যেসব নিয়ম মেনে ৮৭ বছর বয়সেও ‘দিব্যি’ আছেন ইভান

ইভান কাপান
ছবি: সংগৃহীত

‘আমার বাসার পেছনে দুটি কচ্ছপ ছিল। সেগুলোকে খাবার দিতাম। কচ্ছপগুলো আমার জানালার নিচ পর্যন্ত চলে আসত। এখন সেগুলো নেই। জানি না কোথায় চলে গেছে।’ কথাগুলো বলছিলেন ৮৭ বছর বয়সী ইভান কাপান।

ইভানের বাড়ি ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগরেবে। একসময় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেছেন। এখন অবসরে আছেন। তাঁর জীবন চলছে পেনশনের অর্থে। কচ্ছপগুলো চলে যাওয়ার পর তিনি বাসার আশপাশে থাকা পাখিগুলোকে খাবার দেন। পালছেন দুটি বিড়ালও।

বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলাও করেন ইভান। তবে তাঁদের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। ইভান বললেন, একসময় মাঠে তাঁরা ৩০ জন খেলাধুলা করতেন। এখন মাত্র ১০ জন আছেন। অনেকেই মারা গেছেন।

ইভান থাকেন একটি বাড়ির বেজমেন্টে। জানালা দিয়ে বাড়ির একচিলতে উঠান দেখা যায়। সেখানে বসে কথা বলতে বলতে রুটির টুকরা বাইরে ছুড়ে দিচ্ছিলেন তিনি।

চোখের পলকে হাজির কয়েকটি পাখি। সেগুলো যখন রুটি খাচ্ছিল, তখন ইভানের চেহারায় আত্মতৃপ্তির ছায়া। বললেন, ‘তাদের জন্য একটু খাবার, আর আমার জন্য একটু।’

ক্রোয়েশিয়ার তোউঞ্জ গ্রামে ইভানের আদি বাড়ি। ১৯৬০ সালে জীবিকার টানে ৫০ কিলোমিটার দূরে জাগরেবে চলে আসেন তিনি। ইভান বললেন, ‘জাগরেব শহরের একটি বাজারে নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি পাই আমি। সেখানে ৩৮ বছর ধরে কাজ করেছি। আমার স্ত্রীও সেখানে কাজ করেছে।’

ইভানের স্ত্রী ১৯৯৪ সালে মারা যান। তাঁরা ৩৩ বছর এক ছাদের নিচে জীবন কাটিয়েছেন। এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই। বর্তমানে ইভান একা থাকেন। তাঁর বাসার আসবাবগুলোর বেশির ভাগই পুরোনো। কোনো কোনোটি তো প্রায় ৫০ বছর আগের। তবে সেগুলো দিয়ে দিব্যি কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি।

ইভানের দুটি পছন্দের কাজ রয়েছে। এগুলো তিনি কখনো বাদ দেন না। প্রথমটা হলো লটারির টিকিট কেনা। আর দ্বিতীয়টা, অনেক পুরোনো এক বান্ধবীর সঙ্গে কফি খেতে যাওয়া।

হিসাব করে খরচপাতি

২৫ বছর আগে চাকরি থেকে অবসরের পরপর ৪৪৮ ডলার করে পেনশন পেতেন ইভান। এখন পান ৫৩২ ডলার। অর্থাৎ পেনশন বেড়েছে ৮৪ ডলাার। একই সময়ে জীবনযাপনের খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। তবে এ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই ইভানের। বললেন, ‘পেনশনের অর্থ কমেনি, এটাই বড় কথা।’

ক্রোয়েশিয়ার জনসংখ্যা ৩৯ লাখ। এর মধ্যে ১২ লাখই পেনশনভোগী। আর বৃদ্ধদের মধ্যে ৩২ শতাংশ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আছেন। তবে ইভানের মতো যাঁরা শুধু নিজেদের পেনশনের ওপর ভর করে জীবন কাটান, তাঁরা রয়েছেন সবচেয়ে ঝুঁকিতে। এর মধ্যে করোনা মহামারি ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় সবকিছুর দাম বেড়ে আকাশ ছুঁয়েছে।

এখানেই বিপত্তির শেষ নয়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে কুনার বদলে ইউরোকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করছে ক্রোয়েশিয়া। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে। এমন সংকটের মুখে পেনশনভোগী মানুষের জন্য অনেক পণ্যই ভর্তুকি মূল্যে দিচ্ছে ক্রোয়েশিয়া সরকার। এরপরও দেশটির ৫০ শতাংশের বেশি পেনশনভোগী দারিদ্র্যের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন।

ইভানের পেনশন অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। এরপরও তাঁকে অনেক ভেবেচিন্তে খরচ করতে হয়। তিনি বললেন, ‘আমি মদ্যপান করি না, ধূমপান করি না, এমনকি দরকার ছাড়া কোনো খরচও করতে যাই না।’

