বিশ্বকে যাঁরা বদলে দিয়েছেন

মহাবিশ্বের গূঢ় রহস্য উন্মোচন থেকে শুরু করে মানুষের জন্মরহস্য উন্মোচন—বিশ্বজুড়ে খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা শুধু মানুষের জানার পরিধিই বাড়াননি, বরং আমাদের জীবনযাত্রার ধরনকে এবং বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে বদলে দিয়েছেন। বিশ্বের সেরা ১০ বিজ্ঞানীকে নিয়ে প্রথম আলোর আজকের আয়োজন।

আলবার্ট আইনস্টাইন

আলবার্ট আইনস্টাইন
ছবি: সংগৃহীত

আলবার্ট আইনস্টাইন শুধু একজন দারুণ প্রতিভাবান বিজ্ঞানীই নন, দারুণ জনপ্রিয় একজন মানুষও ছিলেন। তাঁর ছিল ভীষণ কৌতূহলী এক মন। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। আইনস্টাইনের বিখ্যাত ইকুয়েশন (E=mc2) এবং থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জে করেছিল এবং বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জানাকে পাল্টে দিয়েছে।

আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালে, জার্মানিতে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে আলোক তড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যার তত্ত্ব প্রদান করার জন্য ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৫৫ সালে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয় মারা যান এই বিজ্ঞানী। স্যাটারডে ইভিনিং পোস্টে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘নিজের কল্পনাকে স্বাধীনভাবে আঁকার জন্য শিল্পী হিসেবে আমিই যথেষ্ট। জ্ঞানের সীমা আছে। পৃথিবীকে ঘিরে আছে কল্পনা।’

মেরি কুরি

ম্যারি ও পিয়েরে কুরি
ছবি: এএফপি

নোবেল পুরস্কারজয়ী প্রথম নারী বিজ্ঞানী মেরি কুরি। তিনি বেড়ে উঠেছেন পোল্যান্ডে, তবে ফরাসি সাংস্কৃতিক আবহে। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণায় মেরি কুরি এবং তাঁর স্বামী পিয়েরে কুরি অসামান্য অবদান রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য পিয়েরে কুরির সঙ্গে ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জেতেন মেরি কুরি। শুধু তা–ই নয়, মেরি কুরি একমাত্র বিজ্ঞানী, যিনি দুইটি ভিন্ন ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন।

১৯১১ সালে মেরি কুরি রসায়নে নোবেল পুরস্কার জেতেন। পোলোনিয়াম ও রেডিয়ামের মতো উপাদান নিয়ে মেরি কুরির গবেষণার ফল আমাদের আজকের চিকিৎসা পরিষেবার অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্র এক্স-রে। একধরনের রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৪ সালে মারা যান মেরি কুরি। ধারণা করা হয়, গবেষণা কাজের জন্য লম্বা সময় ধরে তেজস্ক্রিয় পদার্থের সংস্পর্শে থাকার কারণে ওই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর নোটবুক এবং গবেষণাপত্র থেকে এখনো উচ্চমাত্রায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়। তাই, সেগুলো বিশেষ বাক্সে রাখা হয় এবং বিশেষ ব্যবস্থায় সেগুলো দেখা হয়।

আইজ্যাক নিউটন

বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন
ছবি: সংগৃহীত

আইজ্যাক নিউটন ছিলেন একজন ইংরেজ গণিতবিদ, পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিদ। ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানীদের অন্যতম তিনি। বিজ্ঞান ও গণিতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। ১৭ শতকে যাঁদের হাত ধরে বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে বিপ্লব হয়েছে, তাঁদের অন্যতম আইজ্যাক নিউটন।

ক্যালকুলাস, মাধ্যাকর্ষণ, আলোকবিদ্যা, স্থিতি ও গতিবিদ্যাসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিউটন যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন। জ্ঞানপিপাসু এই বিজ্ঞানী দিন–রাত নানা গবেষণায় মেতে থাকতেন। বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া তিনি নিজের ঘর থেকে খুব একটা বের হতেন না। গবেষণা কাজ করতে গিয়ে পারদের বিষক্রিয়ায় তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু তাঁর গবেষণাকাজ থামেনি।

চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২)

চার্লস ডারউইন এবং তাঁর প্রথম সন্তান উইলিয়াম ডারউইন
ছবি: সংগৃহীত

ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন তাঁর সময়ের অন্য সবাইকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন বিবর্তনবাদ তত্ত্ব দিয়ে। যাঁরা জীববিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের কাছে ডারউইন তত্ত্বের বিস্ময় খুব সহজে কাটার নয়। প্রকৃতির নানা রহস্য উন্মোচনের জন্য এইচএমএস বিগল নামের একটি জাহাজে চড়ে ১৮৩১ থেকে ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন ডারউইন। সেই অভিযানের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রাণী ও উদ্ভিদ পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সময়ে দুনিয়া কাঁপানো সব তত্ত্ব প্রকাশ করেন তিনি।

নিকোলা টেসলা (১৮৫৬-১৯৪৩)

নিকোলা টেসলা, তখন তাঁর বয়স ৩৪ বছর
ছবি: উইকিপিডিয়া

সার্বিয়ান-আমেরিকান উদ্ভাবক, যান্ত্রিক ও তড়িৎ প্রকৌশলী নিকোলা টেসলা বেশি খ্যাতি পেয়েছেন বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থায় এসি (অলটারনেটিং কারেন্ট) উদ্ভাবন করে। টেসলার পেটেন্ট ও তাত্ত্বিক কাজ তারহীন যোগাযোগ ও রেডিও উদ্ভাবনের ভিত তৈরি করে দিয়েছিল। টেসলা প্রথম বেতার নিয়ন্ত্রিত (আরসি) যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। সেটি ছিল একটি আরসি নৌকা। টেসলাই প্রথম ব্যক্তি, যিনি এক্স-রে ছবি তুলেছিলেন।

জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নিকোলা টেসলা নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের একটি হোটেলকক্ষে একাকী বাস করতেন। হঠাৎ হঠাৎ বাইরে বের হয়ে সংবাদমাধ্যমে অস্বাভাবিক বিবৃতি দিতেন। ১৮৫৬ সালে বর্তমান ক্রোয়েশিয়ায় জন্ম নেন সার্বীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন এই প্রকৌশলী। ১৯৪৩ সালের ৭ জানুয়ারি মারা যান নিকোলা টেসলা।

গ্যালিলিও গ্যালিলি

টেলিস্কোপ দিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গ্যালিলিও অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন
ছবি: প্রথম আলো

ইতালির প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ গ্যালিলিও গ্যালিলি। ১৬০৯ সালে একটি টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি চাঁদ পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। তখন থেকে মহাকাশ বিজ্ঞানে নতুন এক যুগের সূচনা হয়।

গ্যালিলিও–ই প্রথম বলেছিলেন, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে নয় বরং পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। তাঁর এই মতবাদ রোমান ক্যাথলিক বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় ১৬১৬ সালে রোমান ক্যাথলিক গির্জা গ্যালিলিওকে নিষিদ্ধ করে। শিক্ষকতায় তারা গ্যালিলিওকে নিষিদ্ধ করে। এমনকি তিনি যে মতবাদের কথা জানিয়েছেন (পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে), সেটার প্রচার চালাতে পারবেন না। ওই সময় ধারণা করা হতো, সৌরজগতের কেন্দ্রে থাকে পৃথিবী।

এ ছাড়া, গ্যালিলিও–ই প্রথম বলেছিলেন, চারটি বড় বড় চাঁদ বৃহস্পতিগ্রহ প্রদক্ষিণ করে। মহাকাশে ছায়াপথে যে ক্ষীণ আলো দেখা যায়, সেগুলো আসলে অসংখ্য দূরবর্তী নক্ষত্র থেকে নির্গত হচ্ছে। সূর্যের গায়ে সানস্পট বা কালোদাগ তিনিই প্রথম খুঁজে বের করেন।

অ্যাডা লাভলেস

অ্যাডা লাভলেস

ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের মেয়ে পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার অগাস্টা অ্যাডা বায়রন (পরবর্তী জীবনে অ্যাডা লাভলেস নামে পরিচিত)। কম্পিউটারের জনক চার্লস ব্যাবেজের সঙ্গে কাজ করেন অ্যাডা। তিনি ব্যাবজের ডিফারেন্স ইঞ্জিন ও অ্যানাটিক্যাল ইঞ্জিনের জন্য ‘কমেন্টস’ লিখতেন। অ্যাডা লাভলেস অ্যানাটিক্যাল ইঞ্জিনের জন্য প্রোগ্রামিং করেছেন। ১৮৫২ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যান এই বিজ্ঞানী।

পিথাগোরাস

পিথাগোরাসের আবক্ষ মূর্তি


দার্শনিক এবং সংখ্যাপাগল এক গণিতবিদ ছিলেন পিথাগোরাস। ‘পিথাগোরাস উপপাদ্যের’ কারণে তিনি জগৎজুড়ে বিখ্যাত। পিথাগোরাসের জন্ম গ্রিসের স্যামোস দ্বীপে হলেও তিনি জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে মিসর, ব্যাবিলন, ইতালিসহ অনেক দেশে ভ্রমণ করেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, সংখ্যাই এ মহাবিশ্বকে শাসন করে। বাস্তব জীবনের নানা রকমের বিষয়কে তিনি সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করতেন।
জ্ঞানচর্চার জন্য পিথাগোরাস গ্রিসে একটি দল তৈরি করেছিলেন, যাঁরা গণিত ও সংখ্যা নিয়ে কাজ করতেন। দলটির অন্যতম অর্জন ‘অমূলদ সংখ্যা’ সম্পর্কে জানা।

টমাস আলভা এডিসন

টমাস আলভা এডিসন
ছবি: উইকিমিডিয়া

আমেরিকার বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের হাত ধরে পৃথিবী বৈদ্যুতিক বাতির জগতে প্রবেশ করে। তিনি ফোনোগ্রাফ এবং চলমান ছবি তোলার ক্যামেরা ‘কাইনোটোস্কোপ’ আবিষ্কার করেন।

মার্কিন পেটেন্ট অফিস থেকে ১ হাজার ৯৩টি পেটেন্ট স্বত্ব টমাস আলভা এডিসনকে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য দেশ থেকেও পেয়েছেন অসংখ্য পেটেন্ট। এডিসনকে আমেরিকার ইতিহাস সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ উদ্ভাবক হিসেবে গণ্য করা হয়।

১০

রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন


রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন একজন প্রখ্যাত রসায়নবিদ এবং এক্স-রে স্পটিকবিদ। তাঁর নানা গবেষণা ডিএনএর গঠন ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর আবিষ্কার আধুনিক আণবিক জীববিজ্ঞানের ভিত গড়ে দিয়েছিল। যদিও জীবদ্দশায় তিনি নিজের কাজের স্বীকৃতি তেমন একটা পাননি। পরে জিনতত্ত্ব এবং আণবিক জীববিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের  জানার পরিধি বাড়াতে ফ্র্যাঙ্কলিনের অবদানকে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

তথ্যসূত্র: ডিসকভার ম্যাগাজিন, টাইমস অব ইন্ডিয়া