পৃথিবীর রহস্যময় ১০ জায়গা, যেগুলোর রহস্য আজও অজানা

পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে এমন কিছু স্থান, যেগুলোর রহস্য আজও মানুষের কল্পনা ও কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু। কোথাও হাজার বছরের পুরোনো পাথরের গোলকধাঁধা, কোথাও মরুভূমির বুকে জ্বলন্ত আগুনের গর্ত, কোথাও হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন শহর, আবার কোথাও আকাশ থেকে দেখা যায় বিশালাকৃতির রহস্যময় নকশা। এসব জায়গার প্রকৃত রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। গবেষকেরা নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন, পর্যটকেরাও ছুটে যাচ্ছেন কৌতূহল নিয়ে। তবু প্রতিবারই কিছু না কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়।

এমএসএনের এক প্রতিবেদনের আলোকে জেনে নেওয়া যাক এমনই ১০টি রহস্যময় জায়গার কথা, যেগুলোর ব্যাখ্যা আজও অধরা।

স্টোনহেঞ্জ

ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে অবস্থিত স্টোনহেঞ্জ
ছবি: রয়টার্স

পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শনগুলোর একটি স্টোনহেঞ্জ। ইংল্যান্ডের উইল্টশায়ারে অবস্থিত জায়গাটি খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার সালের কাছাকাছি সময়ে নির্মিত। এই বিশাল পাথরের বৃত্তটি এখনো রহস্যের মোড়কে ঘেরা।

বিভিন্ন গবেষণায় স্টোনহেঞ্জ সম্পর্কে নানা ধারণার কথা উঠে এসেছে। অনেকেরই বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য স্থাপনাটি ব্যবহার করা হতো। অনেকে মনে করেন, এটি ছিল একটি সৌর ক্যালেন্ডার। আবার অনেকের মতে, স্টোনহেঞ্জ আসলে ছিল একটি আকাশ পর্যবেক্ষণকেন্দ্র। কেউ কেউ মনে করেন, এটি একটি সমাধিক্ষেত্র। আবার অনেক গবেষক মনে করেন, ধর্মীয় কোনো স্থাপনার মতো এটিকে রাজনৈতিক স্থাপনা হিসেবেও বিবেচনা করা উচিত হবে।

২৫ টনের বেশি ওজনের পাথরগুলো প্রায় ২০০ মাইল দূর থেকে কীভাবে আনা হয়েছিল, সে রহস্য এখনো কেউ উদ্‌ঘাটন করতে পারেনি। সূর্যোদয়ের দিক অনুসরণ করে এর পাথরগুলোর অবস্থান, যা এর রহস্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বহু গবেষণার পরও এর প্রকৃত উদ্দেশ্য আজও অজানা।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল

পৃথিবীর রহস্যময় জায়গাগুলোর অন্যতম বারমুডা ট্রায়াঙ্গল। এটি মূলত আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিমাংশে ত্রিভুজাকৃতির একটি বিশেষ অঞ্চল, যা ‘ডেভিলস ট্রায়াঙ্গল’ নামেও পরিচিত। এর এক কোণে বারমুডা দ্বীপ আর অন্য দুই প্রান্তে মায়ামি বিচ ও পুয়ের্তে রিকোর সান হুয়ান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পাঁচটি টিভিএম অ্যাভেঞ্জার উড়োজাহাজ ও একটি উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ রহস্যজনকভাবে ওই এলাকায় উধাও হয়ে যায়। এর পর থেকেই শুরু হয় রহস্যের জাল বোনা। পরবর্তী সময়ে আরও বেশ কিছু জাহাজ ও উড়োজাহাজ সেখানে নিখোঁজ হয়েছে।

বিস্তৃত এ অঞ্চল নিয়ে অসংখ্য তত্ত্ব ও কল্পকাহিনি প্রচলিত আছে। ব্যাপক গবেষণার পরও এর রহস্য উন্মোচিত হয়নি। অবাক করার বিষয় হলো, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে নিখোঁজ হওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে পরিষ্কার আকাশ ও শান্ত সমুদ্রে, যা বিশেষজ্ঞদের হতবাক করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আজও এক অমীমাংসিত রহস্য।

ইস্টার দ্বীপ

চিলির ইস্টার দ্বীপের পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক মোয়াই মূর্তি
ছবি: রয়টার্স

রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার দুনিয়ায় চিলির ইস্টার দ্বীপ আলোচিত নাম। ইস্টার দ্বীপে প্রায় এক হাজার দণ্ডায়মান মূর্তি আছে। বিখ্যাত এসব মূর্তি ‘মোয়াই’ নামে পরিচিত। আগ্নেয় শিলায় খোদাই করা এই বিশাল আকৃতির মানব মূর্তিগুলো রাপা নুই জনগণের পূর্বপুরুষদের প্রতীক হিসেবে গড়া হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এই দ্বীপের আশপাশে সমুদ্রের নিচে অদ্ভুত সব প্রাণীর খোঁজ পাওয়া গেছে।

দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ইস্টার দ্বীপটি ‘রাপা নুই’ নামেও পরিচিত। সম্প্রতি দ্বীপটির আশপাশে সমুদ্রের নিচে অভিযান চালিয়ে ১৬০ প্রজাতির প্রাণীর খোঁজ পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের শ্মিডিচ ওশান ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি, খোঁজ পাওয়া প্রাণীগুলোর মধ্যে প্রায় ৫০টিই অজানা। এখানে গভীরতম সালোকসংশ্লেষণনির্ভর প্রাণীরও খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রাণীটির নাম লেপ্টোসারিস বা বলি প্রবাল। উড়ন্ত স্প্যাগেটি দানব বা বাথিফাইসা কনিফেরা উজ্জ্বল গভীর সমুদ্রের ড্রাগনফিশ নামের দুটো প্রাণীরও দেখা মিলেছে। ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ মিটার পানির নিচে একটি ডুবোপাহাড়ে এসব প্রাণীর বসবাস।

নাসকা লাইন

দক্ষিণ পেরুর মরুভূমিতে রহস্যময় নাসকা লাইন
ছবি: রয়টার্স

দক্ষিণ পেরুর মরুভূমিতে বিশাল আঁকিবুঁকির মতো কিছু রেখাচিত্রকে বলা হয় নাসকা লাইন। আকাশ থেকে দেখলে বোঝা যায়, এগুলো আদতে বিভিন্ন প্রাণী, গাছপালা ও জ্যামিতিক আকারে তৈরি করা বিশালাকার নকশা।

এগুলো কেন তৈরি হয়েছিল, তা আজও পরিষ্কার নয়। কেউ বলেন, এগুলো ছিল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অংশ, আবার কেউ মনে করেন, এগুলো মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হতো। ১ হাজার ২০০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত এসব নকশা এতটাই নিখুঁত ও বিশাল যে তা আজও গবেষক ও পর্যটকদের হতবাক করে।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, খরাপ্রবণ মরুভূমিতে কঠিন আবহওয়ার মধ্যেও হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই রেখাগুলো অক্ষত রয়েছে। রহস্যময় এই নকশাগুলো এখন বিশ্বের নানা প্রান্তের পর্যটক ও গবেষকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

গিজার পিরামিড

মিসরে গিজার মহাপিরামিড
ছবি: রয়টার্স

মিসরের গিজার মহাপিরামিড প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। এটির বেশির ভাগ আজও অক্ষত। ফারাও খুফুর সমাধি হিসেবে খ্রিষ্টপূর্ব ২ হাজার ৫৮০ থেকে ২ হাজার ৫৬০ সালের মধ্যে এটি তৈরি করা হয়েছিল। এর বিশাল কাঠামো যুগ যুগ ধরে মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে।

খ্রিষ্টপূর্ব ২৫৬০ সালের দিকে ফারাও খুফুর শাসনকালে স্মারক সমাধি হিসেবে পিরামিডটি নির্মিত হয়। এ পিরামিড ১৪৬ মিটার উঁচু। ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে আইফেল টাওয়ার নির্মিত হওয়ার আগপর্যন্ত এটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু অবকাঠামো।

এই পিরামিডের নিখুঁত নির্মাণশৈলী ও বিশালতা আজও মানুষের মনে কৌতূহল জাগায়। এটি তৈরিতে কী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল, তা এখনো অপার বিস্ময়। গবেষকেরা এখনো এর গোপন রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ডেভিলস সি

জাপানের মিয়াকে দ্বীপের কাছে অবস্থিত ডেভিলস সি বা ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গল। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতোই এখানে রহস্যজনকভাবে অনেক জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হয়ে গেছে।

এ এলাকা ঘিরে অনেক লোককথা ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। জাপানিজ পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এখানে এক ভয়ংকর ড্রাগন বাস করে, যার ক্ষুধা দূর করা একেবারেই সম্ভব নয়। তাই সে এখানে আসা জাহাজ ও মানুষ খেয়ে ফেলে। এখানে ডুবে যাওয়া একটি প্রাচীন সভ্যতার গল্পও শোনা যায়। ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গলের পানির নিচে আছে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। অনেকের মতে, আগ্নেয়গিরির কারণেই এখানে বিভিন্ন অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

তবে অনেক অনুসন্ধানের পরেও এই সমুদ্রাঞ্চলের প্রকৃত রহস্য অধরাই থেকে গেছে। প্রকৃতি আর রহস্যময় ঘটনার অদ্ভুত মিশেলই এ জায়গাকে পৃথিবীর অন্যতম রহস্যঘেরা স্থানগুলোর একটি হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছে।

