পাকিস্তানে সেনাশাসন কি আসন্ন

পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার নিবন্ধটি লিখেছেন আম্বের রহিম শামসি। তিনি পাকিস্তানের করাচির সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ইন জার্নালিজমের পরিচালক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এ নিবন্ধে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করতে যাওয়ার ঘটনায় সৃষ্ট অচলাবস্থা ও আইনি ঝামেলা, দেশটির পরবর্তী নির্বাচন ও এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সামরিক বাহিনীর ভূমিকাসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান
ফাইল ছবি: রয়টার্স

সময়টা ১৪ মার্চ, ২০২৩। স্থান পাকিস্তানের লাহোরের জামান পার্ক। পুরো দিন ও রাতে যেন এক ইঁদুর–বিড়াল খেলা হলো সেখানে। কুশীলব পুলিশ আর পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) কর্মী–সমর্থকেরা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআইপ্রধান ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করতে গেলে পিটিআই কর্মী–সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ইটপাটকেল, কাঁদানে গ্যাসের শেল, পেট্রলবোমা—পুরো রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে জামান পার্কে ইমরান খানের বাড়ির সম্মুখে।  

তবে পিটিআই কর্মী–সমর্থকদের বাধার মুখে পিছু হটে পুলিশ। ইমরান খানকে গ্রেপ্তার না করেই ফিরতে হয় তাদের। যদিও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়েই সেখানে গিয়েছিল পুলিশ। পুরো পরিস্থিতি দেখে একটি প্রশ্ন সামনে আসে: এটাই কি সেই মুহূর্ত?

আরও পড়ুন

পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বহুবার এই প্রশ্ন করেছেন। এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। আর মুহূর্তটা হলো—সামরিক আইন জারি, দেশজুড়ে দাঙ্গা–হাঙ্গামা, সহিংসতা, সর্বোপরি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ। পাকিস্তানের ইতিহাসে বহুবার ‘সেই মুহূর্ত’ দেখা গেছে।

ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় পাওয়া উপহার রাষ্ট্রীয় তোশাখানায় জমা না দিয়ে বিক্রি করেছেন তিনি। এ জন্য পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন মামলা করেছে। জারি হয়েছে অজামিনযোগ্য পরোয়ানা। নানা নাটকীয়তার পর গতকাল শুক্রবার লাহোর হাইকোর্টে হাজির হন ইমরান। সঙ্গে ছিল হাজারো কর্মী–সমর্থক। আজকের (শনিবার) শুনানি পর্যন্ত পরোয়ানা স্থগিত করেছেন আদালত। আজ ইমরানের আদালতে হাজির হওয়ার কথা রয়েছে।

বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছেন। ইমরানও আলোচনা নিয়ে তাঁর আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তবে এ নিয়ে ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা’ প্রথমে কে বাঁধবে, তা নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে দুই পক্ষ।

ইমরানের ব্যতিক্রমী কৌশল

ইমরানের ওপর আঘাত এই প্রথম নয়। গত বছরের এপ্রিলে পার্লামেন্টের অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে তিনি পাকিস্তানজুড়ে লংমার্চ করেছেন। লংমার্চে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সুস্থ হয়ে আবারও পথে নেমেছেন ইমরান। দাবি, জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা। এবার তিনি ডাক দিয়েছেন ‘জেল ভরো’ আন্দোলনের। অর্থাৎ, ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রেপ্তার হয়ে পাকিস্তানের কারাগারগুলো ভরিয়ে ফেলতে দলীয় নেতা–কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে পিটিআইয়ের নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার হওয়ার নির্দেশ দিলেও নিজের গ্রেপ্তার ঠেকাতে নানা নাটকীয়তায় জড়িয়েছেন ইমরান খান। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে কয়েক ডজন মামলা রয়েছে। এর কিছু বেশ গুরুতর, কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশে করা। এত কিছুর পরও ইমরান খান তীব্র সরকারবিরোধী অবস্থানে অবিচল রয়েছেন।

আরও পড়ুন
লাহোরে ইমরানের বাড়ির বাইরে সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান ছোড়ে পুলিশ। ১৪ মার্চ তোলা
ছবি: রয়টার্স

এখানে ইমরান খান ব্যতিক্রম। সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে ক্ষমতা হারানোর পর পাকিস্তানের আর কোনো নেতা এত বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে, পরাক্রম নিয়ে রাজনীতি করতে পারেননি। এমন নজির পাকিস্তানে নেই বললেই চলে। ইমরান এই ইতিহাস ভেঙে দিয়েছেন।  

ঔপনিবেশিক আমল থেকে উপমহাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে একটা প্রবণতা দেখা যায়—তাঁরা কারাগারে যেতে চান। হয়তো মনে করেন, এতে তাঁদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। ব্রিটিশ শাসকেরা বিদায় নিলেও এই ধারা এখনো রয়ে গেছে। জুলফিকার আলী ভুট্টো থেকে বেনজির ভুট্টো, আসিফ আলী জারদারি থেকে নওয়াজ শরিফ ও মরিয়ম নওয়াজ—সবাই কারাবরণ করেছেন। কিন্তু ইমরান খান সেই পথে হাঁটতে চান না।

তবে জামান পার্কে সহিংসতার পর কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও নাটকীয়তা, আইনি ঝামেলা, রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটেনি। সেই সঙ্গে ‘এটাই কি সেই মুহূর্ত’—এই প্রশ্নের উত্তর নিয়েও অস্পষ্টতা কাটেনি। তা ছাড়া সহিংসতা বন্ধ করা ও অচলাবস্থা দূর করার সহজ কোনো পথ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

