রুশ বন্দিশিবির থেকে ফেরা ইউক্রেনীয় কিশোরের বর্ণনায় যুদ্ধের বিভীষিকা

যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের হাজার হাজার শিশুকে রাশিয়ায় নেওয়া হয়েছে। তাদের একজন ডেভিড। যার সঙ্গে ছিল না কোনো অভিভাবক বা বন্ধু
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

২০২২ সালের ৪ এপ্রিল। ইউক্রেনের বন্দরনগরী মারিউপোল শহরটি চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলে রুশ বাহিনী। ওই অবস্থায় ১৬ বছরের কিশোর ডেভিড সেখান থেকে রাশিয়াগামী একটি বাস উঠে বসে। রুশ সেনারা তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সে রাশিয়ায় যেতে চায় কি না। জবাবে তাঁরা যা শুনতে চাইছিলেন, মাথা নেড়ে ছেলেটি তাই বলেছিল। বলেছিল,‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি রাশিয়ায় যেতে চাই। কারণ, ইউক্রেনে থেকে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। আমি ভেবেছি রাশিয়ায় যাব। সেখান থেকে বেলারুশ হয়ে বেরিয়ে যাব।’

কিন্তু যখন বাসটি গন্তব্য রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় একটি শহরে পৌঁছাল, তখন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাকে শিশুনিবাসে পাঠিয়ে দিল। কারণ, তার বয়স ১৮ হয়নি। তারা তার পাসপোর্ট কেড়ে নেয়। জানায়, ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত তাকে সেখানে থাকতে হবে।

যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের হাজার হাজার শিশুকে রাশিয়ায় নেওয়া হয়েছে। তাদের একজন ডেভিড। যার সঙ্গে ছিল না কোনো অভিভাবক বা বন্ধু। অন্যদিকে ইউক্রেনের এতিমখানাগুলোয় শিশুদের স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তবে কোথায় রাখা হয়েছে, তা জানা যায়নি।

রাশিয়ার নিজেদের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ইউক্রেন থেকে নিয়ে যাওয়া অন্তত ৪০০ শিশুকে রাশিয়ার বিভিন্ন পরিবার দত্তক নিয়েছে। ইউক্রেন বলছে, রাশিয়া জোরপূর্বক শিশুদের একটি দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর করছে, যা গণহত্যার শামিল।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার আগে ডেভিড মারিউপোলে তার মায়ের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন বন্ধুর বাড়িতে থাকতে শুরু করে সে। সেখানে সোফায় ঘুমাতে হতো তাকে। ডেভিড জানায়, তার মা খুব বেশি মদ পান করতেন। তাঁর কাছে সবকিছুর চেয়ে মদ কেনাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

রুশ আগ্রাসনের আগের রাতে ডেভিড তার দাদির সঙ্গে ছিল। সেখানে সে ৮ মার্চ পর্যন্ত ছিল। ডেভিড বলে, ‘১ মার্চের পর সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না। আমি বুঝলাম সব শেষ। শহরটি ততক্ষণে বিভক্ত। পূর্ব পারে (বাঁ) থাকা লোকজন সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য কয়েক দিন পেয়েছিল। আর আমি ছিলাম নদীর পশ্চিম পারে।’

রুশ আগ্রাসনের আগের রাতে ডেভিড তার দাদির সঙ্গে ছিল। সেখানে সে ৮ মার্চ পর্যন্ত ছিল। ডেভিড বলে, ‘১ মার্চের পর সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না। আমি বুঝলাম সব শেষ। শহরটি ততক্ষণে বিভক্ত। পূর্ব তীরে (বাঁ) থাকা লোকজন সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য কয়েক দিন পেয়েছিল। আর আমি ছিলাম নদীর পশ্চিম পারে।’

একটা সময় ডেভিডের মনটা মায়ের জন্য কেমন করে ওঠে। এরপর সে মায়ের সঙ্গে দেখা করবে বলে মনস্থির করে। কারণ, তার মনে হয়েছে, হয়তো মা তার জন্য অপেক্ষা করছে। তখন চারপাশে বোমা পড়ছিল। তারা (রাশিয়া) সবাইকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল।

