কোন ধরনের পেশা ঝুঁকিতে ফেলবে এআই, কোনটি থাকবে নিরাপদ
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারের কাঠামোকে আমূল বদলে দিতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সমর্থক ও সংশয়বাদী—উভয় পক্ষই একমত। আগে কর্মীরা যেসব কাজ করতেন, প্রযুক্তির ক্রমাগত অগ্রগতির ফলে সেসব কাজ এখন এআই অনায়াসে করতে সক্ষম হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, এআই ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১২ শতাংশ কর্মীকে স্থলাভিষিক্ত হওয়ার অর্জন করেছে, যা মজুরি হিসেবে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ক্রমেই এআই গবেষণা ও ব্যবহারনির্ভর হয়ে উঠছে। কিছু হিসাবে গত এক দশকে বেসরকারি খাতে এআই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলার। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও বেড়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এআই ও সংশ্লিষ্ট জ্বালানি খাতে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বিশ্বের শীর্ষ নেতা বানানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
তবে এ উদ্দীপনার বিপরীতে রয়েছে উদ্বেগও। অনেকের আশঙ্কা, এআই শ্রমবাজারে অভূতপূর্ব ধাক্কা দেবে। এতে একদিকে পুনরাবৃত্তিমূলক শ্রমভিত্তিক কাজ, অন্যদিকে নকশা ও কোডিংয়ের মতো উচ্চদক্ষ পেশাও ঝুঁকিতে পড়বে।
চলতি বছরে কর্মী ছাঁটাইয়ের যে ঢেউ যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে, তার সঙ্গেও এআইকে যুক্ত করা হচ্ছে। প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অ্যামাজন প্রায় ১৪ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেওয়ার সময় এআই প্রযুক্তির রূপান্তরকারী অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেছে।
কী জানা গেল
এমআইটির গবেষকেরা ‘আইসবার্গ ইনডেক্স’ নামে একটি সূচকের তথ্য ব্যবহার করেছেন, যা শ্রমবাজারে এআইয়ের প্রভাব বা ঝুঁকি পরিমাপের জন্য তৈরি হয়েছে। ৩ হাজার কাউন্টির ৯২৩টি পেশার অন্তর্ভুক্ত ১৫ কোটি ১০ লাখ কর্মী এবং ৩২ হাজারের বেশি দক্ষতা বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা অনুমান করেছেন, কত দ্রুত এআইয়ের সক্ষমতা মানুষের পেশাগত দক্ষতার সঙ্গে মিলে যেতে পারে।
তবে গবেষকেরা স্পষ্ট করেছেন, ১২ শতাংশের এই হিসাব হলো প্রযুক্তিগত উন্মুক্ততা, যেখানে এআই পেশাগত কাজ সম্পাদন করতে পারে। এটি সরাসরি চাকরি হারানোর ফলাফল নয়। বাস্তব শ্রমবাজারে এর প্রভাব নির্ভর করবে প্রতিষ্ঠানের কৌশল, কর্মীদের অভিযোজনক্ষমতা ও নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের ওপর।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমানে এআইয়ের ব্যবহার মূলত প্রযুক্তি খাতের পেশাগুলোতেই সীমাবদ্ধ, যা শ্রমবাজারের মোট মজুরি মূল্যের ২ দশমিক ২ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এআইয়ের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রশাসনিক কাজ পর্যন্ত বিস্তৃত, যা শ্রমবাজারের ১১ দশমিক ৭ শতাংশ অংশজুড়ে রয়েছে।
