ইমরানকে গ্রেপ্তারের এক বছর: রাষ্ট্র এখনো পিটিআইয়ের সমর্থকদের ওপর ‘প্রতিশোধ’ নিচ্ছে

ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের জেরে ২০২৩ সালের ৯ মে পাকিস্তানে সহিংস বিক্ষোভ হয়েছিলফাইল ছবি: রয়টার্স

দুর্নীতির মামলায় ২০২৩ সালের ৯ মে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নেওয়ার এ ঘটনায় পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এমন প্রতিক্রিয়া আগে কখনো দেশটিতে দেখা যায়নি।

দেশজুড়ে বিভিন্ন শহরের রাস্তায় নেমে আসেন ইমরানের বিক্ষুব্ধ সমর্থকেরা। সেদিন পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়। এ ঘটনা ছিল দেশটির সেনাবাহিনীর জন্য একটি ধাক্কা।

ঘটনার দিন হাসান নামের এক পাকিস্তানি নাগরিক সাইকেল চালিয়ে লাহোরের একটি বাজারে গিয়েছিলেন। সেখানে ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) লোকজন প্রায়ই জড়ো হন। সহিংস বিক্ষোভে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া শত শত ব্যক্তির মধ্যে হাসানও ছিলেন।

সেদিনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে হাসান বলেন, যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো, তখন তাঁর হৃদয় ভেঙে যায়। তিনিসহ অন্যরা কাঁদছিলেন। কী করবেন, বুঝতে পারছিলেন না।

ঘটনার দিন লাহোর শহরে অবস্থিত এক লেফটেন্যান্ট জেনারেলের বাসভবনে আগুন দেওয়া হয়। রাজধানী ইসলামাবাদের রাস্তায় নেমে আসেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁরা সড়কের চিহ্নগুলো খুলে ফেলেন। আগুন জ্বালান। ইটপাথর ছোড়েন। ভাঙচুর করা হয় বহু সামরিক স্মৃতিস্তম্ভ।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে শাসনব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখা সামরিক বাহিনী ৯ মে’কে ‘কালো দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা বিক্ষোভকে সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ হিসেবে বর্ণনা করে।

এই ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেছে। তবে সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরানের অনেক সমর্থক এখনো সেদিনের ঘটনার শারীরিক ও মানসিক আঘাত বয়ে বেড়াচ্ছেন।

বিক্ষোভে জড়িত থাকার অভিযোগে যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে বিবিসি উর্দুকে বলেন, তাঁরা সেদিন শান্তিপূর্ণভাবেই রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁরা সহিংসতায় জড়িত ছিলেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই তাঁদের আটকে রাখা হয়েছিল। কারাবন্দী অবস্থায় তাঁদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়েছিল।

হাসান বলেন, তিনি বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে ইমরানের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা ঠিক ছিল না। তাঁরা পুলিশকে বলেছিলেন, তারা (পুলিশ) সীমা অতিক্রম করেছে।

হাসান বলেন, ইমরানের সঙ্গে অনেক পাকিস্তানিদের একটি মানসিক সংযোগ আছে। তিনি তাঁদের কাছে ভাইয়ের মতো, বাবার মতো।

আবরার নামের ইমরানের আরেক সমর্থকও সেদিন রাস্তায় নেমেছিলেন। সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে আবরার বলেন, ইমরানকে গ্রেপ্তারের ভিডিও ফুটেজ দেখার পরপরই তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর লাহোরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। কারণ, তিনি অনুভব করেছিলেন, তাঁর নেতাকে এভাবে অপমান করা উচিত নয়।

পাকিস্তানে ক্রিকেট খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা। দেশটির ক্রিকেটভক্তদের কাছে ইমরান একজন ‘কিংবদন্তি’। তিনি ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তান জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান সে বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।

পরে ইমরান রাজনীতিতে নাম লেখান। সমালোচকেরা বলে থাকেন, ইমরানের ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে দেশটির সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল। তবে এই অভিযোগ উভয় পক্ষই অস্বীকার করে।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বেশির ভাগ সময় পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এসেছে সেনাবাহিনী। দেশের রাজনীতিতে পর্দার আড়ালের একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় সেনাবাহিনী।

ইমরান ২০১৮ সালের জুলাইয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। চার বছরের মাথায় ২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে বিরোধীদের আনা অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি।

গত ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনের আগেভাগে বেশ কয়েকটি ফৌজদারি মামলায় ইমরানকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদের অভিযোগসহ বেশ কয়েকটি মামলা লড়ছেন ইমরান। কারাগারে থাকলেও পাকিস্তানে ইমরান ও তাঁর দলের বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে।

ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ইমরানের পিটিআইকে দলীয় নির্বাচনী প্রতীক দেওয়া হয়নি। ফলে তাঁর দলের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। নির্বাচনে পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি আসন পান। তবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁরা পেতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় ইমরানবিরোধীরা জোট সরকার গঠন করে।

২০২৩ সালের ৯ মের বিক্ষোভে কমপক্ষে ১০ জন নিহত হন। আহত হন শত শত ব্যক্তি। কর্তৃপক্ষ দাবি করে, সহিংসতায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা ২৫০ কোটি পাকিস্তানি রুপির সমান।

এই ঘটনার পর ইমরান-সমর্থকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যাঁরা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান, তাঁরা নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগ করেন।

নয় মাস কারাগারে থাকার পর চলতি বছরের শুরুর দিকে মুক্তি পান আবরার। তিনি বলেন, কখনো কখনো কারাগারকে কবরস্থানের মতো মনে হতো তাঁর।

ইন্তিজার নামের ইমরানের আরেক সমর্থক এই বিক্ষোভের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনি বিবিসি উর্দুকে বলেন, কারাগারের কর্মকর্তারা তাঁদের সঙ্গে এমন আচরণ করেছেন, যেন তাঁরা সন্ত্রাসী। ইন্তিজার তাদের বলেছিলেন, তিনি শুধু প্রতিবাদ করেছেন, ভাঙচুর করেননি।

ইন্তিজার বলেন, বিক্ষোভের ঘটনায় তাঁকে খুঁজছিল পুলিশ। তাঁকে ধরতে পুলিশ তাঁর বাড়িতে হানা দিয়েছিল। বাড়ির ফটক ভেঙে ফেলেছিল। তাঁর পরিবারের সদস্যরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছিলেন। এ অবস্থায় তিনি পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছিলেন।

ইন্তিজার বলেন, তাঁরা, তাঁদের পরিবার কী পরিস্থিতি সহ্য করেছে, তা কখনো ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না তিনি।

দেশটির রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান সামনে এগোতে পারবে না।

বিক্ষোভের ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন করেছিলেন পাকিস্তানের সাংবাদিক বেনজির শাহ। তিনি বলেন, তিনি মনে করেন, এই বিষয়ে রাষ্ট্র কেবল তার ক্ষোভ প্রকাশ করে চলছে। তদন্ত করার পরিবর্তে রাষ্ট্র প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করাসহ জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তির ভূমিকা স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়েছেন।

সাংবাদিক বেনজির শাহ বলেন, ‘এটা না করা পর্যন্ত আমরা এগোতে পারব না।’

তবে বিক্ষোভের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পিটিআইকে উদ্দেশ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আহমেদ শরিফ সাংবাদিকদের বলেছেন, একটি নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা নয়। সামনে অগ্রসর হওয়ার একমাত্র উপায় হলো, এই ধরনের নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীর জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া। বিদ্বেষের রাজনীতি ত্যাগের অঙ্গীকার করা। গঠনমূলক রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া।