ফিরে দেখা
পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জিয়ার উড়োজাহাজে কী হয়েছিল
পাকিস্তানের সেনাশাসক মুহাম্মদ জিয়া-উল-হক ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট উড়োজাহাজ ‘বিধ্বস্ত’ হয়ে নিহত হন। রহস্যঘেরা ঘটনাটি নিয়ে ২০২৪ সালের ১৭ আগস্ট প্রথম আলো অনলাইনের ‘ফিরে দেখা’ সিরিজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ বছরের একই দিনে প্রতিবেদনটির পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হলো।
মুহাম্মদ জিয়া-উল-হককে নিজের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ভেবেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। এ বিশ্বাস থেকে তিনি জিয়াকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। ভুট্টোর বিশ্বাসের মর্যাদা অবশ্য রাখেননি জেনারেল জিয়া। সেনাপ্রধান হওয়ার মাত্র এক বছরের মাথায় জিয়া তাঁরই নিয়োগকর্তা ভুট্টোকে নাটকীয়ভাবে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
রক্তপাতহীন কয়েক ঘণ্টার সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বিতর্কিত বিচারের মাধ্যমে ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলান জিয়া। প্রতাপশালী সেনাশাসক জিয়ার নিজের জীবনও স্বাভাবিকভাবে শেষ হয়নি। এক ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে তাঁর জীবন ও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। সামরিক উড়োজাহাজ ‘বিধ্বস্ত’ হয়ে তিনি নিহত হন। ঘটনাটি এখনো রহস্যঘেরা।
সাতজনকে ডিঙিয়ে সেনাপ্রধান
জিয়ার জন্ম ১৯২৪ সালের ১২ আগস্ট, ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের জলন্ধরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর জন্মস্থানের এলাকাটি এখন ভারতের অন্তর্ভুক্ত।
বাবা মুহাম্মদ আকবর আলী। তিনি অবিভক্ত ভারতের দিল্লিতে আর্মি জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে কাজ করেছেন। জিয়ার স্কুল-কলেজের শিক্ষা সিমলায়। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট স্টিফেন’স কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে বিএ পাস করেন। এরপর দেরাদুনের রয়্যাল ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন লাভ করেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন জিয়া। যুদ্ধকালে ১৯৪৫ সালে তৎকালীন বার্মা, মালায় ও ইন্দোনেশিয়ায় দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর জিয়ার পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। একই বছর তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।
১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন জিয়া। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় তিনি ১০১ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অ্যাসিস্ট্যান্ট কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন।
পরে ব্রিগেডিয়ার পদে থাকাকালে জিয়া ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জর্ডানে পাকিস্তানের সামরিক প্রশিক্ষণ মিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় তিনি ডেপুটি ডিভিশন কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭৫ সালে জিয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল হন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চরিত্র জানতেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো। তাই সব সময় সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় থাকতেন। এ আশঙ্কা থেকে নানান প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন। যেমন সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে সংবিধানে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধসহ একাধিক অনুচ্ছেদ-বিধিমালা যুক্ত করা, অবাধ্য বা সম্ভাব্য অবাধ্য সামরিক কর্মকর্তাদের অপসারণ ও নিজস্ব পছন্দের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি।
এ ছাড়া ভুট্টো সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষাকবচ হিসেবে এফএসএফ নামের একটি শক্তিশালী আধা সামরিক বাহিনী গঠন করেছিলেন। একপর্যায়ে এফএসএফ হয়ে ওঠে ভুট্টোর ব্যক্তিগত পেটোয়া বাহিনী। এ বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১৯৭৬ সাল নাগাদ ১৮ হাজারে পৌঁছে গিয়েছিল। এই পটভূমিতে এফএসএফকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে সশস্ত্র বাহিনী। এ নিয়ে ভুট্টোর প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর সন্দেহ, অবিশ্বাস বেড়ে যায়।
