জনরায়ে ইমরানই এগিয়ে

সঠিক ফলাফল ঘোষণার দাবিতে অস্থায়ী নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের সামনে ইমরান খানের দল পিটিআই–সমর্থকদের বিক্ষোভ। গতকাল পেশোয়ারেছবি: রয়টার্স

প্রায় ১০ মাস ধরে কারাগারে ইমরান খান। তিন মামলায় ২৪ বছর সাজা হয়েছে তাঁর। দলের প্রতীক কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দলের নেতাদের নির্বাচন করতে হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। তা–ও প্রচার–প্রচারণায় ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা। রাজনীতিতে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হলেও গণমানুষের প্রতি আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর। পাকিস্তানের জনগণও সেই প্রত্যাশার অভূতপূর্ব প্রতিদান দিয়েছেন। নির্বাচনে বাজিমাত করেছেন ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)–সমর্থিত প্রার্থীরা।

গত বৃহস্পতিবার একই সঙ্গে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পরিষদে ইমরান খানের দল পিটিআই–সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ের পাল্লা ভারী। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ–নওয়াজ (পিএমএল–এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে (পিপিপি) পেছনে ফেলে সর্বোচ্চ আসনে জয়ী হয়েছেন তাঁর সমর্থিত প্রার্থীরা। ধারণা করা হচ্ছে, ইমরানের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণেই পিছিয়ে পড়তে হয়েছে পাকিস্তানের রাজনীতির দুই প্রভাবশালী দল পিএমএল–এন ও পিপিপিকে।

নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার ৩৭ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও আজ শনিবার ভোর ছয়টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ফল ঘোষণা শেষ হয়নি। পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২৬৫টি আসনের মধ্যে ২৫০ আসনের ফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৯ আসনে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাঁদের বেশির ভাগই পিটিআই–সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী। এরপরই ৭১ আসনে জয় পেয়েছে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল। তৃতীয় অবস্থানে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল পিপিপি। তাঁর দল পেয়েছে ৫৩ আসন। এ ছাড়া এমকিউএম ১৭ আসনে এবং অন্যান্য দল ১০টি আসনে জয়ী হয়েছে।

পাকিস্তানের পার্লামেন্টের জাতীয় পরিষদের মোট ২৬৬ আসনে সরাসরি ভোট হয়। এর মধ্যে একটি আসনের প্রার্থী গুলিতে নিহত হওয়ায় সেখানে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশ পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর বড় প্রভাব রয়েছে। সে হিসেবে এবার রাজনৈতিক মহলে একটি গুঞ্জন ছিল, এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর পছন্দের প্রার্থী নওয়াজ শরিফ। ভোটের দিনও সরকার গঠনের বিষয়ে ব্যাপক আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি। লাহোরে একটি কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচন শেষ হলেই আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেব, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন।’ তবে শেষ পর্যন্ত একক দল হিসেবে সর্বাধিক আসন পেলেও সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি তাঁর দল পিএমএল–এন।

সেদিক দিয়ে পিটিআই–সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এগিয়ে থাকা এবারের নির্বাচনে বড় চমক। ২০১৮ সালে ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে পাকিস্তানে ক্ষমতায় বসেছিল পিটিআই। সামরিক বাহিনীর বিরাগভাজন হয়ে চার বছরের মাথায় দলটির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের পতন হয়। এরপর রাজনীতির মাঠে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটি। মামলা–হামলা ও দমনপীড়নের মুখে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবারের নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে হয় পিটিআই নেতাদের।

জাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে: ইমরান

ইমরান খানের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে গত রাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি তাঁর একটি বক্তব্য প্রচার করা হয়। সেখানে তিনি বলেন, নজিরবিহীনভাবে জাতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এতে জাতীয় নির্বাচনে পিটিআই বিজয় হয়েছে।

জানা গেছে, পিটিআইয়ের নেতারা ইমরান খানের সঙ্গে নির্বাচনের ফল নিয়ে আলোচনা করতে আজ শনিবার আদিয়ালা কারাগারে যাবেন।

এদিকে পিএমএল-এন বা পিপিপির সঙ্গে জোট গড়বে না বলে জানিয়েছেন পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান গহর আলী খান। গতকাল জিও নিউজকে তিনি বলেন, ‘পিএমএল-এন ও পিপিপির সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখছি না।’

জোট সরকার গড়তে চান নওয়াজ

নির্বাচনের ফল প্রকাশের মধ্যেই গতকাল লাহোরে পিএমএল-এনের প্রধান কার্যালয়ে সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন নওয়াজ শরিফ। তিনি বলেন, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পিএমএল-এন এককভাবে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হিসেবে সামনে এসেছে।

