এমফিল ডিগ্রিধারী নারী শারি কেন আত্মঘাতী

শারি বালোচ
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গত মঙ্গলবার আত্মঘাতী বোমা হামলায় চারজন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনই চীনা নাগরিক। হামলার এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। এ আলোচনার মূলে রয়েছে একটি বিষয়। আর তা হলো হামলাটি চালিয়েছেন এক নারী। আত্মঘাতী হামলাকারী এই নারীর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন।

হামলাকারী নারীর নাম বলা হচ্ছে শারি বালোচ। তাঁকে নিষিদ্ধঘোষিত বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির (বিএলএ) মাজিদ ব্রিগেডের সদস্য বলা হচ্ছে। হামলার দায় স্বীকার করেছে বিএলএ। বিএলএর দাবি সত্যি হলে এটা হবে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো সংগঠনের প্রথম নারী আত্মঘাতী হামলা।

শারি বালোচ নামের ৩০ বছর বয়সী এই নারী বারামশ হিসেবেও পরিচিত। তাঁর পারিবারিক ইতিহাস ও শিক্ষাদীক্ষার রেকর্ড সবাইকে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করছে।

হামলার ১০ ঘণ্টা আগে নিজের টুইটারে ‘বিদায়ী বার্তা’ পোস্ট করেন শারি বালোচ। তখনো কেউ বুঝতে পারেননি যে তিনি ঠিক কী করতে যাচ্ছেন।

অশান্ত বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদে ইন্ধন জোগানো বা অর্থায়ন নতুন কোনো ঘটনা নয়। এ ধরনের ঘটনা প্রদেশটিতে ঘটে আসছে। তবে আত্মঘাতী নারী বোমা হামলাকারী শারি বালোচের অতীত রেকর্ড কিছু গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। রাতারাতি প্ররোচনা কিংবা আকস্মিক আহ্বান থেকে এ হামলার ঘটনা ঘটেনি; বরং এ হামলাকে সম্ভাব্য সব উপায়ের মাধ্যমে সংঘটিত একটি সুচিন্তিত কাজ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

শারি বালোচের মনস্তত্ত্ব

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে সক্রিয় ছিলেন শারি বালোচ। টুইটারে করা পোস্ট থেকে তাঁর মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

২৪ এপ্রিল এক টুইটে শারি বালোচ লেখেন, ‘আমার ভূমি আমাকে দুটি বিষয় শিখিয়েছে—ভালোবাসা ও প্রতিরোধ।’

জামাল বালোচের একটি পোস্ট ২ মার্চ রিটুইট করেন শারি বালোচ। এতে লেখা ছিল, ‘প্রতিরোধই আমাদের সংস্কৃতি, তা উদ্যাপন করতে চাইলে প্রতিরোধ করুন।’

গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর শারি বালোচ বিজয়চিহ্নের একটি ছবি পোস্ট করেন। ছবির ক্যাপশনে তিনি লেখেন, ‘আমি এমন একটি গল্প নই, যা চিরকাল থাকবে। আমি আমার দায়িত্ব পালন করব এবং বিদায় নেব।’

একই মাসে আগেও অন্তত দুবার একই পোস্ট দিয়েছিলেন শারি বালোচ।

গত ১৩ ডিসেম্বর বিজয়চিহ্ন পোস্ট করে শারি বালোচ লেখেন, ‘একটি ভালো আগামীর জন্য বলিদান...।’

গত ৮ ডিসেম্বর মার্কিন সাহিত্যিক উরসুল কে লে গুইনের একটি উদ্ধৃতি পোস্ট করেন শারি বালোচ। এতে লেখা ছিল ‘তুমি বিপ্লব কিনতে পারবে না। তুমি বিপ্লব তৈরি করতে পারবে না। তুমিই কেবল বিপ্লব হয়ে উঠতে পারো। এটি তোমার আত্মায় আছে, অথবা তা কোথাও নেই।’

এমফিল ডিগ্রিধারী শিক্ষিকা

বেলুচিস্তানে নিজ জেলা কেচে একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন শারি বালোচ। তিনি ২০১৪ সালে বিএড ও ২০১৮ সালে এমএড সম্পন্ন করেন।

শারি বালোচ বেলুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় মাস্টার্স করেন। পরে আল্লামা ইকবাল ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে সম্পন্ন করেন এমফিল ডিগ্রি।

গত ছয় মাস স্কুলে পাঠদানে অনুপস্থিত ছিলেন শারি বালোচ। এ জন্য জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এ নোটিশের কোনো জবাব দেননি।

শারি বালোচ দুই সন্তান রেখে গেছেন—একটি ছেলে, একটি মেয়ে। তাদের বয়স পাঁচ বছরের মধ্যে।

শারি বালোচের স্বামী হায়বাতান বালোচ একজন দন্তচিকিৎসক। তিনি স্থানীয় মাকরান মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক।

শারি বালোচের বাবা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিচালকের পদে ছিলেন। পরে তিনি জেলা পরিষদের সদস্য হিসেবে তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন। শারি বালোচের বোনের স্বামী একজন প্রভাষক। তাঁর এক চাচা লেখক, সাবেক অধ্যাপক ও মানবাধিকারকর্মী।

উচ্চশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তান শারি বালোচ। বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে অতীতে এই পরিবারের কোনো সদস্যের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।

ঠিক কোন বিষয়টি শারি বালোচকে বিচ্ছিন্নতাবাদে যুক্ত হতে প্ররোচিত করেছে, তা বলা মুশকিল। অবশ্য শিক্ষাজীবনে তিনি বেলুচ ছাত্রসংগঠনের (বিএসও-আজাদ) সদস্য ছিলেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শারি বালোচের পরিবারের কোনো সদস্য নিখোঁজ বা গুমের শিকার হননি। অবশ্য ২০১৮ সালে কেচ জেলায় এক সামরিক অভিযানে তাঁর দূরসম্পর্কের এক কাজিন নিহত হন।

শারি বালোচের টুইটগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। টুইটে তিনি চে গুয়েভারা, জ্যঁ জ্যাক রুশোর মতো ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি ব্যবহার করতেন।

এ ছাড়া দান্তে আলিগিয়েরি, মার্ক টোয়েন, রবার্ট আ হাইনলাইন, পাওলো কোয়েলহোর মতো ক্ল্যাসিক ও আধুনিক লেখকদের উদ্ধৃতিও ব্যবহার করতেন শারি বালোচ।

গত ৩০ ডিসেম্বর এক টুইটে শারি বালোচ লেখেন, ‘বই ছাড়া একটি কক্ষ আত্মাহীন শরীরের মতো।’

দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আত্মঘাতী হামলায় একজন নারীকে কাজে লাগানোর কৌশল কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ প্রশ্নগুলো হলো—বেলুচ বিদ্রোহ কি নিজেকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে? এ ধরনের হামলায় এখন কেন নারীকে ব্যবহার করা হলো? আগে কেন করা হয়নি? এই নারীদের কি মগজধোলাই করা হয়েছে? নাকি জোর করা হয়েছে?

আরও পড়ুন