পারভেজ মোশাররফের উত্থান-পতন

পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

১৯৯৯ সালের ঘটনা। রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানে পাকিস্তানে রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদল ঘটে। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন পাকিস্তানের তখনকার সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফ। এরপর প্রায় এক দশক পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তিনি। তাঁর শাসনামলে পাকিস্তানের অর্থনীতির দ্রুত উন্নতি হতে শুরু করে। এ ছাড়া ‘রক্ষণশীল’ দেশ হিসেবে পরিচিত মুসলিমপ্রধান পাকিস্তানে অনেকগুলো সামাজিক সংস্কার আনার কৃতিত্ব দেওয়া হয় সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফকে।    

রোববার ৭৯ বছর বয়সে মারা গেছেন সাবেক এই সামরিক শাসক। ২০১৬ সালের মার্চ মাস থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে ছিলেন। আমিরাতের দুবাইয়ে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পারভেজ মোশাররফের মৃত্যু হয়েছে। অ্যামাইলয়েডোসিস নামের এক বিরল রোগে ভুগছিলেন তিনি।

সামরিক শাসক হলেও বহু বছর ধরে পাকিস্তানের মানুষের সমর্থন ছিল তাঁর প্রতি। পারভেজ মোশাররফের সবচেয়ে বড় হুমকি ছিল আল–কায়েদা এবং অন্যান্য ইসলামপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী। এসব জঙ্গিগোষ্ঠী তাঁকে অন্তত তিনবার হত্যার চেষ্টা করেছিল। তবে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে কঠোর হাতে প্রতিপক্ষ ও বিরোধীদের দমন করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে আল–কায়েদা ও আফগানিস্তানের তালেবানের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণার জন্য তাঁর পতন ঘটে বলে ধারণা করা হয়।  

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল পারভেজ মোশাররফের
ফাইল ছবি: রয়টার্স

রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর পারভেজ মোশাররফের সরকার অনেকগুলো সংস্কার পদক্ষেপ নয়। যেমন নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য আইন প্রণয়ন করা ও প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে বেসরকারি মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল চালুর অনুমতি দেওয়া। এসব সংস্কারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসাও কুড়ান তিনি।  

সিগারেট ও আমদানি করা হুইস্কির প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। এ ছাড়া মুসলিমদের রক্ষণশীল অবস্থান ছেড়ে ‘আলোকিত মধ্যপন্থার’ জীবনধারা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান তিনি। এ জন্য ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পরে আতঙ্কিত হয়ে পড়া পশ্চিমা দেশগুলোয় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।

আরও পড়ুন

‘নাইন–ইলেভেন’ নামে পরিচিত এ হামলার পর পারভেজ মোশাররফ ওয়াশিংটনের একজন ‘অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র’ হয়ে ওঠেন। মার্কিন বাহিনীকে পাকিস্তানে গোপন ঘাঁটি গড়ে তোলার অনুমতি দেন তিনি। এসব ঘাঁটি থেকে আফগানিস্তানে ড্রোন হামলা চালাত যুক্তরাষ্ট্র। এসব হামলায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একই সঙ্গে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীও মোতায়েন করেছিলেন তিনিই।    

পারভেজ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে পারভেজ মোশাররফের সরকার ‘বৈধতা’ পায়। একই সঙ্গে স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সরকারের রক্তক্ষয়ী এক সংঘাত শুরু হয় এসব কারণে। পাকিস্তানকে এখনো এসব চরমপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

২০০৬ সালে পারভেজ মোশাররফ তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে দাবি করেন, বিভিন্ন কারণে পাকিস্তানের ওপর রুষ্ট ও ক্ষুব্ধ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিচ্ছিল, পাকিস্তান যদি ওয়াশিংটনের সঙ্গে সহযোগিতার হাত না বাড়ায়, তাহলে বোমা হামলা চালানো হবে। এ পরিস্থিতি থেকে পাকিস্তানকে বাঁচানোর কৃতিত্ব নেন তিনি।    

আরও পড়ুন

তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল পারভেজ মোশাররফের। সেই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ওয়াশিংটন থেকে সেনাবাহিনীর জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ বরাদ্দ করিয়েছিলেন তিনি। এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর দ্ব্যর্থহীন সমর্থন কখনো ছিল না। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে আফগান তালেবান ও আল–কায়েদার সঙ্গে গোপন সমঝোতা এবং আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আছে।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সব রকম চেষ্টা করেছিলেন পারভেজ মোশাররফ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিক করারও চেষ্টা চালিয়েছিলেন পারভেজ মোশাররফ। ২০০২ সালের একটি ঘটনা পুরো বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। সে বছর এক সম্মেলনে অংশ নেন পারভেজ মোশাররফ। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সে সম্মেলনে ছিলেন ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী। সেই সম্মেলনে বক্তৃতা শেষ করে হেঁটে বাজপেয়ীর কাছে যান পারভেজ মোশাররফ। করমর্দন করে তাঁকে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন।  

কিন্তু নয়াদিল্লির সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্কের বরফ গলেনি। এখনো প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে বিরোধের সবচেয়ে বড় কারণ কাশ্মীর। যদিও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, পারভেজ মোশাররফের সময় কাশ্মীর সংকট সমাধানের কাছাকাছি গিয়েছিল। কিন্তু তাঁর শাসনামলের পর আলোচনা থমকে যায়।

আরও পড়ুন

পারভেজ মোশাররফের শাসনামলে পাকিস্তানে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। এতে করে অর্থনীতির আকারও বাড়ে। বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও শুরু হয় তাঁর সময়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, পারভেজ মোশাররফের সময় পাকিস্তানের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে ওঠে, যেটা ছিল প্রায় তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

তবে একই সঙ্গে পারভেজ মোশাররফের শাসনামলের নানা বদনামও আছে। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে পাকিস্তানে কর্তৃত্ববাদী শাসন বাড়তে থাকে। এতে করে তাঁর সরকারের অনেক অর্জন ম্লান হয়ে যায়। ২০০৬ সালে সামরিক বাহিনীকে একটি অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন পারভেজ মোশাররফ। এই সেনা অভিযানে বেলুচিস্তানের একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা নিহত হন। এতে করে বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা বাড়তে শুরু করে। এরপর থেকে যা ক্রমে বেড়ে চলেছে।

আরও পড়ুন

এরপর ২০০৭ সালের শেষ দিকে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো নিহত হন। এ ঘটনার পরই পাকিস্তানজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় বিক্ষোভ। এ পরিস্থিতিতে পারভেজ মোশাররফ জাতীয় নির্বাচন স্থগিত করে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।

২০০৮ সালে ১১ বছর পর পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পারভেজ মোশাররফের দল হেরে যায়। এমন পরিস্থিতিতে সংসদ সদস্যদের দ্বারা অভিশংসনের মুখে পড়েন তিনি। অভিশংসন এড়াতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ওই বছরেই পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গিয়ে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে আশ্রয় নেন তিনি।

প্রায় পাঁচ বছর লন্ডনে থাকার পর ২০১৩ সালে পাকিস্তানে ফেরেন পারভেজ মোশাররফ। ওই বছর ছিল পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন। একটি আসন থেকে সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে দেশটির নির্বাচন কমিশন তাঁকে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করলে শেষমেশ তিনি সে নির্বাচনে অংশ নিতে পারনেনি। ২০১৬ সালে তিনি দুবাইয়ে যাওয়ার অনুমতি পান। জরুরি অবস্থা ঘোষণার দায়ে ২০১৯ সালে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। অবশ্য পরে সেই মৃত্যুদণ্ড বাতিলও করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন