স্বামী ও সন্তানদের বাঁচাতে গুলির সামনে বর্ম হয়ে ছিলেন পাকিস্তানি নারী

প্রতীকী ছবি

কনকনে শীত। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা। শাহ বুলবুল বড় বড় দুটি স্যুটকেস টেনে বাসে তুললেন। এরপর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বাসে চেপে বসলেন। বিদায় জানালেন নিজ শহর ঘিজারকে। আর্থিক দৈন্যদশা কাটিয়ে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার স্বপ্ন নিয়ে নতুন গন্তব্য পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর করাচির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন।

পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় ঘিজার শহর থেকে দক্ষিণের সিন্ধু প্রদেশের শহর করাচির যাত্রা প্রায় ৩০ ঘণ্টার। পথ চলতে চলতে সন্ধ্যা। ক্লান্ত বুলবুলের চোখ লেগে এসেছিল। কোলে পাঁচ বছরের মেয়ে উমাইমা। আচমকা স্ত্রী তাঁকে জোরে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করতে থাকেন।
বুলবুল বলেন, ‘আমার স্ত্রী আমাকে ও সন্তানদের জাগিয়ে তুলে বাস থেকে নামতে বলছিল। এই সময় আমি বুঝতে পারি, বাস হামলার শিকার হয়েছে। কারণ, বাইরে থেকে গুলির শব্দ আসছিল।’

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বুলবুল বলেন, ‘জানালার পাশেই ছিল আমার স্ত্রী। সে দ্রুত তার কোলে থাকা আমাদের দুই বছরের ছেলে আরসালানকে বাসের মেঝেতে বসিয়ে দেয় এবং জোর করে আমাকে ও মেয়েকে বাসের আসনের নিচে চেপে ঢুকিয়ে দেয়। এরপর বাসের আসনের ওপর শুয়ে আমাদের আড়াল করে। আমি যখনই বোঝার চেষ্টা করছিলাম কী হচ্ছে, তখনই সে বলল, তার গায়ে গুলি লেগেছে। আমি যাতে সন্তানদের রক্ষা করি।’

এক ঘণ্টা যেন দোজখ ছিল

২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলের চিলাস শহরের কাছে হামলার শিকার হয়েছিল বাসটি। দেশটির উত্তরের স্বায়ত্তশাসিত এই অঞ্চল চীনের সীমান্তবর্তী। ঘটনার সময় বাসটিতে ৪৫ যাত্রী ছিলেন। বাসটি তখন কারাকোরাম হাইওয়ে থেকে নেমে যাচ্ছিল। ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথ কারাকোরাম পর্বতমালার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানকে চীনের সঙ্গে সংযুক্ত করে।

কারাকোরাম হাইওয়ে। ২ ডিসেম্বর বাসটি এই হাইওয়েতে হামলার শিকার হয়
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ওই হামলায় পাকিস্তানি ২ সেনাসহ অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২৪ জনের বেশি। তাঁদের মধ্যে বুলবুলের স্ত্রী রোশানও ছিলেন। তাঁর গায়ে লেগেছে ছয়টি গুলি। পুলিশ হামলার ঘটনা তদন্ত করছে। তবে এখনো কেউ হামলার দায় স্বীকার করেনি।

সেই হামলার ঘটনার স্মৃতি মনে করে বুলবুল বলেন, ‘যখন গুলি শুরু হলো, তখন বাসটি পার্বত্য এলাকায় খাড়া সড়কে। বাসের চালক গতি বাড়িয়ে দিলেন। একটি ঢালু জায়গায় এসে আচমকাই চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তাঁর গায়েও গুলি লেগেছিল। আমি দম আটকে রেখেছিলাম। ভাবছিলাম বিপরীত দিক থেকে আসা একটি বাসের সঙ্গে ধাক্কা খেলে আমাদের বাসটি সড়ক থেকে ছিটকে নদীতে পড়তে পারে বা উল্টে যেতে পারে। প্রথম গুলি থেকে শুরু করে বাস থামানো পর্যন্ত—সবকিছু ১০ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে হয়েছে, কিন্তু আমার কাছে অনন্তকাল মনে হচ্ছিল।’