নিয়ম মেনে চলা

প্রতিদিন নিয়মের বাইরে কিছু করেন না ইভান। সপ্তাহে মঙ্গল ও শুক্রবার—দুই দিন বাজার করেন। মাসজুড়ে যেসব সেবা নেন, তার বিল পরিশোধ করেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। ইভান বললেন, ‘আমার কোনো চিন্তা করতে হয় না। কারণ, সব অর্থ আমি সময়মতো পরিশোধ করি। কারও কাছে আমার কোনো দেনাও নেই।’
প্রতিদিন ভোরে একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠেন ইভান। ঘুমাতেও যান নিয়ম মেনে।

সকালে–বিকেলে নিয়ম মেনে হাঁটেন। সকালের নাশতায় আধা লিটার দুধের সঙ্গে ওটমিল মিশিয়ে পাউরুটি দিয়ে খান। রাতে খান দই আর পাউরুটি। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফলাহার করেন। সেখানে থাকে একটি কলা অথবা আপেল। আর সারা দিনে বিভিন্ন সময়ে দুই লিটার করে চা পান করেন। কয়েক দশক ধরে এভাবেই চলে আসছে।

নিয়ম মেনে চলার কারণে বয়সের তুলনায় ইভান বেশ সুস্থ। মাসে তাঁর মাত্র ২১ ডলারের ওষুধ লাগে। বছরে একবার করে পুরো শরীর পরীক্ষা করান তিনি। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলাও করেন। তবে তাঁদের সংখ্যা দিনে দিনে কমে আসছে। ইভান বললেন, একসময় মাঠে তাঁরা ৩০ জন খেলাধুলা করতেন। এখন মাত্র ১০ জন আছেন। অনেকেই মারা গেছেন। অনেকেই অসুস্থ। গত সপ্তাহেই দুজন মারা গেছেন।

তবে খেলাধুলার পেছনে সময় কমিয়ে দিয়েছেন ইভান। এখন বেশি ভালো লাগে ট্রামে করে শহরে ঘুরতে। জাগরেবে যাঁদের পেনশন ৫৩৬ ডলারের কম, তাঁদের কোনো পরিবহন খরচ দিতে হয় না। তবে ইভানের পেনশন এর চেয়ে সামান্য বেশি। তাই পুরো মাসের জন্য একবারে ১৪ ডলারের টিকিট কিনে নেন। ট্রামে ঘুরে ঘুরে পুরো শহরের মানুষ দেখেন তিনি, উপভোগ করেন তাঁদের জীবনযাপন।  

ছোট ছোট খুশি

ইভানের দুটি পছন্দের কাজ রয়েছে। এগুলো তিনি কখনো বাদ দেন না। প্রথমটা হলো লটারির টিকিট কেনা। আর দ্বিতীয়টা, অনেক পুরোনো এক বান্ধবীর সঙ্গে কফি খেতে যাওয়া। ইভান বললেন, ‘প্রতি রোববার আমরা একটি ক্যাফেতে কফি খেতে যাই। দুজন দুই কাপ করে। এটা ৯ বছর ধরে চলছে। আমি প্রথম দুই কাপের দাম দিই। সে দেয় পরের দুই কাপের। এভাবেই চলে আসছে।’

তবে একটি পছন্দের কাজ তালিকা থেকে বাদ দিতে হয়েছে ইভানকে। ডোনাট খাওয়া। এই খাবারটির দাম বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় গত বছরে ইভানের খরচ বেড়েছে ৫২ ডলার। বেশি খরচাটা হয় খাবার আর বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের বিল দিতে গিয়ে। বাড়তি আর কোনো খরচ না হলে মাস শেষে ১০–২০ ডলার থাকে তাঁর হাতে।

ইভানের জীবনটা শৃঙ্খলায় মোড়ানো। সব সমস্যার সমাধান করেন ঠান্ডা মাথায়। কখনো হাল ছাড়েন না। পাওয়া না পাওয়া নিয়ে হতাশাও নেই। জীবনের শুরু দিকটা ইভানের কেটেছে খুবই সাদামাটাভাবে। সেটা অভ্যাসটাই এখন অল্প পেনশনে বেঁচে থাকতে সবচেয়ে বড় সাহায্যটা করছে। এর মধ্যেও তিনি ছোট ছোট খুশি খুঁজে নেন, পাখিদের পেছনে খরচ করেন, লটারির টিকিট কেনেন, বান্ধবীর সঙ্গে কফি খেতে যান।

সবশেষে ইভান বললেন, ‘একটা কথা আছে না—আপনার যে কয়টা কম্বল আছে,  সে কয়টাই লাগে। আমি ওই কথাটা মেনে চলি। আর এভাবেই আমার পেনশনের অর্থে সব দরকার মেটাই।’