তবে এই সন্দেহবাদীদের দলে অন্তত প্রকাশ্যে ছিলেন না জিয়া। তিনি বরং নানাভাবে ভুট্টোর ঘনিষ্ঠ হন, আস্থা অর্জন করেন। ফলে সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা নির্মূলে বসানো সামরিক আদালতের প্রধান হয়ে ভুট্টোর স্বার্থে কাজও করেন জিয়া।
১৯৭৬ সালে সেনাপ্রধান টিক্কা খানের উত্তরসূরি নির্বাচনের সময় অনেক হিসাব-নিকাশ করে জিয়াকেই বেছে নেন ভুট্টো। সাতজন জ্যেষ্ঠ লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে ডিঙিয়ে জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়। তাঁকে সেনাপ্রধান না করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন টিক্কা খান। তাঁর সুপারিশ ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহাম্মদ আকবর খানের জন্য। জ্যেষ্ঠতার ক্রমে তিনি তৃতীয় স্থানে ছিলেন। কিন্তু জিয়াকেই নিজের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ভেবেছিলেন ভুট্টো। চার তারকার জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে জিয়াকে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিযুক্ত করেন ভুট্টো। ১৯৭৬ সালের ১ মার্চ জিয়া পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেন।
‘অপারেশন ফেয়ার প্লে’
সেনাপ্রধান হওয়ার পর জিয়া প্রকাশ্যে ভুট্টোর প্রতি অতি আনুগত্য দেখাতে থাকেন। যেমন প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর সঙ্গে হাত মেলানোর সময় জিয়া কখনো কখনো তাঁর দুই হাত এগিয়ে দিতেন। তাঁর এমন সব অতি আনুগত্যের প্রদর্শনী নিয়ে পাকিস্তানে অনেক গল্প চালু আছে।
তবে জিয়া ছিলেন অতি ধূর্ত, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, নির্মম ও দৃঢ় চিত্তের দক্ষিণপন্থী এক সেনাপতি। জিয়াকে একান্ত অনুগত ভেবে তাঁকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিলেও তাঁর মানসিক গঠন সম্পর্কে ভুট্টো খুব কমই জানতেন। ফলে ভুট্টোকে একের পর এক ধোঁকা দিতে পেরেছেন তিনি। এমনকি নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সংকটের শেষ মুহূর্তেও জিয়াকে অরাজনৈতিক ব্যক্তি ভেবে যাচ্ছিলেন ভুট্টো।
১৯৭৭ সালের ৭ মার্চের সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জয়লাভ করে। তবে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন বিরোধীরা। তাঁরা ভুট্টোর নতুন সরকারকে অবৈধ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁর পদত্যাগ দাবি করে পুনর্নির্বাচন চান। এ দাবিতে বিরোধীদের আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। বিরোধীরা প্রকাশ্যে সামরিক হস্তক্ষেপ চান। ভুট্টো অবশ্য একপর্যায়ে ছাড় দিতে রাজি হন। নতুন নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর একটা বোঝাপড়াও হয়।
১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই উভয় পক্ষের মধ্যে একটা চুক্তি সইয়ের কথা ছিল। আর ঠিক এদিনই ‘অপারেশন ফেয়ার প্লে’ নামের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন জিয়া। অথচ অভ্যুত্থানের আগের দিনও ভুট্টো তাঁর মন্ত্রিসভার বৈঠকে জিয়াকে রেখেছিলেন।
এমনকি অভ্যুত্থানের মধ্যেও ভুট্টোকে ধোঁকা দেন জিয়া। অভ্যুত্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হলে জিয়াকে ফোন করেছিলেন ভুট্টো। জবাবে জিয়া বলেছিলেন, ‘দুঃখিত স্যার, আমাকে এটা করতে হয়েছে।...কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা আপনাকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেব। কিন্তু আমরা ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দেব। নিশ্চিতভাবে আপনি আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে আসবেন। আমি আপনাকে স্যালুট দেওয়া অব্যাহত রাখব।’
জিয়ার আদেশে ভুট্টো ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। ক্ষমতা দখল করে জিয়া সামরিক আইন জারি করেন। স্থগিত করেন সংবিধান। ভেঙে দেন জাতীয় পরিষদ।
জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ৯০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু তাঁর এ ঘোষণা ছিল পুরোপুরি ‘আইওয়াশ’। তিনি আর নির্বাচন দেননি।