তবে সরকার গঠনের জন্য জাতীয় পরিষদে এককভাবে ১৩৪টি আসন পায়নি পিএমএল-এন। তাই জোটগতভাবে সরকার গঠনের দিকে ইঙ্গিত করে নওয়াজ বলেন, পাকিস্তানে বর্তমানে যেসব সংকট রয়েছে, তা থেকে উত্তরণে সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।

নওয়াজ শরিফ জানান, জোট সরকার গঠনের জন্য তাঁর ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ পিপিপির কো–চেয়ারম্যান আসিফ আলী জারদারি, জমিয়ত উলেমা ইসলাম-ফজলের (জেইউআই-এফ) নেতা ফজলুর রেহমান ও মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তানের (এমকিউএম-পি) নেতা খালিদ মকবুল সিদ্দিকীর সঙ্গে আলোচনায় বসবেন।

এদিকে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন এক প্রতিবেদনে জানায়, গত রাতেই নওয়াজ বৈঠক করেছেন আসিফ জারদারির সঙ্গে। তবে বৈঠকের বিস্তারিত তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।

স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কী করতে পারেন

আল–জাজিরার খবরে বলা হয়, নির্বাচনে পিটিআই–সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এগিয়ে রয়েছেন। তবে সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী তাঁরা জাতীয় পরিষদে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৩৪টি আসন পাচ্ছেন না। নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হবে।

বিশ্লেষকদের অনেকের অভিমত, স্বতন্ত্র এই প্রার্থীরা যদি কোনোভাবে সরকারে থাকেন, তাহলে ইমরানের কারাদণ্ডের সাজা বা তাঁর সরকারি দায়িত্বে থাকার ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করতে পারবেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইমরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার যে সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েছে, তাকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন।

ফল প্রকাশে বিলম্ব নিয়ে বিতর্ক

পাকিস্তানে গত বৃহস্পতিবার ভোট গ্রহণের দিন সারা দেশে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়। সরকারের এমন পদক্ষেপের সমালোচনা করে পিটিআই, পিপিপিসহ বিভিন্ন দল ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ব্যালট ছিনতাইয়ের অভিযোগও ওঠে। নির্বাচনের দিন দেশব্যাপী সহিংসতায় ১২ জন নিহত হন বলে জানায় সামরিক বাহিনী।

এরই মধ্যে নতুন বিতর্ক দেখা দেয় নির্বাচনের ফল প্রকাশ ঘিরে। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার ১০ ঘণ্টার বেশি সময় পর ফল ঘোষণা শুরু হয়। ফল ঘোষণায় বিলম্বের মাধ্যমে ভোটে কারচুপির চেষ্টা হচ্ছে বলে বৃহস্পতিবার রাতে অভিযোগ তোলে পিটিআইসহ কয়েকটি দল।

তবে ‘ইন্টারনেট সমস্যা’ ভোটের ফল প্রকাশে দেরি হওয়ার একটি কারণ বলে উল্লেখ করেন পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের (ইসিপি) বিশেষ সচিব জাফর ইকবাল। আর দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘তথ্যের ঘাটতির জন্যই’ এই বিলম্ব হয়েছে।

নির্বাচন–পরবর্তী সহিংসতায় নিহত ৩

গতকাল দিনভর পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষোভ করেছেন পিটিআইয়ের সমর্থকেরা। সঠিক ফল ঘোষণার দাবিতে লাহোর ও পেশোয়ারে নির্বাচন কমিশনের অস্থায়ী কার্যালয়ের বাইরে সমাবেশ করেছেন তাঁরা। পেশোয়ারে সড়ক অবরোধও করতে দেখা গেছে ইমরানের সমর্থকদের।

বিবিসির খবরে বলা হয়, এদিন সবচেয়ে বড় সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে ইমরানের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের শাংলা এলাকায়। সেখানে পিটিআইয়ের সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ছয়জন।

নির্বাচন ঘিরে পশ্চিমাদের উদ্বেগ

পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে নানা ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, পাকিস্তানের নির্বাচন ঘিরে সংঘাত এবং ‘মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতাচর্চায় বাধা দেওয়ার’ নিন্দা জানায় ওয়াশিংটন। নির্বাচনে ‘হস্তক্ষেপ ও জালিয়াতির’ যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করার আহ্বান জানান তিনি।

নির্বাচন ঘিরে উদ্বেগ জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, নির্বাচনে সব দলকে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কয়েকজন রাজনীতিককে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে ‘আইনি প্রক্রিয়া’ কাজে লাগানো হয়েছে। নির্বাচন ঘিরে ইন্টারনেট বন্ধ এবং ফল প্রকাশে বিলম্বের বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।

নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সব দলকে সমান সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ এনেছে ইইউও। যুক্তরাষ্ট্রের মতো তারাও পাকিস্তান কর্তৃপক্ষকে অনিয়মের অভিযোগগুলো তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।