সুবিধাভোগী কে হবে

বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছেন। ইমরানও আলোচনা নিয়ে তাঁর আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তবে এ নিয়ে ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা’ প্রথমে কে বাঁধবে, তা নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে দুই পক্ষ। গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে যে গভীর বিরোধ–শত্রুতা দেখা গেছে, তাতে বিভক্ত অবস্থান নিতে দেখা গেছে সামরিক বাহিনীকে, এমনকি উচ্চ আদালতকেও। এর অনিবার্য ফলাফল সহিংসতা, অচলাবস্থা।

তুরস্কের লেখক ইসে তেমেলকুরান একটি বই লিখেছেন। নাম ‘হাউ টু লস এ কান্ট্রি’। এ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার আগে পর্যন্ত ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীরা ভঙ্গুর আপসপ্রক্রিয়াকে দূরে ঠেলে রাখে।’ এখন পাকিস্তানের পরিস্থিতি অনেকটা তেমনই। পাকিস্তান এখন এমন একপর্যায়ে রয়েছে, গণতন্ত্র আর কর্তৃত্ববাদের মধ্যবর্তী এক অরাজক সময়কাল চলছে। এখন দেখার বিষয়, এ পরিস্থিতির সুবিধাভোগী কে হবে—দেশটির সামরিক বাহিনী, নাকি বেসামরিক শক্তি।

ইমরান খান ভয়েস অব আমেরিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বীকার করেছেন, পাকিস্তানের এখনকার পরিস্থিতির পেছনে একজন ব্যক্তি কলকাঠি নাড়ছেন। তিনি নাম উল্লেখ না করলেও, এই ব্যক্তি যে পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান আসিম মুনির—তা স্পষ্ট। সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে ইমরান খান বরাবর রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন, নিচ্ছেন। এটা ইমরানের রাজনৈতিক কৌশল। অথচ ২০১৮ সালে ইমরান খান পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সমর্থন–সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। এটা স্পষ্ট করে যে পাকিস্তানের প্রকৃত ক্ষমতা কোথা থেকে আসে।

আরও পড়ুন
পাকিস্তানের এখনকার বিভক্তি খুব একটা স্বাভাবিক নয়। পরিণতিও হয়তো ভালো হবে না। তাই নির্বাচনের আগে তিন পক্ষের মধ্যে (রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনী) অতীত–বর্তমানের সব অভিযোগ ও ভুল–বোঝাবুঝির নিষ্পত্তি করতে হবে। আর তা অবশ্যই সংবিধানের নিয়মকানুন মেনে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত বছর জেনারেল কামার আহমেদ বাজওয়াকে তৃতীয় মেয়াদে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন ইমরান খান। এর বিনিময়ে আগাম নির্বাচন চেয়েছিলেন তিনি। এর আগে তিনি জেনারেল বাজওয়াকে ‘সবচেয়ে গণতান্ত্রিক সেনাপ্রধান’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।

তবে পাশার দান উল্টে যায় সহজেই। মেয়াদ শেষে বিদায় নিতে হয় জেনারেল বাজওয়াকে। পরে ইমরান অভিযোগ করেন, তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করেছিলেন সেনাপ্রধান বাজওয়া। এ জন্য বাজওয়ার বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শালের আহ্বান জানান তিনি।

ভুল–বোঝাবুঝির অবসান প্রয়োজন

আগামী অক্টোবরে পাকিস্তানে পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এই নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খান ও তাঁর দলের এমন অম্লমধুর সম্পর্ক স্পষ্টতই প্রভাব ফেলবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক রেজা রুমির মতে, ইমরান খানের এখনকার রাজনীতির অন্যতম কৌশল মানুষের ধর্মীয় মনোভাব কাজে লাগানো, রাজনৈতিক অভিজাতদের প্রতি ঘৃণার বিস্তার ও সীমাহীন দুর্নীতির লাগাম টানা। সেই সঙ্গে পাকিস্তানিদের আমেরিকাবিরোধী মনোভাব চাঙা করেছেন তিনি। তরুণদের মধ্যে অধিকার আদায়ের মনোভাব উসকে দিয়েছেন। এসব কারণে ইমরান সামরিক–বেসামরিক শাসকদের কাছে এক ভয়ানক শত্রু।

আরও পড়ুন

এখন প্রশ্ন হলো, এই কৌশল পরবর্তী নির্বাচনে কতটা কাজে লাগবে? কী জাদু দেখাবে? সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, জামান পার্কের রণক্ষেত্র হয়ে ওঠা একটা পূর্বাভাস মাত্র। এখন একটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ—বিভক্ত রাজনীতি ও ভঙ্গুর অর্থনীতি ছাপিয়ে পাকিস্তান কী আরেকটি বিতর্কিত ক্ষমতা হস্তান্তরের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে?

পাকিস্তানের এখনকার বিভক্তি খুব একটা স্বাভাবিক নয়। পরিণতিও হয়তো ভালো হবে না। তাই নির্বাচনের আগে তিন পক্ষের মধ্যে (রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনী) অতীত–বর্তমানের সব অভিযোগ ও ভুল–বোঝাবুঝির অবসান করতে হবে। আর তা অবশ্যই সংবিধানের নিয়মকানুন মেনে। বৃহত্তম সমঝোতা ছাড়া পাকিস্তানের পরবর্তী নির্বাচন কার্যকারিতা হারাবে।