বসবাসের সুবিধার জন্য মানুষ গড়ে তুলেছে শহর ও নগর। কালের পরিক্রমায় আধুনিক শহরে যোগ হয়েছে নানা ধরনের ও নকশার নজরকাড়া অবকাঠামো। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার এ যুগে বিভিন্ন দেশ পাল্লা দিয়ে গড়ে তুলছে আকাশচুম্বী ভবন। ভবনের কাঠামোও চোখধাঁধানো। এসব ভবন যেন একেকটি শহর, এমনকি দেশের চালচিত্র-চরিত্রকেই সংজ্ঞায়িত করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা দ্য কাউন্সিল অন টল বিল্ডিংস অ্যান্ড আরবান হ্যাবিট্যাট (সিটিবিইউএইচ) বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ১০ ভবন কোনগুলো ও এগুলো যেসব শহরে অবস্থিত, তার একটি তালিকা করেছে। ভবনগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক—
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন বুর্জ খলিফা। এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ে অবস্থিত। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের নামে ভবনটির নামকরণ করা। এটির উচ্চতা ৮২৮ মিটার (২ হাজার ৭১৭ ফুট)। ১৬০ তলা ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১০ সালে।
আইকনিক অবকাঠামোটির নকশা ইসলামিক স্থাপত্য থেকে অনুপ্রাণিত। ভবনটিতে আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট, অফিস ও হোটেল আছে। ভবনটিতে পর্যবেক্ষণতল (অবজারভেশন ডেক) আছে, যেখান থেকে শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়।
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবনের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মারদেকা ভবন। এটি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অবস্থিত। ২০২৩ সালে ভবনটির উদ্বোধন করা হয়। এটি পিএনবি ১১৮ নামেও পরিচিত। ভবনটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে উঁচু ভবন।
মারদেকা ১১৮ তলা ভবনের উচ্চতা ৬৭৯ মিটার (২ হাজার ২২৭ ফুট)। ভবনে রয়েছে হোটেল, থাকার জন্য সুসজ্জিত অ্যাপার্টমেন্ট ও অফিস। ভবনটির আধুনিক নকশায় ফুটে উঠেছে মালয়েশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। মালয় ভাষায় মারদেকা অর্থ স্বাধীনতা। মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি পারমোদালান ন্যাসিওনাল বেরহাদ (পিএনবি) প্রকল্পটির উন্নয়ন ও অর্থায়নে নেতৃত্ব দিয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবনের তালিকায় তৃতীয় স্থানে সাংহাই টাওয়ার। এটি চীনের সবচেয়ে উঁচু ভবন। সাংহাই শহরে অবস্থিত এ টাওয়ারের নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৫ সালে। ভবনটির উচ্চতা ৬৩২ মিটার (২ হাজার ৭৩ ফুট)। আইকনিক এ অট্টালিকার নকশা করেছে স্থাপত্যপ্রতিষ্ঠান গেনসলার।
১২৮ তলা এ ভবনে রয়েছে হোটেল ও অফিসের জন্য জায়গা। এ ছাড়া ছাদে রয়েছে অসাধারণ একটি বাগান। ভবনটির নকশা এমনভাবে করা, যা বাতাসের চাপ কমাতে সহায়তা করে। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্যবেক্ষণ স্থান ও দ্রুতগতির এলিভেটরের অবস্থানও এ ভবনে।
বিশ্বের চতুর্থ উঁচু ভবন সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত। এটির নাম মক্কা রয়্যাল ক্লক টাওয়ার। এ টাওয়ারের নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১২ সালে। ভবনটির উচ্চতা ৬০১ মিটার (১ হাজার ৯৭১ ফুট)।
১২০ তলা ভবনটি আবরাজ আল বাইত কমপ্লেক্সের অংশ। ভবনে রয়েছে হোটেল ও বিপণিকেন্দ্র। আছে একটি ক্লক টাওয়ার। কয়েক মাইল দূর থেকেও এ ক্লক টাওয়ার দেখা যায়। মক্কা নগরীতে পবিত্র হজ বা ওমরাহ পালন করতে আসা অনেক মুসল্লি এ দর্শনীয় স্থাপত্যটি পরিদর্শন করে থাকেন।
এ টাওয়ার মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় উঁচু ভবন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘড়িটির অবস্থানও এ ভবনে। মক্কা ক্লক রয়্যাল টাওয়ারের নকশা করেছে স্থাপত্যপ্রতিষ্ঠান দার আল হানদাসাহ শাইর অ্যান্ড পার্টনারস। হাজিদের থাকার জন্য ভবনটিতে আছে সাতটি হোটেল।