হারানো নগরী আটলান্টিস

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর বর্ণনায় উঠে এসেছে একটি রহস্যময় সভ্যতার কথা, যার নাম আটলান্টিস। তাঁর মতে, এটি ছিল একটি শক্তিশালী ও উন্নত সমাজব্যবস্থা। ভয়াবহ দুর্যোগে নগরীটি সাগরে তলিয়ে গিয়েছিল।

আটলান্টিস কোথায় ছিল, তা নিয়ে নানা তত্ত্ব রয়েছে। কেউ বলেন, এটি ছিল ভূমধ্যসাগরে, আবার কেউ বলেন, দক্ষিণ মেরুতে। তবে এত গবেষণা ও অনুসন্ধানের পরেও এখনো এর কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ মেলেনি।

তবু এক হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি আর প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ আটলান্টিসের কল্পনা মানুষকে এখনো বিস্ময়ে মোহিত করে রাখে। ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় অধ্যায়গুলোর একটি হয়ে আছে এটি।

সেইলিং স্টোন

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ডেথ ভ্যালিতে রয়েছে এক অদ্ভুত প্রাকৃতিক রহস্য—সেইলিং স্টোনস। বিশাল এই পাথরগুলো নিজে থেকেই মরুভূমির শুকনো মাটির ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে, পেছনে রেখে যায় লম্বা দাগ।

পাথরের এই অদ্ভুত চলাচলের কারণ নিয়ে বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বিভ্রান্ত ছিলেন। কেউ বলেছিলেন, বরফ জমে, আবার কেউ বলেছিলেন, চুম্বকীয় টানের প্রভাবে পাথরগুলো নড়াচড়া করছে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বরফ আর হালকা বাতাসের মিলিত প্রভাবে কিছু নির্দিষ্ট পরিবেশে পাথরগুলো আসলেই পিছলে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত পাথরের এগিয়ে চলার সুনির্দিষ্ট কারণ পুরোপুরি জানা যায়নি।

মরুভূমির বুক চিরে এই পাথরগুলোর নীরব গতি যেন মাধ্যাকর্ষণকেই চ্যালেঞ্জ জানায়, আর দর্শকদের করে অবাক।

মোয়াই মূর্তি

মোয়াই মূর্তি
ছবি: রয়টার্স

চিলির ইস্টার দ্বীপের মোয়াই মূর্তিগুলো শুধু আকার আর নৈপুণ্যের জন্যই বিখ্যাত নয়, এগুলোর নির্মাণ ও পরিবহনের ইতিহাস নিয়ে রয়েছে ঢের রহস্য। আগ্নেয় শিলার তৈরি এই বিশালাকৃতির মূর্তিগুলোকে রাপা নুই জনগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।

তবে দ্বীপজুড়ে এত বড় মূর্তিগুলো কীভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। এই মূর্তিগুলোর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং রাপা নুই সমাজে তাদের ভূমিকা নিয়েও চলছে গবেষণা। প্রতিটি মোয়াই যেন দ্বীপটির ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী।

১০

নরকের দরজা

তুর্কমেনিস্তানে অবস্থিত ‘দারভাজা গ্যাস ক্র্যাটার’ বা নরকের দরজা
ছবি: এপি

তুর্কমেনিস্তানের দারভাজা নামের একটি এলাকায় রয়েছে বিশাল এক গর্ত। সেই গর্তে দিনরাত জ্বলে আগুন। ‘দারভাজা গ্যাস ক্র্যাটার’ নামের স্থানটি ‘নরকের দরজা’ নামে ব্যাপক পরিচিত। পর্যটকদের কাছে স্থানটি দারুণ জনপ্রিয়। জায়গাটি তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী থেকে প্রায় ২৬০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। গর্তটি ১৯০ ফুট প্রশস্ত ও ৭০ ফুট গভীর।

এটি মূলত একটি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র। ১৯৭১ সালে এটি ধসে পড়ে তৈরি হয় এক বিশাল গর্ত। মিথেন গ্যাসের বিস্তার ঠেকাতে বিজ্ঞানীরা তখন গর্তটিতে আগুন ধরিয়ে দেন। ধারণা করা হয়েছিল, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আগুন নিভে যাবে। কিন্তু ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে মরুভূমির মাঝখানে জ্বলছে সেই গর্ত।

রাতের আঁধারে জ্বলন্ত এই গর্ত যেন এক অগ্নিময় প্রদর্শনী হয়ে ওঠে। এর রহস্যময় উৎপত্তি ও ভয়ংকর দৃশ্য এটিকে বিশ্বের অন্যতম অদ্ভুত স্থান হিসেবে পরিচিত করেছে। মানুষের হস্তক্ষেপ কীভাবে প্রকৃতিকে উল্টে দিতে পারে, তারই এক জীবন্ত প্রমাণ এই নরকের দরজা।