বিশ্বের শীর্ষ ১০ স্থপতি

শিল্প ও বিজ্ঞানের এক অসাধারণ সমন্বয় স্থাপত্যশিল্প। কিছু স্থপতি তাঁদের সৃজনশীল নকশা ও দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে এক অমোচনীয় কৃতিত্বের ছাপ রেখে গেছেন। নিচে বিশ্বের এমন ১০ শীর্ষ খ্যাতনামা স্থপতির নাম দেওয়া হলো, যাঁরা বিশ্বের স্থাপত্য শিল্প গঠনে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। তালিকাটি প্রকাশ করেছে ইনফ্রাস্ট্রাকচারআর্কিটেক্টস ডটকম।

ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইট

ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইট
ছবি: ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইট ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

স্থপতিদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন মার্কিন স্থপতি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট। তিনি মূলত উদ্ভাবনী নকশা ও প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থাপত্য ধারণার জন্য পরিচিত। তাঁকে আধুনিক স্থাপত্যের পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয়।

ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইটের জন্ম ১৮৬৭ সালের ৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে। ৭০ বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনে ফ্র্যাঙ্ক লয়েড বিংশ শতাব্দীর স্থাপত্যের অন্যতম সৃজনশীল ও ব্যতিক্রমী স্থাপত্যগুরু হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।

শতাব্দীর সেরা ১০০টি স্থাপনার মধ্যে অন্তত ১২টি স্থাপনার নির্মাতা ফ্র্যাঙ্ক লয়েড। তিনি এক হাজারের বেশি স্থাপনার নকশা করেছেন, যার মধ্যে ৫০০টির বেশি নির্মিত হয়েছে। তাঁর বিখ্যাত কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে পেনসিলভানিয়ার ফলিংওয়াটার ও নিউইয়র্কের গুগেনহাইম জাদুঘর।

ফ্র্যাঙ্ক লয়েডকে মার্কিন স্থাপত্যের প্রথম সত্যিকারের রূপদাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি অসংখ্য বাসভবন, অফিস, গির্জা, বিদ্যালয়, আকাশচুম্বী ভবন, হোটেল ও জাদুঘরের নকশা করেছেন। এগুলো প্রমাণ করে যে, তিনি শুধু স্থাপত্য পেশাকেই নয়, গোটা মার্কিন সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন।

লা কর্বুশিয়ে

লা কর্বুশিয়ে
ফাইল ছবি: এএফপি

লা কর্বুশিয়ে একজন বিশ্বখ্যাত স্থপতি, নগর–পরিকল্পনাবিদ ও নকশাকার। আধুনিক স্থাপত্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে তিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিত।

সুইস-ফরাসি এ স্থপতির জন্ম ১৮৮৭ সালের ৬ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডে। তাঁর বাবা এদুয়ার জ্যঁনেরে ছিলেন একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। মা মাদাম জ্যঁনেরে ছিলেন সংগীতশিল্পী ও পিয়ানো শিক্ষক।

১৯০৭ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে লা কর্বুশিয়ে প্রথম বাড়ির নকশা করেন। এরপর মধ্য ইউরোপ এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ ও শহর—ইতালি, ভিয়েনা, মিউনিখ ও প্যারিস ভ্রমণ করেন। ভ্রমণকালে তিনি বিভিন্ন স্থপতির সঙ্গে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেন। ১৯১১ সাল পর্যন্ত এভাবেই কেটে যায় তাঁর। এ ভ্রমণগুলো তাঁর শিক্ষাজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ফ্রান্সের প্যারিস ও এর আশপাশে নির্মিত একাধিক ব্যক্তিগত বাড়ির মাধ্যমে লা কর্বুশিয়ে তাঁর তত্ত্বের বাস্তবায়ন করেন। ১৯৩১ সালে নির্মিত ভিলা সাভোয়ে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকর্ম। এটি প্যারিসে অবস্থিত একটি শুভ্র নান্দনিক স্থাপনা।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো লা কর্বুশিয়ের ১৭টি স্থাপত্যকর্মকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্থাপনাগুলো সাতটি দেশে অবস্থিত।

লা কর্বুশিয়ে ১৯৩০ সালে ফরাসি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে ফ্রান্সেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

জাহা হাদিদ

জাহা হাদিদ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইরাকি-ব্রিটিশ স্থপতি জাহা হাদিদ তাঁর সাহসী ও ভবিষ্যৎমুখী নকশার জন্য পরিচিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে আজারবাইজানে হেইদার আলিয়েভ সেন্টার ও লন্ডনের অ্যাকোয়াটিকস সেন্টার।

অসাধারণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে প্রথম নারী হিসেবে রয়েল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস (রিবা) স্বর্ণপদক লাভ করেন জাহা হাদিদ। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের লন্ডনের সার্পেন্টাইন স্যাকলার গ্যালারি, স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর রিভারসাইড মিউজিয়াম (মিউজিয়াম অব ট্রান্সপোর্ট) ও চীনের গুয়াংঝু অপেরা হাউস উল্লেখযোগ্য।

জাহা হাদিদ ১৯৫০ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।

স্যার নরমান ফস্টার

স্যার নরমান ফস্টার
ফাইল ছবি: এএফপি

স্যার নরমান ফস্টার একজন ব্রিটিশ স্থপতি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে লন্ডনের ঘারকিন ও নিউইয়র্কের হারস্ট টাওয়ার। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে অবস্থিত অ্যাপলের সদর দপ্তরের নকশাও করেছেন তিনি।

নরমান ফস্টার ১৯৩৫ সালের ১ জুন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ফস্টার প্লাস পার্টনারস স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। ৯০ বছর বয়সেও তিনি উদ্যমের সঙ্গে স্থাপত্যের নকশা ও কাজ করে যাচ্ছেন।

ফস্টারের স্থাপত্যে স্টিল ও কাচের ব্যবহার, পরিবেশবান্ধব নকশা এবং আধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণ চোখে পড়ার মতো। তিনি নরম্যান ফস্টার ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটি স্থাপত্য, নকশা ও নগর–পরিকল্পনায় নতুন প্রজন্মের পেশাদারদের প্রশিক্ষণ এবং গবেষণায় সহায়তা করছে।

আন্তোনি গাউদি

আন্তোনি গাউদি একজন স্প্যানিশ স্থপতি। তাঁকে ‘ঈশ্বরের স্থপতি’ বলা হয়।

আন্তোনি গাউদের জন্ম ১৮৫২ স্পেনে। মৃত্যু ১৯২৬ সালে। তিনি অনন্য শৈলীতে গথিক ও আর্ট নুভো উপাদানগুলো একত্র করেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো, স্পেনের বার্সেলোনার সাগ্রাদা ফামিলিয়া। এটি মূলত একটি ক্যাথলিক গির্জা।

বার্সেলোনা শহর ও এর আশপাশে নির্মিত সাতটি স্থাপনা প্রমাণ করে ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ এবং বিংশ শতকের শুরুতে স্থাপত্য ও নির্মাণ প্রযুক্তির বিকাশে গাওদির অসাধারণ সৃজনশীল অবদান ছিল। তাঁর উল্লেখযোগ্য স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে পার্ক গুয়েল, প্যালাসিও গুয়েল, কাসা মিলা ও কাসা ভিসেন্স।

ফ্রাঙ্ক গেরি

ফ্রাঙ্ক গেরি
ফাইল ছবি: এএফপি

ফ্রাঙ্ক গেরি একজন কানাডীয়-মার্কিন স্থপতি। তিনি ডিকনস্ট্রাকটিভিস্ট নকশার জন্য পরিচিত। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো স্পেনের বিলবাও শহরে অবস্থিত গুগেনহাইম জাদুঘর। ডিকনস্ট্রাকটিভিজম এমন এক নকশা-শৈলী; যেখানে ভবনের অংশগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ভাঙাচোরা, খণ্ডিত, বাঁকানো বা এলোমেলো মনে হয়। তবে এর মধ্যেই থাকে একধরনের সৃজনশীল সৌন্দর্য।

ফ্রাঙ্ক গেরির জন্ম ১৯২৯ সালে কানাডার অন্টারিওতে। ১৯৪৭ সালে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলসে পাড়ি জমান তিনি। সেখানেই থিতু হন এ স্থপতি।

বিংশ শতকের শেষভাগের অন্যতম প্রভাবশালী স্থপতি হিসেবে গণ্য করা হয় ফ্র্যাঙ্ক গেরিকে। তিনি ১৯৫৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে স্থাপত্যে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। পরে হার্ভার্ডের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ডিজাইনে নগর–পরিকল্পনা অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। তবে কিছুদিন পরই পড়া বাদ দিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরে যান। সেখানে গ্রুয়েন অ্যাসোসিয়েটসে কাজ করেন ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। এরপর নিজস্ব স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।