চীনের শেনজেন শহরে অবস্থিত দ্য পিং অ্যান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স সেন্টারের উচ্চতা ৫৯৯ মিটার (১ হাজার ৯৬৫ ফুট)। ১১৫ তলা ভবনটি এশিয়ার তৃতীয় ও বিশ্বের পঞ্চম উঁচু ভবন। ২০১৭ সালে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। আকাশচুম্বী এই ভবনে রয়েছে অফিস, হোটেল ও খুচরা পণ্য বিক্রির জায়গা।
মসৃণ-চকচকে নকশার পাশাপাশি এলইডি আলোকসজ্জা ভবনটিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত তুলেছে। স্থাপত্যপ্রতিষ্ঠান কোহন পেডারসেন ফক্স অ্যাসোসিয়েটসের নকশা করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের লোটে ওয়ার্ল্ড টাওয়ার উচ্চতার দিক দিয়ে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। এটি চালু হয় ২০১৭ সালে। ভবনটির উচ্চতা ৫৫৫ মিটার (১ হাজার ৮১৯ ফুট)। এটি ১২৩ তলার একটি ভবন। দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে উঁচু ও বিশ্বের ষষ্ঠ উঁচু ভবনও এটি। এ ভবনেরও নকশা করেছে স্থাপত্যপ্রতিষ্ঠান কোহন পেডারসেন ফক্স অ্যাসোসিয়েটস।
ভবনে রয়েছে খুচরা পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জায়গা, অভিজাত হোটেল ও আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট। ভবনটিতে পর্যবেক্ষণতল আছে, যেখান থেকে সিউল শহর দেখা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বিশ্বের সপ্তম উঁচু ভবন। এটির উচ্চতা ৫৪১ মিটার (১ হাজার ৭৭৬ ফুট)। ভবনটি ৯৪ তলার। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (৯/১১) সন্ত্রাসী হামলায় বিধ্বস্ত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার।
এটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৪ সালে। কোনো ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর একটি প্রতীক হিসেবেও দেখা হয় ভবনটিকে।
স্থাপত্যপ্রতিষ্ঠান স্কিডমোর, ওয়িংস অ্যান্ড মেরিলের স্থপতি ডেভিড চাইল্ডস এ ভবনের নকশা করেছেন। এ ভবনে জাতীয় সেপ্টেম্বর ১১ স্মারক ও জাদুঘর আছে। আছে অফিস, থাকার জায়গা ও পর্যবেক্ষণতল।
গুয়াংজু সিটিএফ ফিন্যান্স সেন্টার উচ্চতার দিক থেকে অষ্টম অবস্থানে। এটি চীনের গুয়াংজু শহরে অবস্থিত। আকাশচুম্বী ভবনটির উচ্চতা ৫৩০ মিটার (১ হাজার ৭৩৯ ফুট)। ১১১ তলা ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৬ সালে। চীনের তৃতীয় উঁচু ভবন এটি।
স্থাপত্যপ্রতিষ্ঠান কোহন পেডারসেন ফক্স অ্যাসোসিয়েটস এটির নকশা করেছে। এ ভবনে অফিস, হোটেল ও অ্যাপার্টমেন্ট আছে। চমৎকার নকশার ভবনটি গুয়াংজু শহরের আধুনিকতাকে ফুটিয়ে তোলে।
অবাক করা বিষয় হলো, বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবনের তালিকায় ৮ ও ৯ নম্বরে থাকা ভবন দুটি সমানে সমান। তিয়ানজিং সিটিএফ ফিন্যান্স সেন্টার ও গুয়াংজু সিটিএফ ফিন্যান্স সেন্টার—দুটিরই উচ্চতা ৫৩০ মিটার। তবে তিয়ানজিং সিটিএফ ফিন্যান্স সেন্টার ৯৭ তলার। আর গুয়াংজু সিটিএফ ফিন্যান্স সেন্টারে আছে ১১১ তলা।
২০১৯ সালে তিয়ানজিং সিটিএফ ফিন্যান্স সেন্টারের নির্মাণকাজ শেষ হয়। এটির স্থাপত্যপ্রতিষ্ঠান রোনাল্ড লু অ্যান্ড পার্টনার। স্কিডমোর ও ওয়িংস অ্যান্ড মেরিল যৌথভাবে এর নকশা করেছে। ভবনে আছে অফিসের জায়গা, বিলাসবহুল পরিষেবাযুক্ত অ্যাপার্টমেন্ট ও একটি হোটেল।
চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে সিআইটিআইসি টাওয়ার অবস্থিত। চীন জুন টাওয়ার নামেও পরিচিত এটি। ভবনটির উচ্চতা ৫২৮ মিটার (১ হাজার ৭৩১ ফুট)। ১০৯ তলা ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৮ সালে। বেইজিংয়ের সবচেয়ে উঁচু এ ভবন মূলত অফিস ভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ভবনটির নকশা অনন্য। নকশায় ঐতিহ্যগত চীনা স্থাপত্যের উপাদান রয়েছে। ভবনটি বেইজিংয়ের আধুনিক উন্নয়নকে প্রতিফলিত করে। স্থাপত্যপ্রতিষ্ঠান কোহন পেডারসেন ফক্স অ্যাসোসিয়েটস এটির নকশা করেছে। প্রাচীন চীনা জাহাজ ‘জুন’-এর আদলে এর নকশা করা হয়েছে।