বুলবুল বলেন, ‘ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। আমাদের পেছনের আসনের যাত্রীরাও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আমি ছেলেমেয়েদের শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম। আর আমার স্ত্রী গুলিতে রক্তাক্ত হয়ে গেলেও আমাদের জন্য বর্ম হিসেবে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল। বাসে লোকজন সাহায্য চেয়ে কেউ গোঙাচ্ছিলেন, কেউ চিৎকার করছিলেন।’

বুলবুল বলেন, চিলাস অঞ্চল ও গিলগিত-বালতিস্তানের অন্যান্য জায়গায় অতীতে অনেক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, তাঁর ধারণা, হামলাকারীরা বাসে উঠলে সবাইকে মেরে ফেলত।

‘বাসটি থামার পর রোশান নিজের কথা না ভেবে বারবার শুধু সন্তানদের বাইরে নিয়ে যেতে বলছিল। তাদের যাতে দেখে রাখি, সেটাও মনে করিয়ে দিচ্ছিল। রোশানকে হয়তো বাঁচাতে পারব না, এটি আমি ধরেই নিয়েছিলাম,’ বলেন বুলবুল।

দুই সন্তানকে নিয়ে বুলবুল গাড়ি থেকে নামার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেখেন, আসনের কাছে লোকজন পড়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গেছেন, কেউ কেউ সাহায্য চাইছিলেন।

এ যেন দ্বিতীয় জীবন

পাহাড়ি এলাকায় মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া খুব কঠিন। তবে স্থানীয় লোকজন গুলির শব্দ শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছিলেন এবং সাহায্য করেছিলেন। তাঁর স্ত্রীসহ কয়েকজন আহত ব্যক্তিকে ভ্যানে করে আধা ঘণ্টার দূরত্বে চিলাস শহরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা জানান, রোশানের পিঠে ছয়টি গুলি লেগেছে এবং তাঁর জন্য প্রয়োজনীয় গ্রুপের রক্ত তাঁদের কাছে নেই।

বুলবুল বলেন, ‘এই দুঃসময়ে আমার ভাগ্য সহায় ছিল। সেই হাসপাতালের এক নার্স ছিলেন আমাদের এক আত্মীয়। তিনি কোনোরকমে কিছু রক্ত সংগ্রহ করেন। চিকিৎসকেরা জরুরি অস্ত্রোপচার করে রোশানের জীবন বাঁচান।’

এরপর সেখান থেকে মূল শহর গিলগিতে যান বুলবুল। আজ মঙ্গলবার দ্বিতীয় দফায় রোশানের অস্ত্রোপচার হয়। তাতে পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। চিকিৎসকেরা বলেন, তাঁর পাঁজর ভেঙে গেছে, এমনকি শরীরের ভেতরের অঙ্গও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো তাঁর মেরুদণ্ডে তিনটি গুলি আছে।

ঘিজার ৩৫ বছর বয়সী বুলবুল ছোট্ট একটি মুদিদোকান চালাতেন। তবে দেশের অর্থনৈতিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির কারণে বাবা-মা-ভাই-বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এই আয়ে চলা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল।

বুলবুল বলেন, ‘রোশানের মা–বাবা করাচিতে থাকেন। তাঁরাই বলেছিলেন, সেখানে চলে যেতে। তাঁরা আমাকে কাজ পাইয়ে দিতে সাহায্য করবেন। তাই আমি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সেখানে রওনা হয়েছিলাম। এখন যে রোশান বেঁচে আছে, এটাই অলৌকিক লাগছে।’

বুলবুল বলেন, ‘আমি যখন বাসের মেঝেতে বসে ছিলাম, তখনো গুলি চলছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম, এই বুঝি আমার মৃত্যুর পালা এল। ভাবি, যদি আমার গায়ে বা আমার সন্তানদের গায়ে গুলি লাগত বা আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই মারা যেতাম, তাহলে সন্তানদের কে দেখত। আল্লাহ আমাদের দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন। আমার স্ত্রীর সাহসিকতারও তুলনা হয় না। তাকে ধন্যবাদ।’