নওয়াজের আবার পাকিস্তানের ক্ষমতায় ফেরার আভাস

নওয়াজ শরিফ

প্রধান দুই প্রতিপক্ষের একটিকে কোণঠাসা অবস্থায় রেখে পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হলো। গতকাল বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ২৬৬টি আসনে ভোট গ্রহণ হয়। এই ভোটের ফলের মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হবে আগামী পাঁচ বছর পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দেবেন কারা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে কারাবন্দী এবং তাঁর দল পিটিআইকে চাপের মধ্যে রেখে যেভাবে ভোট হয়েছে, তাতে নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লিগই (পিএমএল-এন) সরকার গঠন করতে যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

ভোটের ফল নিয়ে এমন ধারণার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানে কোন দল ক্ষমতায় আসবে, আর কারা ক্ষমতা হারাবে, তা নির্ভর করে দেশটির প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর ওপর। ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই সরকার গঠন করেছিলেন পিটিআই (পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ) নেতা ইমরান খান। চার বছরের মাথায় ২০২২ সালে সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হয়েই গদি ছাড়তে হয় তাঁকে। এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সমর্থন নওয়াজ শরিফের দিকেই বলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে।

গতকাল দিবাগত রাত দেড়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো আসনের ভোটের ফল প্রকাশিত হয়নি। তবে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ জানিয়েছেন নওয়াজ শরিফ। গতকাল লাহোরে একটি কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘নির্বাচন শেষ হলে আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেব কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন আর কে পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হবেন।’ পাকিস্তানে গতকাল জাতীয় পরিষদের পাশাপাশি পাঞ্জাবসহ চারটি প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিকান্দার সুলতান রাজা বলেছেন, নির্বাচন শতভাগ স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কোনো বাধা ছাড়াই নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলেছে। কাউকে ভোটদানে বাধা দেওয়া হয়নি।

ইন্টারনেট বন্ধের সমালোচনা, কারচুপির অভিযোগ

গতকাল ভোট গ্রহণের সময় পাকিস্তানজুড়ে ইন্টারনেট ও মুঠোফোন সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশসহ দেশের কয়েকটি জায়গায় সহিংসতায় পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১২ জন নিহত হন। ভোটের সময় মুঠোফোন ও ইন্টারনেট বন্ধ রাখার সমালোচনা করেছে ইমরানের দল পিটিআই। ভোটে কারচুপির জন্যই এটা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দলটি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও দ্য কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসও (সিপিজে) এর সমালোচনা করেছে।

এ ছাড়া পিটিআইয়ের বেশ কয়েকজন নেতা ব্যালট পেপার চুরি এবং প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণ করার অভিযোগ করেছেন। পাকিস্তানে বিপুল জনসমর্থন থাকার পরেও পিটিআই নেতারা এবার নিজেদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আর পিটিআই প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে এখন কারাবন্দী।

পিটিআই অবশ্য ভোটে জনগণের অংশগ্রহণকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। গতকাল ভোট গ্রহণ শেষে এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে দলটি বলেছে, মানুষকে ভয় দেখাতে এবং ভোটদান থেকে দূরে রাখতে অবৈধ ও ফ্যাসিবাদী সরকার সব কৌশলই কাজে লাগিয়েছে। এরপরও নজিরবিহীনভাবে পাকিস্তানের মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে জুলুমবাজ, বেআইনি ও জালিয়াতির শাসনব্যবস্থাকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। আর ইমরান খানের এক্স হ্যান্ডলে এক পোস্টে জনগণকে রাতের বেলায় নিজেদের ভোট ‘পাহারা’ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

নওয়াজের ‘জয়ের পথ পরিষ্কার করা হয়েছে’

ইমরান খান যে শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন, একই পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন পাকিস্তানের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। দুর্নীতিসহ একাধিক অভিযোগ মাথায় নিয়ে স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়েছিলেন পিএমএল-এনের প্রতিষ্ঠাতা নওয়াজ। ২০২২ সালে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটলে নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হয়। এরপর লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন নওয়াজ।

এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনে নওয়াজ শরিফ ও তাঁর দল পিএমএল-এন জিতবে বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকলিন ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তাতে বলা হয়, নির্বাচনে যদি পিটিআইয়ের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কোনোভাবে জয় পান, তাহলে সেটি হবে দলটির জন্য বড় একটি চমক। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্যমতে, এবারের নির্বাচনটা হয়েছে ইমরান খানের বিরুদ্ধে এবং নওয়াজের পক্ষে।

পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে নওয়াজের জয়ের পথ পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন নিয়ে দেশটির পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছে নওয়াজের দল পিএমএল-এন।’

নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন যদি পার্লামেন্টে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে তিনি পিপিপিসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে জোট সরকার গঠন করতে পারেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে। যদিও গতকাল নওয়াজ বলেছেন, ‘আল্লাহর দোহাই, জোট সরকারের কথা বলবেন না। দেশের জন্য কোনো দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজকেই ভালো পছন্দ মনে করছেন লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক ও যুক্তরাজ্যের সাবেক কূটনীতিক টিম উইলেসি-উইলসি। তিনি বলেন, ‘নওয়াজ শরিফ একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে তিনি সব সময়ই দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গেও তিনি ভালো সম্পর্ক চাইবেন।’