পাকিস্তানের পেশোয়ারে সম্প্রতি কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকার একটি মসজিদে কীভাবে এক আত্মঘাতী ব্যক্তি হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১০০ মানুষকে হত্যা করলেন, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে যতগুলো হামলা হয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল এটি। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। হামলার সময় তাঁরা মসজিদে নামাজ আদায় করছিলেন। পুলিশের ধারণা, মনোবল ভেঙে দিতে তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।
ওই বিস্ফোরণের নেপথ্যের কারণ কী হতে পারে, তা নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের নভেম্বরে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে ‘যুদ্ধবিরতি’ থেকে বেরিয়ে যায় জঙ্গি সংগঠন। এর পর থেকে দেশটিতে সহিংসতা বেড়েই চলেছে। পুলিশ ও সেনাসদস্যদেরও প্রায়ই হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এর দুই মাস পর গত সোমবার ভয়াবহ এ হামলা হয়।
সোমবারের হামলার পর শুরুতে দাবি করা হয়েছিল, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এ হামলা চালিয়েছে। পরে সংগঠনটি হামলার দায় অস্বীকার করে। তাদের দাবি, বিচ্ছিন্ন উপদলের এক কমান্ডার ওই হামলা চালিয়েছেন।
তালেবান হামলার দায় অস্বীকার করায় এ নিয়ে পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, এটি মূল ঘটনা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরানোর প্রচেষ্টা হতে পারে।
অতীতেও তালেবানকে মসজিদ, স্কুল ও বাজারে হামলার পর দায় অস্বীকার করতে দেখা গেছে। তালেবান বোঝাতে চায়, তাদের লড়াইটা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে, পাকিস্তানি জনগণের সঙ্গে নয়।
বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে তালেবানের লড়াই চলছে। এ লড়াইয়ে অনেক প্রাণহানি হয়েছে। আফগান তালেবানের শাখা টিটিপিও একই রকমের কট্টর মতাদর্শে বিশ্বাসী। তবে তারা আলাদাভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে।
পাকিস্তান সরকারের কাছে তেহরিক-ই-তালেবান যেসব দাবি করে থাকে, তার মধ্যে প্রথম ও প্রধান দাবি হচ্ছে পাকিস্তানে শরিয়াহ আইন চালু করা।
আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী পার্বত্য এলাকাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে তালেবান। এক দশক আগেই সংগঠনটি হুমকি দিয়েছিল, তারা পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।
২০১২ সালে তৎকালীন স্কুলশিক্ষার্থী মালালা ইউসুফজাইকে গুলি করার পর তালেবান আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। এর দুই বছর পর পেশোয়ারের স্কুলে তালেবান হামলায় ১৪১ জন নিহত হয়, যাদের বেশির ভাগই ছিল শিশু। ওই হামলার পর পাকিস্তানে তালেবানের প্রভাব ব্যাপক হারে কমে গিয়েছিল। ওই হামলার পরই তালেবানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু হয়।
প্রচণ্ড জনরোষের মুখে সেনাবাহিনী জঙ্গি আস্তানাগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল। জঙ্গিরা তখন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আফগানিস্তানে সরে পড়েছিল। তখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গি তৎপরতা অনেকখানি কমে গিয়েছিল।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আবার টিটিপি ও অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর হামলার পরিমাণ বাড়তে শুরু করে।
২০২১ সালে তালেবান আবারও আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সীমান্ত এলাকায় লুকিয়ে থাকা জঙ্গিদের দেশে ফেরার সুযোগ দিয়েছিলেন। অস্ত্র সমর্পণের শর্তে তাঁদের দেশে থাকতে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে শর্ত মেনে জঙ্গিরা দেশে ফিরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি হননি। আর এখান থেকেই মূলত বর্তমান সমস্যার শুরু।
এর মধ্য দিয়ে ইমরান খানের উদ্যোগে শুরু হওয়া আলোচনা ভেস্তে গিয়েছিল। গত বছর ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর পাকিস্তানের নতুন সরকার ও সামরিক নেতারাও তালেবানের দাবির সঙ্গে একমত হননি। তাঁরাও তালেবানের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে দেন। এর ফলে গত বছরের নভেম্বরে তালেবান যুদ্ধবিরতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে হামলা শুরু করে।
পেশোয়ারে একটি রক্তদান সংগঠন পরিচালনা করেন আশরাফ আলী। তিনি বলেন, পেশোয়ারের লোকজন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। কারণ, পেশোয়ার থেকে সন্ত্রাসবাদ দূর করে পর্যটন এলাকায় পরিণত করতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। এখন পেশোয়ার আবারও ভয়াবহ ধরনের সন্ত্রাসবাদে আক্রান্ত।
পাকিস্তান বলছে, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাদের বাহিনীগুলো প্রস্তুত আছে। তবে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করার মতো শক্তিশালী অস্ত্র পাকিস্তান পুলিশের কাছে নেই। পুলিশ স্টেশনগুলোর ওপর সম্প্রতি যেসব জঙ্গি হামলা হয়েছে, তার কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পুলিশ হামলা প্রতিহত করার চেষ্টাই করেনি।
জনগণ চায়, চিরতরে সহিংসতার অবসান হোক। বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, জঙ্গিদের পরাস্ত করতে চাইলে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান চালাতে হবে, যেমনটা ২০১৪ সালে করা হয়েছিল।
তবে জঙ্গিদের মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট নয় পাকিস্তানিরা। তারা এর সমালোচনা করে থাকে।
অনেকের ধারণা, পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে এখনো জঙ্গিদের প্রতি নমনীয় মনোভাব আছে। এ কারণে তালেবানের হুমকিকে যথাযথভাবে সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।