ট্রাম্পের চাটুকারিতা করেই কি পাকিস্তানের কূটনীতিকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছেন শাহবাজ

মিসরের শারম আল–শেখে সম্প্রতি যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। সেখানের অন্য বিশ্বনেতাদের উল্টো পথে হেঁটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশংসায় মাতেন তিনি। এ নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক হাস্যরস হয়েছে। তবে এই প্রশংসা কি শাহবাজের কোনো কৌশল ছিল? এর মাধ্যমে কি তিনি পাকিস্তানকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছেন—এসব নিয়ে লিখেছেন আহমেদ সাজ্জাদ মালিক। যুক্তরাজ্যের রাজস্ব ও শুল্ক দপ্তরের (এইচএমআরসি) সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের একজন সদস্যও আহমেদ সাজ্জাদ মালিক।

মিসরের ‘শান্তি’ সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পফাইল ছবি: রয়টার্স

গাজায় যুদ্ধবিরতি, উপত্যকার পুনর্গঠন এবং সংঘাতপরবর্তী কূটনীতি—এসব বিষয় নিয়েই ছিল মিসরের পর্যটন শহর শারম আল-শেখের সম্মেলনে আলোচনা। তবে সম্মেলনে যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ কথা বলতে যান, তখন হাওয়া বদলে যায়। গাজায় ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য একত্র হওয়া ঘরভর্তি বিশ্বনেতার সামনে তিনি যা বললেন, তা কূটনৈতিক কিছু নয়, বরং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশংসার ফুলঝুরি।

ভাষণে ট্রাম্পকে ‘শান্তির মানুষ’ তকমা দেন শাহবাজ শরিফ। তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কথা তোলেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানোর জন্য কৃতিত্বও দেন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে।

এসব শুনে ট্রাম্প যখন আত্মতৃপ্তির হাসি হাসছিলেন, সম্মেলনকক্ষের বাকিদের দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁরা অবিশ্বাস ও বিস্ময়ের মধ্যে আটকে গেছেন। তাঁরা করতালি দিয়েছিলেন, তবে তাতে সংকোচ ছিল। ট্রাম্পকে নিয়ে শাহবাজের প্রশংসাও অতি দ্রুত খবরের শিরোনাম হয়।

কূটনীতির যেসব প্রচলিত রীতিনীতি মেনে চলা হয়, তার ভিত্তিতে মিসরের সম্মেলনে শাহবাজ শরিফের বক্তব্য ছিল অযৌক্তিক। মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান—সম্মেলনে যোগ দেওয়া কোনো নেতাই এমন অনিয়ন্ত্রিত তোষামোদের সুরে কথা বলেননি।

তাই গুরুগম্ভীর এই সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নাটকীয়ভাবে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে, যা প্রায় হাস্যরসের শামিল। যদিও এই প্রশংসা কাজে লেগেছে, অন্তত যাঁকে উদ্দেশ করে এই প্রশংসা, সেই ট্রাম্পের ক্ষেত্রে হলেও।

ট্রাম্প এমন একজন মানুষ, যাঁর কাছে আদর্শের চেয়ে নিজের ভাবমূর্তিটা বড়। তাই শাহবাজের বক্তব্যের পর তিনি রাষ্ট্রনায়কের মতো নয়, বরং একজন তারকার মতো আচরণ করেছেন।

অপমানজনক নাকি বিরল কৌশল

ট্রাম্পের রাজনীতি চলে আনুগত্যের ওপর। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে শাহবাজের বক্তব্য মোটেও লজ্জাজনক ছিল না। সেগুলো ছিল ট্রাম্পকে উদ্দীপ্ত করার জন্য। ট্রাম্পের কূটনীতির লেনদেনের মঞ্চে তোষামোদ কোনো চাতুরী নয়, বরং অর্থের মতো।

নীতিকথার চেয়ে এক লাইনের অতিপ্রশংসার মাধ্যমে ট্রাম্পের কাছ থেকে বেশি সুনাম কামিয়ে নেওয়া যাবে। কারণ, আত্মকেন্দ্রিক একজন মানুষের কানে আনুগত্যই কূটনীতির মতো শোনায়।

রাজনৈতিক মনোবিদেরা একে ‘নার্সিসিসটিক রিওয়ার্ড লুপ’ বা ‘আত্মকেন্দ্রিক পুরস্কারচক্র’ বলে উল্লেখ করেছেন। এটি এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ার চক্র, যেখানে বাস্তব কোনো না কোনো প্রশংসার মাধ্যমে সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করা যায়।

মিসরের সম্মেলনে শাহবাজ শরিফ হয়তো পাকিস্তানের কৌশলগত স্বার্থগুলো তুলে ধরেননি, তবে একই গুরুত্বের অন্য কিছু অর্জন করেছেন। তিনি নিজেকে এবং আরও বড় পরিসরে বলতে গেলে পাকিস্তানকে ট্রাম্পের শান্তির বয়ানে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। এর ফলে ভাষণের অযৌক্তিকতাই সাফল্যে পরিণত হয়েছে।

সম্মেলনে ট্রাম্পের প্রশংসা করে বক্তব্য দেন শাহবাজ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

শারম আল-শেখের সম্মেলনে শাহবাজ যে বক্তব্য দিয়েছেন, অলংকারশাস্ত্রের তত্ত্বে তাকে বলা হয় ‘পারলোকিউশনারি মিসফায়ার’। এর অর্থ হলো বক্তা যে উদ্দেশ্যে কথা বলেছেন, সেই উদ্দেশ্যের বদলে শ্রোতাদের ওপর ভিন্ন প্রভাব ফেলা। যদিও সেই প্রভাব ইতিবাচক ফল দিয়েছে।

