারী ওয়েবসাইট মডার্ন ডিপ্লোমেসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, নজরদারি ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য হুমকি তৈরি করে, নাগরিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করতে পারে এবং রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করতে পারে। প্রতিপক্ষের সামরিক ও নাগরিক স্থাপনা তাদের অনুমতি ছাড়া পর্যবেক্ষণ করাটা নৈতিকভাবে অনুচিত।

একইভাবে নজরদারি তথ্যের ভুল বিশ্লেষণের কারণে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে, যা সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এ ছাড়া নজরদারি তথ্যের অপব্যবহার বা ডিভাইস হ্যাক হলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে স্পর্শকাতর তথ্য চলে যেতে পারে। এতে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই এ ধরনের নজরদারির কাজগুলো নিয়মিত নিয়ন্ত্রিত হওয়া জরুরি। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের উচিত যুদ্ধবিধি এবং মানবাধিকার আইন মেনে নজরদারি কার্যক্রম পরিচালনা করা।

সূত্র: হিস্ট্রি ডট কম, এনপিআর, বিবিসি, রয়টার্স