মধ্যপ্রাচ্যে গত এক বছরে চরম বিপদের অনেক মুহূর্ত এসেছে; কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটি সবচেয়ে খারাপ। গত সাত দিনের মধ্যে লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহ খুন হয়েছেন। লেবাননে স্থল হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। ইরান প্রায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে ইসরায়েলে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো উত্তেজনা কমানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ দ্রুত সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭–এর পক্ষ থেকে সব পক্ষকে ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে মধ্যপ্রাচ্য সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। গত এক সপ্তাহে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার কারণে মূলত এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
শুক্রবার সন্ধ্যা: নাসরুল্লাহকে হত্যা
লেবাননের বৈরুতে গত ২৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ইসরায়েল বোমা হামলা চালায়। সেখানে ব্যাপক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। অনেকগুলো আবাসিক ভবন ধসে পড়ে। মাটিতে বড় গর্ত সৃষ্টি হয়। আকাশ ধুলাবালি ও ধোঁয়ায় ভরে ওঠে। পুরো লেবানন থেকে ওই দৃশ্য দেখা যায়। এ হামলা হয় মাটির নিচে থাকা হিজবুল্লাহর বাংকার লক্ষ্য করে। এ হামলায় নিহত হন হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ। ইসরায়েলের এক সপ্তাহ ধরে চালানো হামলায় ৫০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার পর নাসরুল্লাহর মৃত্যুর খবর আসে। এর আগে হিজবুল্লাহর সদস্যদের লক্ষ্য করে চালানো হামলায় তাদের যোগাযোগে ব্যবহৃত পেজার ও ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। নাসরুল্লাহর নিহত হওয়ায় ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা মুছে যায়, যা কয়েক ঘণ্টা আগেও সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছিল।
এর আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মূল আলোচনার বাইরে ২১ দিনের যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলছিল। জাতিসংঘে ইসরায়েলের দূত ড্যানি ড্যানন বলেছিলেন, তারা যেকোনো ধারণা নিয়ে আলোচনার জন্য পথ খোলা রেখেছেন; কিন্তু লেবাননে হামলার পর দ্রুত নিউইয়র্ক ছাড়েন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। এতে সব ধরনের কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়।
সোমবার রাত: লেবাননে ঢুকে পড়ে ইসরায়েল
নাসরুল্লাহকে হত্যার তিন দিন যেতে না যেতেই ইসরায়েলি সেনারা লেবাননের সীমান্ত অতিক্রম করে হামলা শুরু করেন। একে তারা প্রথমে সীমিত আকারে স্থল অভিযান হিসেবে ঘোষণা দেয়। তারা দাবি করে, হিজবুল্লাহর রকেট ও ড্রোন হামলা বন্ধে তারা এ অভিযান চালাচ্ছে।
বর্তমানে ইসরায়েলি সেনারা একই সঙ্গে দুই স্থানে স্থল হামলা করছে। এর মধ্যে আগে থেকেই গাজায় হামলা চালিয়ে আসছিল। নতুন করে এবার লেবাননে হামলা শুরু হলো। কয়েক দশকের মধ্যে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। এর আগে সর্বশেষ ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে লড়াই করেছিল ইসরায়েল; কিন্তু ওই লড়াইয়ে কোনো মীমাংসা হয়নি। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী দক্ষিণ লেবানন থেকে সেনা প্রত্যাহার করে হিজবুল্লাহ। এরপর ইরানের সমর্থনে হিজবুল্লাহ আরও শক্তি সঞ্চয় করে। গাজা থেকে হামাসকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিলেও লেবানন থেকে হিজবুল্লাহকে সরানো নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি ইসরায়েল। এর পরিবর্তে তারা সীমিত লক্ষ্যবস্তুতে হামলার কথা বলেছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা: ইসরায়েলে ইরানের হামলা
লেবাননে ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরুর পরের দিনই স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটার দিকে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে ইরান। এতে ইসরায়েলের এক কোটি মানুষকে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে হয়। ইরান এ হামলায় প্রায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে। হামলার পরপরই ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা সক্রিয় হয়। তাদের যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সহযোগিতা করে। এতে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আরও জোরদার হয়। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী (আইডিএফ) দাবি করে, ইরানের অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করা হয়; কিন্তু অল্প কয়েকটি মধ্য ও দক্ষিণ ইসরায়েলে আঘাত হানে। এতে পশ্চিম তীরে এক ফিলিস্তিনি নিহত হন।
ইরানের সবচেয়ে বড় প্রক্সি গ্রুপ হিসেবে পরিচিত হিজবুল্লাহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রতিরোধ হিসেবে ইরানকে কিছু করে দেখাতে হতো। এ উদ্দেশ্য থেকেই হামলা চালায় তেহরান। এর আগে গত এপ্রিল মাসেও ইসরায়েলে ৩০০ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছিল ইরান। তবে এবারের হামলা ছিল আগের চেয়েও শক্তিশালী।
এবার আগেভাগে তথ্য জানায়নি ইরান। এ ছাড়া দ্রুতগতির ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। তবে হামলার বিষয়টি ক্ষমতার প্রদর্শন হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাই এটি সর্বাত্মক লড়াইয়ের জন্য ইরানের আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে না। ইরান জানে, সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে তারা কুলিয়ে উঠতে পারবে না। ইসরায়েলের পাশে রয়েছে পশ্চিমা মিত্ররা। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ পশ্চিমাদের সমর্থন দেবে। এতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র তারা ভূপাতিত করতে সক্ষম হবে।
বর্তমানে ইরান সরকারের অর্থনীতি নাজুক। সেখানকার সরকারের জনপ্রিয়তায় ঘাটতি রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলে ইরানের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসার মতো মিত্রও নেই।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি গত শুক্রবার অনমনীয় থাকার কথা বলেছেন। তবে ইরান জানে, তারা উত্তেজনা বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারবে না।
এরপর কী?
হিজবুল্লাহর ব্যাপক ক্ষতি সত্ত্বেও তারা লেবাননে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস বলে, লেবাননে ইসরায়েলের জন্য ঢোকা সহজ; কিন্তু বেরিয়ে আসা কঠিন।
এদিকে ইরানের হামলার জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু কীভাবে এর জবাব দেবেন, সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক ও তেল স্থাপনাগুলোয় হামলা নিরুৎসাহিত করেছেন তিনি। তবে ইসরায়েলে বলেছে, তারা এসব স্থানে হামলা হবে না এমন কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছে না।
ইরান নিয়ে যেকোনো সময় প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে ইসরায়েল। তবে নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক মন্তব্যে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি ইরানের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছেন।
ইসরায়েলের তাৎক্ষণিক লক্ষ্যবস্তু অবশ্য হাতের কাছেই রয়েছে। তা হচ্ছে, গাজায় সম্পূর্ণ জয় অর্জন করা এবং হিজবুল্লাহর কাছ থেকে আসা হুমকি সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
ইসরায়েলের অন্য নেতারা বলছেন, তাঁরা বহুমুখী যুদ্ধ জড়িয়ে গেছেন। নেতানিয়াহু বলছেন, তাঁরা সাতটি স্থানে যুদ্ধ চালাচ্ছেন। এগুলো হলো গাজা, লেবানন, পশ্চিম তীর, ইয়েমেন, ইরান, ইরাক ও সিরিয়া।
ইসরায়েলের জন্য এটা সত্য যে সব দিক থেকেই তাদের ওপর হামলা আসছে। তবে ইরাক ও সিরিয়া থেকে আসা হুমকি এখনো ততটা মারাত্মক নয়।