গবেষকেরা কয়েকটি বিস্তৃত খাত ও পেশাকে ‘এআই উন্মুক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। এর মধ্যে রয়েছে কম্পিউটিং ও প্রযুক্তি খাত। যেমন সফটওয়্যার প্রকৌশলী, ডেটা সায়েন্টিস্ট, বিশ্লেষক, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও সংশ্লিষ্ট পেশা—এসব খাতে বর্তমানে এআইয়ের ব্যবহার বেশি। বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ, যেমন আর্থিক বিশ্লেষণ ও প্রশাসনিক সমন্বয়। অর্থ, হিসাবরক্ষণ ও অনুরূপ ব্যবসায়িক সেবা খাত এবং পেশাগত সেবা খাত, যার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার প্রশাসনিক ক্ষেত্রও রয়েছে।
তবে গবেষণাটি কেবল প্রযুক্তিগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে প্রযুক্তির পরিপক্বতা ও ব্যবহারপদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, শারীরিক স্বয়ংক্রিয়তার (ফিজিক্যাল অটোমেশন) প্রভাব ভবিষ্যতে সক্ষমতা আরও বাড়লে শ্রমবাজারে ক্রমেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
এর আগে গত জুলাইয়ে মাইক্রোসফট প্রকাশিত এক গবেষণায় কোন কোন পেশায় এআই স্থলাভিষিক্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, সে বিষয়ে আরও বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল।
মাইক্রোসফট তাদের কো-পাইলট চ্যাটবটের সঙ্গে দুই লাখ ব্যবহারকারী কথোপকথনের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রতিটি পেশার জন্য একটি করে এআই প্রযোজ্যতা স্কোর নির্ধারণ করেছে এবং সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা পেশাগুলো চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো—
১. দোভাষী ও অনুবাদক
২. ইতিহাসবিদ
৩. যাত্রীর সহকারী
৪. সেবা খাতের বিক্রয় প্রতিনিধি
৫. লেখক ও সাহিত্যিক
৬. গ্রাহকসেবা প্রতিনিধি
৭. সিএনসি টুল প্রোগ্রামার
৮. টেলিফোন অপারেটর
৯. টিকিট এজেন্ট ও ট্রাভেল ক্লার্ক
১০. সম্প্রচার ঘোষক ও রেডিও ডিজে।
তবে মাইক্রোসফট যেসব পেশাকে আপাতত এআই থেকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ বলে উল্লেখ করেছে—
১. ফ্লেবোটোমিস্ট (রক্ত সংগ্রহকারী স্বাস্থ্যকর্মী)
২. নার্সিং সহকারী
৩. বিপজ্জনক বর্জ্য অপসারণ কর্মী
৪. সহকারী কর্মী-চিত্রকর, প্লাস্টারকার প্রভৃতি
৫. মৃতদেহ সংরক্ষণকারী (এম্বালমার)
৬. প্ল্যান্ট ও সিস্টেম অপারেটর
৭. মুখ ও চোয়ালের শল্যচিকিৎসক (ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন)
৮. অটোমোটিভ গ্লাস স্থাপন ও মেরামতকারী
৯. জাহাজ প্রকৌশলী (শিপ ইঞ্জিনিয়ার)
১০. টায়ার মেরামতকারী ও পরিবর্তনকারী।
অক্টোবরে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের এক প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, উদীয়মান প্রযুক্তি আগামী এক দশকে প্রায় ১০ কোটি মার্কিন চাকরি কেড়ে নিতে পারে। চ্যাটজিপিটির সহায়তায় করা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন ভারমন্টের ডেমোক্র্যাট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের দপ্তরের কর্মীরা। এতে সম্ভাব্য চাকরি স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মোট সংখ্যা ও শতকরা হারের ভিত্তিতে একটি তালিকাও দেওয়া হয়েছে।
১. ফাস্ট ফুড ও কাউন্টার কর্মী—৮৯ শতাংশ
২. গ্রাহকসেবা প্রতিনিধি—৮৩ শতাংশ
৩. শ্রমিক ও মালামাল ওঠানো-নামানোর কর্মী (হাতে বহনকারী)—৮১ শতাংশ