শাহবাজ সম্ভবত সম্মেলনে আমন্ত্রণকারীকে (ট্রাম্প) প্রশংসা করে সবার নজর কাড়তে চেয়েছিলেন। তবে এর পরিবর্তে ভূরাজনৈতিক পার্শ্বচিত্রে মনযোগের কেন্দ্রে আসলেন তিনি—বিশ্লেষকদের বিদ্রুপের পাত্র হলেন। তবে বড় কথা, ট্রাম্পের নজরে এলেন।

শাহবাজের এমন কর্মকাণ্ড নীতিনির্ধারক মহলকে হয়তো সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তবে তা সংবাদপত্রের শিরোনামে দাপট দেখিয়েছে—বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। আর শারম আল–শেখের সম্মেলন যখন বড় অংশে যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের প্রভাবাচ্ছন্ন ছিল, তখন তাঁর ওই কর্মকাণ্ডের ফলে সেখানে প্রাসঙ্গিক হয়েছে পাকিস্তান। এটি বিরল একটি বিষয়।

এটা কি নতুন পররাষ্ট্রনীতি

তবে রাজনীতিতে সৌজন্যবোধের প্রাচীন নিয়মকানুন খুব কমই মেনে চলা হয়। বিশেষ করে একুশ শতকের গণমাধ্যমের যুগে এই প্রবণতা আরও প্রবল। রাজনীতিতে এখন যা গুরুত্বপূর্ণ, সেটি উদ্দেশ্য পূরণ নয়, বরং গুরুত্ব সৃষ্টি করা।

ট্রাম্প এমন একজন মানুষ, যাঁর কাছে আদর্শের চেয়ে নিজের ভাবমূর্তিটা বড়। তাই শাহবাজের বক্তব্যের পর তিনি রাষ্ট্রনায়কের মতো নয়, বরং একজন তারকার মতো আচরণ করেছেন। প্রশংসায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। তিনি হেসেছেন, মজা করেছেন আর অঙ্গভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আর কিছু বলার দরকার নেই। শাহবাজের কথায় বিশ্ব হাসল, তবে ট্রাম্প শুনলেন।

আর এখানেই রয়েছে বৈপরীত্যটা। যেসব অযৌক্তিক বক্তব্য গতানুগতিক কূটনীতিকদের থেকে শাহবাজকে আলাদা করেছিল, তা অল্প সময়ের জন্য হলেও তাঁকে ট্রাম্পের জগতের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিল। এই জগতে আবেগের স্থানটা বড়। এটি এমন একটি জগৎ, যেখানে প্রশংসা মানে সমর্থন আর স্বীকৃতি মানে দূরদৃষ্টি। যা কূটনৈতিকভাবে ভুল বলে মনে হচ্ছিল, তা মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে একটি কৌশলগত সফলতা ছিল। এটি ছিল একজন আত্মকেন্দ্রিক মানুষের যে স্বীকৃতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, তা পূরণের জন্য সুনিপুণ চেষ্টা।

শারম আল-শেখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বলা কথাগুলো গাজার পুনর্গঠনের গতিপথ বদলাবে না। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিও নতুন করে তৈরি করবে না।

এ ঘটনার মাধ্যমে প্রদর্শনমূলক কূটনীতির যে যুগে আমরা রয়েছি, সে সম্পর্কেও বড় সত্য প্রকাশ পায়। আধুনিক যুগের শীর্ষ সম্মেলনগুলো শুধু সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা নয়, বরং নিজেকে প্রদর্শনের জায়গাও। নেতারা একে অপরের সঙ্গে যত না কথা বলেন, তার চেয়ে বেশি নিজেদের প্রচার চান।

কখনো কখনো আবার কোনো একজন ব্যক্তির অহংবোধের ওপর মনোনিবেশ করেন। চাটুকারিতা একসময় কারোও সম্মতি পাওয়ার সূক্ষ্ম কৌশল ছিল। তবে তা এখন আত্মপ্রচারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে একটি বক্তৃতা বিশ্বকে হতবাক করে দিলেও যদি তা মানুষের নজর কাড়ে এবং খবরের শিরোনাম হয়ে উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে, মন্দ কী।

শারম আল-শেখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বলা কথাগুলো গাজার পুনর্গঠনের গতিপথ বদলাবে না। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিও নতুন করে তৈরি করবে না। তবে কথাগুলো আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তিত কলাকৌশলকে প্রকাশ করে। এই কৌশলে অযৌক্তিক বক্তব্যও কাজে লাগতে পারে।

প্রচলিত অর্থে শাহবাজের ওই বক্তব্য কূটনীতি ছিল না, বরং ছিল একটি কেস স্টাডি। এই কেস স্টাডিতে দেখানো হয়েছে—একজন আত্মকেন্দ্রিক মানুষের কাছে তোষামোদ কীভাবে দুর্বলতা থেকে হাতিয়ারে রূপান্তরিত হয়।

শাহবাজের বক্তব্য সম্মেলনকক্ষজুড়ে সবার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। এ নিয়ে কুটনীতিকেরা ফিসফিসিয়ে কথা বলেছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপহাসের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। তবে কক্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটা আত্মতৃপ্তির হাসি হেসেছিলেন। আর ভূরাজনীতিতে পুরো বিশ্বের হাস্যরসের চেয়ে কখনো কখনো একজন মানুষের করা প্রশংসা বেশি গুরুত্ব রাখে।