ডেভিড মায়ের কাছে পৌঁছালে মা তাকে দেখে খুব খুশি হন। কিন্তু তত দিনে তার মা রুশপন্থী এক ব্যক্তির সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। ওই এলাকায় দুটি রেডিও স্টেশনের সম্প্রচার শোনা যেত। একটি ছিল ইউক্রেনপন্থী আর অন্যটি রুশপন্থী। ওই ব্যক্তির কারণে তখন মায়ের বাসায় রুশপন্থী রেডিও চ্যানেল চলছিল।

রাশিয়ার বিশিষ্ট টিভি উপস্থাপক ভ্লাদিমির সলোভিভের নাম উল্লেখ করে ডেভিড বলে, ‘আমি ঘুমাতে পারতাম না। তখন কোনোভাবে রাগ ধরে রাখতে পারতাম না। আমি জানতে চাইলাম কেন আমাদের ওই রেডিও শুনতে হবে।’

ডেভিডের মায়ের যুক্তি ছিল, তাঁরা রাশিয়ার রেডিও শোনেন, কারণ তারা সত্যিটা বলে। এরপর তিনি ছেলেকে ইউক্রেনীয় বলে অভিযুক্ত করতে থাকেন। পাশাপাশি নিজেকে রাশিয়ান বলে দাবি করেন। মায়ের এমন অবস্থানের পর ডেভিড দাদির কাছে ফিরে যায়। যাওয়ার পথে বিভিন্ন জায়গায় সে পচতে থাকা লাশ দেখেছে। যতক্ষণে সে দাদির কাছে পৌঁছায়, তত দিন তার দাদি বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

ডেভিডের মায়ের যুক্তি ছিল, তাঁরা রাশিয়ার রেডিও শোনেন, কারণ তারা সত্যিটা বলে। এরপর তিনি ছেলেকে ইউক্রেনীয় বলে অভিযুক্ত করতে থাকেন। পাশাপাশি নিজেকে রাশিয়ান বলে দাবি করেন। মায়ের এমন অবস্থানের পর ডেভিড দাদির কাছে ফিরে যায়। যাওয়ার পথে বিভিন্ন জায়গায় সে পচতে থাকা লাশ দেখেছে। যতক্ষণে সে দাদির কাছে পৌঁছায়, তত দিন তার দাদি বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

তত দিনে রুশ বাহিনী তার এলাকায় ঢুকে পড়ে। গান গাইতে গাইতে হাঁটার সময় পথে তাকে আটকান রুশ সেনারা। তারা তাকে অন্তর্বাস খুলতে বাধ্য করে এবং বেড়ার পেছনে তাকে দাঁড় করায়। গালি দিয়ে জানতে চায়, এখান দিয়ে ইউক্রেনের কোনো সেনাসদস্যকে যেতে দেখেছে কি না?
রুশ কর্তৃপক্ষ ওই এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিতে শুরু করে। তখন ডেভিড সেই সুযোগটি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাসে তার পাশে এক অল্প বয়সী নারী বসেছিলেন। যখন তাদের তল্লাশিচৌকি ও যাচাই–বাছাইপ্রক্রিয়ার মধ্য দিতে যেতে হয়েছে, তখন ওই নারী তার অভিভাবক হওয়ার ভান করেছিলেন। কিন্তু রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর ওই নারী বলেছেন, তিনি ডেভিডের দায়িত্ব নিতে পারবেন না। এরপর ডেভিডকে শিশুনিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।