৪. খুচরা বিক্রয়কর্মী—৬২ শতাংশ
৫. স্টকার ও অর্ডার ফিলার—৭৬ শতাংশ
৬. ক্যাশিয়ার—৫৯ শতাংশ
৭. সাধারণ দপ্তর কেরানি—৬৬ শতাংশ
৮. সাধারণ ও পরিচালন ব্যবস্থাপক—৪৭ শতাংশ
৯. সেক্রেটারি ও প্রশাসনিক সহকারী (আইনি, চিকিৎসা ও নির্বাহী বাদে)—৮০ শতাংশ
১০. হোম হেলথ এইড—৪০ শতাংশ
১১. জ্যানিটার ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী (গৃহপরিচারিকা ও হাউসকিপিং ক্লিনার বাদে)—৬১ শতাংশ
১২. নিবন্ধিত নার্স—৪০ শতাংশ
১৩. বুককিপিং, হিসাবরক্ষণ ও অডিটিং ক্লার্ক—৭৬ শতাংশ
১৪. ওয়েটার ও ওয়েট্রেস—৫৩ শতাংশ
১৫. ভারী ও ট্রাক্টর-ট্রেলার ট্রাকচালক—৪৭ শতাংশ
১৬. হিসাবরক্ষক ও নিরীক্ষক—৬৪ শতাংশ
১৭. ব্যক্তিগত যত্ন সহকারী—২৫ শতাংশ
১৮. টিম অ্যাসেম্বলার—৬১ শতাংশ
১৯. সফটওয়্যার ডেভেলপার—৫৪ শতাংশ
২০. শিক্ষক সহকারী (প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক; বিশেষ শিক্ষা বাদে)—৬৫ শতাংশ
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
এমআইটির গবেষণার উপসংহারে বলা হয়, আইসবার্গ ইনডেক্স গুরুত্বপূর্ণ কর্মশক্তি–সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের জন্য পরিমাপযোগ্য তথ্য সরবরাহ করে। কোথায় প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করা হবে, কোন দক্ষতাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, অবকাঠামো ও মানবসম্পদের মধ্যে কীভাবে ভারসাম্য রাখা হবে—এসব তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। এটি শুধু প্রযুক্তি খাতে দৃশ্যমান ব্যাঘাতই নয়; বরং পর্দার আড়ালে ঘটে চলা বৃহত্তর রূপান্তরও তুলে ধরেছে। কাজকে নতুনভাবে গড়ে তোলার আগেই ঝুঁকি পরিমাপের মাধ্যমে এই সূচক রাজ্যগুলোকে প্রতিক্রিয়া দেখানোর বদলে আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে এবং এআইকে একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য রূপান্তরে পরিণত করেছে।
উদ্যোক্তা ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী অ্যান্ড্রু ইয়াং নিউজউইকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি নিয়মিত সিইওদের সঙ্গে কথা বলি এবং তাঁদের অনেকেই বলেন, বিশেষ করে এন্ট্রি লেভেলের কর্মীদের ক্ষেত্রে এআই প্রতিস্থাপন করছেন বলে তাঁরা কর্মী সংকোচন করছেন।’
অ্যান্ড্রু ইয়াং আরও বলেন, এআইয়ের আবির্ভাবের ফলে নেতিবাচক দিকের প্রতি এখনো যথেষ্ট মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না।
এরপর কী হতে পারে
শ্রমবাজারে এআই ব্যবহারের প্রভাব নিয়ে পূর্বাভাসগুলো তো এখনো ব্যাপক ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন, এর প্রভাব হবে গুণগত, অর্থাৎ ব্যাপক হারে চাকরি বিলুপ্তির পরিবর্তে কাজের ধরন বদলে যাবে। অন্যরা আবার আরও আশঙ্কাজনক পূর্বাভাস দিচ্ছেন।
উদাহরণ হিসেবে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে অনুমান করছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ পেশার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজ এআই সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। এর আগে তারা পূর্বাভাস দিয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ চাকরি স্বয়ংক্রিয় হতে পারে।
তথ্যসূত্র: নিউজউইক