পথের কাঁটা দূর
ক্ষমতা নির্বিঘ্ন করতে ‘পথের কাঁটা’ ভুট্টোকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেন জিয়া। এ জন্য তিনি ১৯৭৪ সালের একটি হত্যার ঘটনাকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে বেছে নেন।
লাহোরের রাজনীতিবিদ আহমেদ রাজা কাসুরি পিপিপি করলেও নানা বিষয়ে ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে রাজা কাসুরির গাড়িতে হামলা হয়। তিনি প্রাণে বাঁচলেও তাঁর বাবা নওয়াব মোহাম্মদ আহমেদ খান কাসুরি নিহত হন। এ ঘটনায় রাজা কাসুরি থানায় এফআইআর করেন। তিনি এই হামলার ঘটনায় ভুট্টোর হাত থাকার অভিযোগ তোলেন। ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে মামলাটি বাতিল হয়। তবে পুরোনো এফআইআরটি ১৯৭৭ সালে পুনরুজ্জীবিত করেন জিয়া।
১৯৭৭ সালের অক্টোবরে সরাসরি লাহোর হাইকোর্টে ভুট্টোর বিরুদ্ধে হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। ১৯৭৮ সালের ১৮ মার্চ লাহোর হাইকোর্ট ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
জেনারেল জিয়া ১৯৭৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। পিপিপিপ্রধান ভুট্টোকে ছেড়ে দিতে জিয়ার কাছে দেশ-বিদেশের অনেকে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৭৯ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। রিভিউ আবেদনেও একই রায় বহাল থাকে। ভুট্টোর পক্ষে তাঁর বড় বোন প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাছে ক্ষমার আবেদন জানান। তা নাকচ করেন জিয়া।
১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল দিবাগত রাত দুইটায় রাওয়ালপিন্ডি জেলা কারাগারে ফাঁসির মাধ্যমে ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ভুট্টোর সমর্থকেরা এ ফাঁসিকে বিচারিক হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যা দেন।
ভুট্টোর ফাঁসি কার্যকর করার পর পাকিস্তান শাসনে জিয়ার সামনে আর কোনো বাধা থাকে না। তিনি টানা ১১ বছর দেশ শাসন করেন।
রাষ্ট্রকাঠামো বদল
পাকিস্তানে একটি দমনমূলক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জিয়া। তিনি তাঁর বিরোধী পক্ষ, গণতন্ত্রপন্থীসহ দেশটির উদার রাজনৈতিক কর্মী-গোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালান। তাঁর শাসনামলে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের অজস্র ঘটনা ঘটে। তিনি মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করেন।
সামরিক শাসক হিসেবে জিয়ার প্রথম নির্দেশই ছিল পাকিস্তানে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধের। তিনি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। ট্রেড ইউনিয়নের তৎপরতাও বন্ধ করেন তিনি।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোকে বদলে দেন জিয়া। তাঁর সামরিক সরকারের মূলনীতি ছিল পাকিস্তানকে একটা ধর্মরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। জিয়া তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক সব পদ্ধতি যুক্তিগ্রাহ্য করতে ধর্মের অপব্যবহার করেন। সংবিধান, আইন, বিচার, আমলাতন্ত্র, শিক্ষাসহ সমাজের সর্বস্তরে ‘ইসলামীকরণ’-এর জোর উদ্যোগ নেন তিনি।
পাকিস্তানে কট্টর ইসলামি মতাদর্শের বিকাশ ও বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন জিয়া। গত শতকের আশির দশকে আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে তিনি ‘উগ্রবাদী’ গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছিলেন। এ ছাড়া জিয়া সরকারের অগ্রাধিকারে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ।
রহস্যঘেরা উড়োজাহাজ ‘বিধ্বস্ত’
১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট জিয়া পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুর থেকে সামরিক বাহিনীর সি-১৩০বি হারকিউলিস উড়োজাহাজে করে ইসলামাবাদ যাচ্ছিলেন।
উড়োজাহাজটি ঠিকঠাকই উড্ডয়ন করেছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে এটির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, মাঝ আকাশে উড়োজাহাজটি ওপর-নিচ করছিল। একপর্যায়ে এটি খাড়াভাবে নিচের দিকে নামতে থাকে। এরপর মাঝ আকাশেই বিস্ফোরণ ঘটে।
এ ঘটনায় প্রেসিডেন্ট জিয়াসহ ৩০ জন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় জিয়ার ঘনিষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা চেয়ারম্যান জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটি জেনারেল আখতার আবদুর রহমান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ মোহাম্মদ আফজাল, আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক প্রমুখ ছিলেন। ছিলেন পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আরনল্ড লুইস রাফেল।
ঘটনাটি নিয়ে একাধিক তদন্ত হয়। তবে কোনো তদন্তে ঘটনার সন্তোষজনক কারণ উদ্ঘাটিত হয়নি। পাকিস্তানের তৎকালীন এয়ার কমোডর আব্বাস এইচ মির্জার নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি ৩৬৫ পৃষ্ঠার একটি কারিগরি প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছিল।
প্রতিবেদনটিতে এই উপসংহার টানা হয়, কারিগরি কোনো কারণ অনুপস্থিত থাকায় এ ঘটনার একমাত্র সম্ভাব্য কারণ হলো, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা নাশকতা। অপরাধীদের পরিচয় শনাক্ত করতে একটি তদন্ত শুরু করার জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদন নিয়ে পরবর্তী সময়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এয়ার কমোডর আব্বাস মির্জা বলেছিলেন, উড়োজাহাজটিতে কোনো ফ্লাইট রেকর্ডার ছিল না।
রহস্যঘেরা ঘটনাটি নিয়ে নানা প্রশ্ন, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আছে। যেমন বলা হয়, উড়োজাহাজটির ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস ছড়ানো হয়েছিল, যা পাইলটসহ আরোহীদের নিস্তেজ করে দিয়েছিল। ফলে উড়োজাহাজ থেকে কোনো জরুরি সংকেত আসেনি। পরে উড়োজাহাজে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
২০২০ সালে জিয়ার ছেলে মুহাম্মদ ইজাজুল হক এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, তিনি এমনসব তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করেছেন, যা থেকে এ উপসংহারে পৌঁছানো যায়, উড়োজাহাজের ককপিটে নার্ভ গ্যাস (নার্ভ এজেন্ট) ছড়ানো হয়েছিল। এ কারণে পাইলটরা নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এ ছাড়া উড্ডয়নের আগে উড়োজাহাজে আমের ক্রেট তোলা হয়েছিল। এই ক্রেটে বিস্ফোরক ছিল। পাশাপাশি বাইরের দিক থেকে ছোড়া একটি প্রজেক্টাইল (ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট বা এ–জাতীয় অন্য কোনো আঘাতকারী বস্তু) উড়োজাহাজটিকে আঘাত করেছিল।
ইজাজুল হকের ভাষ্যে, ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁর বাবাকে হত্যার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো ফাঁকফোকরই রাখেননি। তাঁরা নার্ভ গ্যাস ও বিস্ফোরক ব্যবহার করেছেন। আবার বাইরে থেকে প্রজেক্টাইলও ছুড়েছেন।
জিয়া হত্যার ষড়যন্ত্রে ইজাজুল হক সন্দেহের তির তাক করেন জেনারেল মির্জা আসলাম বেগের দিকে। জিয়ার মৃত্যুর পর সেনাপ্রধান হয়েছিলেন আসলাম। ইজাজুল হক তাঁর সন্দেহের তালিকায় মুলতানের আর্মার্ড ডিভিশনের তৎকালীন কমান্ডার জেনারেল মাহমুদ আলী দুররানিকেও রাখেন। পাশাপাশি ইজাজুল হক ইসরায়েল ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সম্ভাব্য সম্পৃক্ততার কথা বলেন।
এমন কথাও বলা হয়, আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিপক্ষে মুজাহিদীনদের সমর্থন দেওয়ায় জিয়াকে হত্যা করা হয়। সোভিয়েত বা তার কোনো মিত্রের এ কাজে হাত ছিল। এ ছাড়া দেশ-বিদেশের নানা ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করার প্রবণতা দেখা যায়।
রহস্যের কিনারা এখনো না হওয়ায় ঘটনাটি নিয়ে নানা চর্চা অব্যাহত আছে। ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ডালপালা এখনো ছড়াচ্ছে।
তবে এ বিষয়ের বাইরে অন্য কারণেও জিয়াকে নিয়ে এখনো পাকিস্তানে আলোচনা-সমালোচনা চলে। বিশ্লেষকেরা বলে থাকেন, ‘ইসলামি চরমপন্থা’র বিকাশ-বিস্তারসহ নানাভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে সর্বনাশ জিয়া করে গেছেন, তার মাশুল এখনো দিয়ে যাচ্ছে দেশটি। দীর্ঘ মেয়াদে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদের উত্থানসহ সেটি একটি স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হওয়ার কারিগর তিনি।
তথ্যসূত্র:
আলতাফ পারভেজ (২০২৩), জুলফিকার আলী ভুট্টো: দক্ষিণ এশিয়ার কুলীন রাজনীতির এক অধ্যায়, বাতিঘর;
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ডন, ডয়চে ভেলে ও আনাদোলু এজেন্সি