ডেভিড বলে, শিশুনিবাসটি খুবই হতাশাজনক জায়গা। খাওয়ার সময়, বাইরে বের হওয়ার সময় ও ঘুমানোর সময় নির্দিষ্ট করা ছিল। সেখানে একা থাকা খুবই কষ্টকর। স্থানীয় স্কুলে তাকে দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়, যাতে সে রাশিয়ার ইতিহাস এবং রাশিয়ার পাঠ্যক্রমের নানা বিষয় জানতে পারে।
ডেভিড সেখানকার কর্মীদের বলেছিল, সে মারিউপোলে ফিরে যেতে চায়। সে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে, যেন এখান থেকে তাকে নিয়ে যায়। কিন্তু তার মা রাজি হননি।
ডেভিড এ সময় নিজের গানের জগতে ডুব দেয়। ডেভিড এই বয়সে মারিউপোলে একটি গির্জায় বেতনভুক্ত শিল্পী ছিল। মারিউপোলে তার সাবেক যুব ক্লাবের সংগঠকেরা রাশিয়ান স্বেচ্ছাসেবকদের একটি গোপন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তার কাছে মোবাইল ফোন পাঠায়। আলমারির মধ্যে বসে সে মোবাইলে দুটি গানের অ্যালবাম রেকর্ড করে। সে ইলেকট্রনিক মিউজিকের সঙ্গে ইউক্রেনের লোকসংগীত ও কবিতা মিশিয়ে গান তৈরি করে। অনলাইনে সেই অ্যালবাম আপলোড করে ডেভিড লিখেছে, ‘আশা করছি, যাঁরা লোকসংগীত পছন্দ করেন না, তাঁরাও মজা পাবেন। বর্তমানে আমি ইউক্রেনের জাতীয় কবির (তারাস) মতো নির্বাসনে আছি।’ ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী শিক্ষার কারণে রাশিয়ায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন তারাস।

ডেভিড তার ইউক্রেনপন্থী অবস্থান বিষয়ে সোচ্চার ছিল। রাশিয়ার আগ্রাসনের দুই দিন আগে ডেভিড তার বন্ধুদের সঙ্গে ইউক্রেনপন্থী বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল। সেখানে সে জাতীয় সংগীত গেয়েছিল। আগ্রাসনের তিন দিন পর রুশ বাহিনীর অবস্থান যখন শহরের কলমিয়াস নদীর পূর্ব তীরে, তখনো সে শহরের কেন্দ্রীয় চত্বরে আবারও জাতীয় সংগীত গেয়েছিল। তবে ডেভিডের এ মনোভাব তার আশপাশের বড়রা তেমন পছন্দ করতেন না। তাকে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দেওয়া হতো। একটি ছেলে তাকে মারধর করার হুমকি দিয়েছিল। ডেভিড বলে, ‘আমি তার হাতটি আমার মুখের কাছে নিয়ে বলেছিলাম, ঠিক আছে, মার।’

গত অক্টোবরের শুরুতে ডেভিড জানতে পেরেছিল যে তার মা তৃতীয় পক্ষকে অনুমতি দিলে তারা তাকে নিয়ে যেতে পারবে। সে বলে, এটা ছিল তার জন্য বুক থেকে পাথর সরে যাওয়ার মতো। কিন্তু শিশুনিবাসের কর্মীরা জানিয়েছিলেন, ‘তার মা তার প্রতি উদাসীন’ থাকায় তাঁরা তাকে এই সুযোগ দিতে পারছেন না।

পরে রাশিয়ান স্বেচ্ছাসেবকদের ওই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে (যারা ফোন সেটটি পৌঁছে দিয়েছিল) রাশিয়া থেকে ডেভিডকে বের করার জন্য একটি পরিকল্পনা করা হয়। একজন রাশিয়ান নারী স্বেচ্ছাসেবককে ডেভিডের অভিভাবকত্ব দেওয়ার জন্য তার মাকে মারিউপোলে গিয়ে নোটারি করতে রাজি করানো হয়।

ডেভিড বলে, ‘তারা আমাকে বিনা মূল্যে [ইউক্রেনে] ফিরিয়ে এনেছে।’ নোটারি হওয়ার পর দেশে ফেরা পর্যন্ত তার এক সপ্তাহের কম সময় লাগে। প্রতিটি ধাপে সে স্বেচ্ছাসেবকদের নতুন নতুন গ্রুপের সহযোগিতা পেয়েছে। ডেভিড এখন কিয়েভের একটি হোস্টেলে থাকছে। পরিকল্পনা করছে তৃতীয় অ্যালবাম রেকর্ড করার।

ডেভিড শিশুনিবাসে আট মাস কাটিয়েছে। এখানে থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ডেভিড তার সাবেক যুব ক্লাবের সংগঠকদের এবং রাশিয়ান স্বেচ্ছাসেবকদের গোপন নেটওয়ার্ক, যারা নির্বাসিত ইউক্রেনীয়দের রাশিয়া ছেড়ে যেতে ছায়ার মতো সাহায্য করছে, তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছে।