পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে কেন এত রক্ত ঝরছে

পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের মুসাখাইল এলাকায় গুলি চালানোর পর গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় সন্ত্রাসীরাছবি: এএফপি

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে গত রোববার রাত থেকে গতকাল সোমবার ভোর পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বন্দুকধারীদের অন্তত ৬টি হামলায় ৭৪ জন নিহত হয়েছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলাটি হয়েছে বেলুচিস্তান-পাঞ্জাব মহাসড়কে, মুসাখেল জেলার রারাশাম এলাকায়। এই এলাকা বেলুচিস্তান-পাঞ্জাব সীমান্তের খুব কাছে। রোববার রাতে ৩০ থেকে ৪০ জন বন্দুকধারী সেখানে অন্তত ২২টি বাস, ট্রাক ও পিকআপ ভ্যান থামিয়ে সেগুলো থেকে যাত্রীদের নামিয়ে তাঁদের পরিচয় তল্লাশি করেন এবং খুঁজে খুঁজে পাঞ্জাব থেকে আসা ব্যক্তিদের গুলি করে হত্যা করেন। সেখানে অন্তত ২৩ জনকে হত্যা করা হয়। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই পাঞ্জাব থেকে আসা শ্রমিক।

এ ছাড়া বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটা থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে কালাত জেলায় বন্দুকধারীরা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে অন্তত ১০ জনকে হত্যা করেন। বোলান জেলায় রোববার রাতে হত্যা করা হয় ছয়জনকে, যাঁদের চারজন পাঞ্জাব থেকে আসা।

আরও কয়েকটি হামলায় পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ৫ সদস্যসহ ১৪ জনকে হত্যা করা হয়।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব হামলায় নিরাপত্তা বাহিনী পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে ‘২১ জঙ্গিকে’ হত্যা করেছে।

এ বছর বেলুচিস্তানে এর আগেও বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। বেসামরিক মানুষ, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও সরকারি অবকাঠামো লক্ষ্য করে সেসব হামলা হয়। তারপরও সর্বশেষ এসব হামলা সহিংসতার তীব্রতা বৃদ্ধি ও গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের কথা বলছে বলে মত বিশ্লেষকদের।

নিরাপত্তাবিশ্লেষক ও পাক ইনস্টিটিউট অব পিস স্টাডিজের (পিআইপিএস) পরিচালক মুহাম্মদ আমির রানা বলেন, গত বছর মে মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বড় হামলা হয়েছে। কিন্তু আজকের (রোববার রাত থেকে সোমবার ভোর) ঘটনাগুলো উল্লেখ করার মতো। মহাসড়ক অবরোধ করে রাখা হয়েছে, রেললাইনের ক্ষতি করা হচ্ছে এবং সবই পাঞ্জাবের কাছে।

‘তারা যেভাবে হামলার বিস্তার ঘটাচ্ছে, সেটা নজিরবিহীন। তারা পাঞ্জাবে বা পাঞ্জাবের কাছে হামলার বিস্তার ঘটাচ্ছে এবং ক্ষমতার প্রদর্শন করছে।’

এবারের হামলায় বিশেষ করে পাঞ্জাব থেকে আসা শ্রমিকদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। আয়তনের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহৎ পাঞ্জাব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ। দেশটির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পাঞ্জাবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

বিশ্লেষকদের মতে, এর আগে চীনের নাগরিক ও চীনা প্রকল্পগুলোতে বেশ কয়েকটি হামলা হয়েছে। এখন পাঞ্জাব থেকে আসা মানুষদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এই বার্তা দিতে চাইছে যে বেলুচিস্তানে বহিরাগত ব্যক্তিরা নিরাপদ নন।

ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাস করা মালিক সিরাজ আকবর বেলুচিস্তান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘চীনারা ছাড়া বেলুচ লোকজনও হামলার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে যাঁরা নিরাপত্তা বাহিনীতে রয়েছেন। তা ছাড়া পাঞ্জাব থেকে আসা শ্রমিক ও অন্যান্য কর্মী, যাঁরা এসব উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত, তাঁরাও হামলার শিকার হচ্ছেন। হামলাকারীদের লক্ষ্য বাইরের মানুষকে এসব নানা উদ্যোগের অংশ হয়ে বেলুচিস্তানে কাজ নিয়ে আসতে নিরুৎসাহিত করা।’

হামলার সময়ও একটি বার্তা

২৬ আগস্ট ছিল বেলুচ নেতা নওয়াব আকবর বুগতির ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি বেলুচিস্তানের সাবেক গভর্নর ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ২০০৫ সালে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। পরের বছর ২৬ আগস্ট নিজ শহর ডেরা বুগতিতে সামরিক অভিযান চালিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়।
বুগতির মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে প্রায়ই বেলুচিস্তানে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। তবে প্রদেশজুড়ে সাম্প্রতিক হামলাগুলো স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে বলে মনে করেন আকবর। তিনি বলেন, ‘প্রদেশজুড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বিস্তার লাভ করছে এবং সরকারি কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।’

আয়তনের দিক দিয়ে পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ প্রদেশ বেলুচিস্তান, লোকসংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখ। ২০২৩ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ২৪ কোটি।

বেলুচিস্তান প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ। সেখানে তেল, কয়লা, সোনা, তামা ও গ্যাসের খনি রয়েছে। এরপরও পাকিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল এটি।

পাকিস্তান সরকারের রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ। অথচ এই প্রদেশের বাসিন্দাদের কঠোর অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিন যাপন করতে হয়।

পাকিস্তানের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দরও বেলুচিস্তানে, গোয়াদার সমুদ্রবন্দর। ছয় হাজার কোটি মার্কিন ডলারের চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্প মূলত এই সমুদ্রবন্দর ঘিরেই গড়ে উঠেছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য দক্ষিণ–পশ্চিম চীন এবং আরব সাগর দিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সংযোগ গড়ে তোলা।

বেলুচিস্তান প্রদেশের বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, পাকিস্তান সরকার খুবই কৌশলে ক্রমাগত তাঁদের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে যাচ্ছে এবং তাঁদের সম্পদের অপব্যবহার করছে। এর ফলে তাঁদের মধ্যে (সরকার দ্বারা) প্রতারিত হওয়ার অনুভূতি গড়ে উঠেছে এবং তাঁদের সমর্থন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

আরও পড়ুন

আকবর বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সোনা, খনিজ সম্পদ এবং কয়লা অনুসন্ধানের ঘোরবিরোধী। তাঁরা এই কার্যকলাপগুলোকে বেলুচিস্তানের সম্পদের শোষণ হিসেবে দেখেন।’

‘প্রমাণ হিসেবে তাঁরা কয়লাবোঝাই ট্রাক প্রদেশের সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার ছবিগুলো তুলে ধরেন। তাঁরা দেখাতে চান, এভাবেই তাঁদের সম্পদ শোষণ করে নেওয়া হয় এবং স্থানীয় জনগণের কোনো লাভই হয় না। এটা তাঁদের আন্দোলনের কারণগুলোর ওপর স্থানীয় জনসমর্থন বাড়ায়।’

প্রায় দুই দশক ধরে বেলুচ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। তাদের দমন করতে সরকার সেখানে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। যে অভিযানে বেলুচ সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন।

রক্তে ভেজা ভূখণ্ড

২০২১ সালে তালেবান আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে, পাকিস্তানে জঙ্গি হামলার ঘটনাও অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশে। পাকিস্তানের এই দুই রাজ্যই আফগান সীমান্তে।

পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (পিআইসিএসএস) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশটিতে ৬৫০টির বেশি ‘জঙ্গি’ হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলাগুলোর ২৩ শতাংশই হয়েছে বেলুচিস্তানে, নিহত হয়েছেন ২৮৬ জন।

বেলুচিস্তানে ধারাবাহিক হামলার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন কোয়েটাভিত্তিক বিশ্লেষক মুহাম্মদ আরিফ। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘বেলুচিস্তান অনেক বড় এলাকা, সেখানে লোকজন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করে। এটা সরকার ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন—উভয়ের জন্যই একাধারে ভালো ও মন্দ। সেখানে সরকার যেমন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতে পারছে না, তেমনি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোও কার্যকরভাবে এত বড় এলাকার নিয়ন্ত্রণ দাবি করতে পারছে না।’

আরও পড়ুন

জনগণের স্বার্থ রক্ষা ও জননিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ার কারণে স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তান সরকার বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করেন মুহাম্মদ আরিফ।

আরিফ বলেন, ‘এ ধরনের হামলা বাড়ছে এবং এগুলো প্রতিরোধ করতে সরকারকে রীতিমতো লড়াই করতে হয়। এতে যে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়, তাতে স্থানীয় লোকজন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর দিকে আরও বেশি ঝুঁকে যাবেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রচেষ্টা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।’

যদিও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত হবে না বলে মনে করেন বেলুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক। বলেন, ‘আমার মতে, আরও বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগে সরকারের উচিত, বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই রক্তপাত এখানকার মানুষকে গ্রাস করে ফেলবে। তাঁদের অবশ্যই এটা বোঝাতে হবে, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে কেউ লাভবান হতে পারে না।’

আরও পড়ুন