ফ্র্যাঙ্ক গেরি নান্দনিক ভবন ও ঘরের অন্দরে ব্যবহারের জন্য নান্দনিক ফার্নিচারেরও নকশা করেছেন।

আই এম পেই

আই এম পেই
ফাইল ছবি: এএফপি

আই এম পেই একজন চীনা-মার্কিন স্থপতি। এই স্থপতি আধুনিকতাবাদী নকশার জন্য পরিচিত।

১৯১৭ সালে চীনের গুয়াংজু প্রদেশে আই এম পেইর জন্ম। ১৭ বছর বয়সে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ১৯৪০ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর হার্ভার্ড স্কুল অব ডিজাইন থেকে ১৯৪৬ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর দুই বছর সেখানে অধ্যাপনা করেন।

পরে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে যোগ দেন আই এম পেই। তাঁর বিখ্যাত স্থাপত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর পিরামিড ও হংকংয়ের ব্যাংক অব চায়না টাওয়ার।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ, চীন ও কাতারে আই এম পেই-এর নান্দনিক স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মারা যান তিনি।

তাদাও আন্দো

তাদাও আন্দো
ছবি: তাদাও আন্দো ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

তাদাও আন্দো একজন জাপানি স্থপতি। তিনি মিনিমালিস্ট কংক্রিট নকশার জন্য পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত স্থাপত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে ওসাকার চার্চ অব দ্য লাইট ও সুমিয়োশির রো হাউস। মিনিমালিস্ট কংক্রিট নকশায় অপ্রয়োজনীয় অলংকরণ বাদ দেওয়া ও সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো, বিশেষত কাঁচা কংক্রিট ব্যবহার করা হয়।

তাদাও আন্দোর জন্ম ১৯৪১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাপানের ওসাকায়। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা না করে নিজেই প্রশিক্ষিত হয়ে একজন বিশ্বখ্যাত স্থপতি হয়েছেন তিনি।

১৯৮৯ সালে নির্মিত ওসাকার চার্চ অব দ্য লাইট তাদাও আন্দোর অন্যতম সৃষ্টিশীল কাজ। একটি সোজা কংক্রিট ঘরের দেয়ালে ক্রস আকৃতির আলো ঢুকিয়ে সেটিকে দূরদর্শী শিল্পকর্মে পরিণত করেছেন তিনি।

তাদাও আন্দো ১৯৯৫ সালে স্থাপত্যের ‘নোবেল’ খ্যাত প্রিৎসকার পুরস্কার লাভ করেন। ২০২২ সালে জাপানের সর্বোচ্চ সাংস্কৃতিক সম্মান ‘অর্ডার অব কালচার’ লাভ করেন তিনি। জাপান ছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, মেক্সিকো ও চীনের নান্দনিক এবং দর্শনীয় বেশ কিছু ভবনের নকশা করেছেন।

রেনজো পিয়ানো

রেনজো পিয়ানো
ফাইল ছবি: এএফপি

রেনজো পিয়ানো একজন ইতালীয় স্থপতি। জন্ম ১৯৩৭ সালে ইতালিতে। তিনি উচ্চ প্রযুক্তি ও টেকসই নকশার জন্য পরিচিত।

রেনজো পিয়ানোর উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের সঁত্র পঁপিদু। সঁত্র পঁপিদুর বাহ্যিক অংশে রঙিন পাইপ, লিফট ও সার্ভিস স্ট্রাকচার রেখে স্থাপত্য শিল্পে এক নতুন যুগের সূচনা করেন তিনি। তাঁর নকশায় প্রযুক্তির দক্ষতা, উপকরণের স্বচ্ছতা ও পরিবেশ-সচেতনতা একসঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে।

রেনজোর নকশায় করা লন্ডনের দ্য শার্ড ইউরোপের অন্যতম উঁচু টাওয়ার। কাচ ও পুনর্ব্যবহৃত উপকরণ দিয়ে তৈরি এ টাওয়ার প্রযুক্তি ও নান্দনিকতার নিখুঁত মিশ্রণ।

১০

বিয়র্কে ইংগেলস

বিয়র্কে ইংগেলস একজন ডেনিশ স্থপতি। তিনি উদ্ভাবনী ও টেকসই নকশার জন্য পরিচিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে নিউইয়র্কের আবাসিক ভবন ‘ভায়া ৫৭ ওয়েস্ট’ ও কোপেনহেগেনের বিখ্যাত স্থাপত্য প্রকল্পগুলো।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান সিএনএন